Skip to content

নৈসর্গিক কিশোরগঞ্জের হাওর

Haor

হাওর-বাঁওড় আর সমতলভূমির বৈচিত্র্যময় ভূ-প্রকৃতির বিস্তীর্ণ জনপদ কিশোরগঞ্জ, যাকে বলা হয় ভাটির দেশ। সৌন্দর্য যদিও এ জেলার সর্বত্র, তবে প্রকৃতির এক অপরূপ মিলন ঘটেছে মূলত হাওর অঞ্চলে। অপূর্ব সুন্দর এ জনপদ নিয়ে লিখেছেন— আহমেদ তানভীর

সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও কিশোরগঞ্জ— এ সাত জেলা মিলেই মূলত বাংলাদেশের হাওরাঞ্চল। এখানে ৭ লাখ ৮৪ হাজার হেক্টর জলাভূমিতে রয়েছে ৪২৩টি হাওর। তন্মধ্যে কিশোরগঞ্জেই রয়েছে ১২২টি হাওর।

কিশোরগঞ্জের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, এর একটি বিশাল এলাকা বছরের প্রায় ছয় মাস পানিতে ডুবে থাকে। কিশোরগঞ্জের ১৩টি উপজেলার মধ্যে মিঠামইন, অষ্টগ্রাম, ইটনা ও নিকলী অধিক বন্যাপ্রবণ হাওর অঞ্চল হিসেবে পরিচিত। এ এলাকার বিশাল হাওর একদিকে যেমন মিঠাপানির বিশাল ভাণ্ডার তেমনই প্রচুর মৎস্য সম্পদে ভরপুর। হাজারো জীববৈচিত্র্যের পাখি, জলজ উদ্ভিদ ও মুক্তাসহ ঝিনুক রয়েছে হাওরের সর্বত্র।

শীতকালে যে এলাকা শুকনো কিংবা খটখটে বালুচর, বর্ষাকালে সেখানে এমন জলধারা যে দিগন্ত বিস্তৃত চারদিক জলে থৈ থৈ করে। শুধু জলপ্রবাহই নয়, প্রচুর ঢেউ আছড়ে পড়ে দ্বীপ সদৃশ্য ভূখণ্ডে। জলরাশিতে দ্বীপের মতো গুচ্ছ গ্রামগুলো ভাসতে থাকে। বর্ষাকালে যে হাওরের পাগল করা ঢেউয়ের দোলায় শুষ্ক প্রান্তরগুলোও উত্তাল হয়ে ওঠে যেখানে শুকনো মৌসুমে পানি থাকে না একফোঁটাও। তখন যতদূর চোখ যায় শুধু বোরো ধানের শীষ বা সোনারাঙা ধানের সুবিপুল প্রশস্ত আঙিনা প্রাণকে করে উদ্বেলিত। শীতকালে ঝাঁকে ঝাঁকে অতিথি পাখির আগমন হাওর অঞ্চলে নতুনভাবে প্রাণ সঞ্চার করে।

শুকনো মৌসুমে মাইলের পর মাইল ফসলি জমি, ধুলোউড়া মেঠোপথ, রুপালি নদী। অথচ বর্ষায় এ রুপালি নদীগুলোই ফুঁসে ওঠে। দুই তীর ছাপিয়ে প্লাবিত করে ফসলি মাঠ। দেখতে অনেকটা সাগরের মতো। ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের কারণে হাওরের সৌন্দর্য অন্যান্য এলাকার চেয়ে একটু ভিন্ন। ব্যতিক্রম এখানকার ঋতুবৈচিত্র্য। হাওরে বর্ষা থাকে বছরের প্রায় ছয় মাস। পানি আসতে শুরু করে বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ থেকে। শেষ হয় আশ্বিন-কার্তিকে। বাকি কয় মাস এখানে শুকনো মৌসুম। সেই হিসেবে মূলত হাওরে ঋতু দুটি। একটি বর্ষা, অন্যটি শুকনো।

বছরের প্রায় সব সময়ই ভ্রমণবিলাসীদের জন্য সৌন্দর্যের বিপুল পসরা সাজিয়ে বসে থাকে এই হাওর। বিশেষত, বর্ষায় হাওর হয়ে যায় কূলহীন সাগর। বিশাল জলরাশির বুকে বিচ্ছিন্ন গ্রামগুলোকে ছোট ছোট দ্বীপের মতো লাগে। দূর থেকে মনে হয়, কচুরিপানা হয়ে যেন পানিতে ভাসছে গ্রামগুলো। হাওরজুড়ে গলা ডুবিয়ে থাকা হিজল গাছের সারি মন কাড়ে যে কারও। পানির নিচ থেকে জেগে ওঠা করচের বন, হাঁসের ডিমের মতো সাদা ফল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বরুন গাছ, কিংবা গাঙ্গেয় মিঠাপানিতে শুশুকের লাফ-ঝাঁপ দেখলে বিনোদিত না হয়ে পারা যায় না।

রাতে হাওরের মাঝখানে ছোট ছোট ডিঙি নৌকায় কুপিবাতি জ্বালিয়ে জেলেরা যখন জাল দিয়ে মাছ ধরে, দূর থেকে দেখে মনে হয় কারা যেন শত শত প্রদীপ জ্বালিয়ে হাওরের পানিতে ভাসিয়ে দিয়েছে। রাতভর হাওরে ভেসে ভেসে জ্যোত্স্না উপভোগ করাটা আনন্দের বিষয়। অভিলাষী মনকে জ্যোত্স্নায় ঠাঁই দেওয়ার এমন সুযোগ হাওর ছাড়া আর কোথায় আছে! হাওরে ট্রলারের ছাদে বসে সূর্যাস্তের দৃশ্য দেখাটাও সৌভাগ্য বটে। এখানে হিজল করচের মাথা ছুঁয়ে সূর্য যখন ডুবে, দিগন্তজুড়ে হাওরের পানি রক্তিম বর্ণ ধারণ করে। সূর্যের লাল-সোনালি-হলুদ আলোর রশ্মি অপূর্ব রেখা ছড়িয়ে দেয় পুরো আকাশজুড়ে। এ এক অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্য!

এখন বর্ষা চলছে। পানি ও বাতাসের সঙ্গে লড়াই করছেন হাওরবাসী। এ যুদ্ধক্ষেত্র একবার দেখে এলে মন্দ হবে না। একটি রাত ও একটি দিন কাটানো যেতেই পারে হাওরে। ভয়ের কিছু নেই। আবহাওয়া খারাপ না থাকলে ঢেউগুলো অতটা রুদ্রমূর্তি ধারণ করে না। ২৪ ঘণ্টার জন্য নৌকাই হতে পারে বাড়ি, নৌকাই হতে পারে ঘর। হাওরে নাওয়া, নৌকাতে খাওয়া। নৌকাতেই ঘুম। আর কী চাই।

বেশ কয়েকটি রুটে কিশোরগঞ্জের হাওরে যাওয়া যায়। তবে সহজ হলো সায়েদাবাদ বা গোলাপবাগ থেকে বাসে অথবা কমলাপুর থেকে ট্রেনে সরাসরি কিশোরগঞ্জ শহরে। স্টেশনে নেমে রিকশায় মিনিট দশেক। এরপরই একরামপুর। সেখান থেকে অটোরিকশায় মরিচখালি বাজার। এ বাজারটিই হলো এই পথে হাওরের দরজা। মরিচখালি বাজার মানেই হাওরের চৌকাঠে পা রাখা। চৌকাঠ পেরিয়ে সোজা নৌকায়। এরপর শুরু হবে ধুকপুক ধুকপুক ইঞ্জিনের শব্দ। এ শব্দের সঙ্গেই থাকতে হবে ২৪ ঘণ্টার মতো। প্রথমে বিরক্তিকর মনে হলেও পরে কানের সঙ্গে মানিয়ে যাবে। নৌকায় ওঠেই সিদ্ধান্ত নিতে পারেন আগে কোথায় যাবেন। সোজা দিল্লির আখড়া। দিল্লির আখড়া পরিদর্শন শেষে পরের সময়টা কাটাতে পারেন একেবারেই পরিকল্পনা ছাড়া। সব কিছুই নির্ভর করবে পরিস্থিতি ও আবহাওয়ার ওপর। তবে সময়গুলো কাটবে হাওরের ভাসা পানিতেই। বৃষ্টি না হলে ট্রলারের ছইয়ের উপরেই রাত কাটিয়ে দিতে পারেন। তা ছাড়া ট্রলারের ভেতরে ঘুমানোর ব্যবস্থা তো আছেই। ইচ্ছে করলে উপজেলা সদরের ডাকবাংলোতেও রাত কাটানো যায়। এরপর ভাসমান তাঁবু নিয়ে ধুকপুক করতে করতে নৌকার গতিপথ ঘুরিয়ে দিতে পারেন হাওর উপজেলা ইটনা, কিংবা অষ্টগ্রামের দিকে। হাওর প্রকৃতি স্বাদ পেতে এই বর্ষায় ঘুরে আসা যায় অনায়াসেই।

আবাসন ও রেস্তোরাঁ
কিশোরগঞ্জের হাওর অঞ্চলে ভালো মানের আবাসনের তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই। তবে, মিঠামইন বাজারে আল কামাল আবাসিক হোটেল (এসি), হামিদ আবাসিক হোটেল (নন এসি) হোটেল রয়েছে। সব থেকে ভালো হয় যদি ওখানে কোনো পরিচিতজনের বাড়িতে উঠতে পারেন। এ ছাড়া কিশোরগঞ্জ সদরে থেকে একদিনেই ঘুরে আসতে পারেন। সদরে কিছু অভিজাত আবাসিক হোটেলে আবাসনের সুব্যবস্থা রয়েছে। হাওরে বেড়ানোর জন্য সদর থেকে খাবার নিয়ে যাওয়াই ভালো। সৌজন্যে: বাংলাদেশ প্রতিদিন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *