Skip to content

নৌকাবাড়ির কেরালায়

:: এ এস এম শাহীন ::

এই তো কিছুদিন আগে কোলকাতা থেকে ফ্লাইট ধরে হায়দরাবাদ হয়ে কেরালার প্রধান বাণিজ্যিক কেন্দ্র কোচিনে পৌঁছালাম। তখন দুপুর ১২টা। বিমানবন্দর থেকে বের হতেই দেখা হলো আমাদের এই গাড়ির চালক ও গাইড জীবন কুমারের সঙ্গে। সিদ্ধান্ত নিলাম সোজা মুনার যাব।

কোচিন থেকে মুনারে যাওয়ার ১০৬ কিলোমিটার রাস্তা, বেশির ভাগই পাহাড়ি। এক ঘণ্টা সমতলের পথ শেষ হতেই শুরু আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ আর ছোট-বড় অনেক ঝরনা। এমনই একটা ঝরনায় আধভেজা হয়ে চা-বিরতি নিলাম আমরা—কেরালার চায়ে দুধের পরিমাণ অনেক বেশি আর এলাচের ছড়াছড়ি।

কিছুদূর যাওয়ার পর শুরু হলো চা-বাগান। একটার পর একটা—জনবসতি নেই বললেই চলে। একটা বিষয় অবাক করল। আমাদের দেশের চা-বাগানের অতি পরিচিত শেড ট্রি এসব চা-বাগানে নেই বললেই চলে। হয়তো উচ্চতার কারণেই এই ভিন্নতা। বলে রাখা ভালো যে মুনার সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৪৭০০ থেকে ৮৮০০ ফুট উচ্চতার মধ্যে অবস্থিত।

চার ঘণ্টা যাত্রা শেষে আমরা মুনার শহর পার হলাম। আমাদের হোটেল আরও ১৭ কিলোমিটার দূরে উঁচু পাহাড়ের চিন্নাকালাম এলাকায়। হোটেলে পৌঁছাতেই শুরু হলো বৃষ্টি। পরদিন সকালে ঘুম ভেঙে দেখি চারদিকে রোদে ঝলমল সবুজ চা-বাগান। মুনারের আবহাওয়া ঘণ্টায় ঘণ্টায় বদলে যায়। এই মেঘ-বৃষ্টি আবার একটু পরেই ঝকঝকে রোদ।

নাশতা শেষে বের হলাম। রোজ গার্ডেনে নানা ধরনের গোলাপের সঙ্গে বিচিত্র সব অর্কিড দেখলাম। এরপর মাত্তুপেত্তি বাঁধ। ১৯৫৩ সালে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য এই বাঁধ দেওয়া হয়। এটি মুনারের তিনটি প্রধান নদীর পানি ব্যবহার করে কম খরচে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে।মাত্তুপেত্তি বাঁধের হ্রদমুনার থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে ইকো পয়েন্ট, যেখানে পাহাড় আর হ্রদের ভূপ্রাকৃতিক গঠনের কারণে যেকোনো শব্দেরই প্রতিধ্বনি শোনা যায়। এখানে পথে মাঝেমধ্যেই দেখা যায় বুনো হাতির দল। হাতিগুলো ঘাস খেতে নিচে নেমে আসে, আমাদেরও সৌভাগ্য হলো হাতির একটি পালের তিন সদস্যের চলাফেরা দূর থেকে দেখার। আরও ১৭ কিলোমিটার দূরে টপ স্টেশন যেটা মুনারের সর্বোচ্চ পয়েন্ট, সেখান থেকে মুনার ও পার্শ্ববর্তী তামিলনাড়ু রাজ্যের দৃশ্য দেখা যায়। এখানে নীলাকুরিনজি ফুল বারো বছর পর পর পাহাড়জুড়ে ফুটে থাকে। আর এই টপ স্টেশনকে নীল কার্পেটের মতো মুড়ে দেয়। আগামী বছর (২০১৮ সালে) আবার এই ফুল ফুটবে, ২০০৬ সালের বারো বছর পরে।

পরদিন গেলাম এরাভিকুলাম ন্যাশনাল পার্ক দেখতে। এটা সরকারি সাফারি পার্ক। টিকিট কেটে বাসে করে দুই ঘণ্টার বন্য প্রাণী দর্শন। এখানে বিভিন্ন চেনা প্রাণীর সঙ্গে দেখা পেলাম অতি বিপদাপন্ন নীলগিরির। রাতে দেখলাম কেরালার ঐতিহ্যবাহী কথাকলি নৃত্য, যাতে তাদের জীবনধারা ও প্রাচীন লোককাহিনি সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলেন মাত্র দুজন শিল্পী। মাত্র দুজন মানুষ যে কতগুলো চরিত্রে অভিনয় করতে পারেন, তা কথাকলি না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন।

তিন রাত পাহাড়ে থেকে এবার যাত্রা কেরালা ব্যাকওয়াটারের উদ্দেশে—কুমারাকমের দিকে। যে পথে আমরা মুনারে এসেছিলাম, সেই পথ বাদ দিয়ে ঘন বনের মধ্য দিয়ে জিপিএস দেখে পাহাড় থেকে নামলাম। মাঝখানে নাম না জানা ঝরনায় বিরতি। সমতলে এসে আবার নামলাম মসলা ও ভেষজ বাগানে। এখানে এসে জানলাম, এলাচ ধরে গাছের গোড়া থেকে বের হওয়া ঊর্ধ্বমুখী শিকড়জাতীয় কাণ্ডে, জয়ফল আর জয়ত্রী একই গাছের ফল ও ফুল।

প্রায় ২০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে সন্ধ্যায় পৌঁছালাম কুমারাকম। শহরে ঢোকার মুখে দেখতে পেলাম সারি বাঁধা হাউস বোট আর শিকারা বোট। পরদিন চার ঘণ্টার জন্য ঠিক করলাম একটা শিকারা বোট। বলে রাখা ভালো যে এই হাউসবোটগুলো আসলে হোটেলের মতো, চেক-ইন দুপুর ১২ টায়—ভাড়া এক বেডরুম, দুই বেডরুম ও তিন বেডরুমের যথাক্রমে ৬, ৮ ও ১২ হাজার রুপি। সেদিন ছিল কেরালার স্থানীয় উৎসব অনামের দিন। ফলে আমরা যাত্রাপথে নৌকাবাইচ দেখার সুযোগ পেলাম আর বোনাস হিসেবে দুপুরে ও রাতে ‘সাদিয়া’ নামের কেরালার বিশেষ খাবার। এটা নানা ধরনের সবজি, ডাল, চাটনি, দই, পায়েস ও মিষ্টি—কলাপাতায় পরিবেশন করা হয়।

পরদিন সকাল ১০টায় শুরু হলো আমাদের ব্যাকওয়াটার ভ্রমণ। কেরালার ঐতিহ্যবাহী শিকারা বোটে খাল-নদী পার হয়ে আমরা ছুটলাম ভেম্বানাদ হ্রদের দিকে, যা ভারতের সবচেয়ে দীর্ঘ ও অন্যতম বৃহৎ মিঠাপানির জলাধার। পাশেই কুমারাকম বার্ড স্যানচুয়ারি—বিচিত্র অগণিত পাখির আবাসস্থল। হাউসবোটগুলো এই হ্রদেই পর্যটকদের নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। এখানে বলা দরকার যে প্রতিটি নৌকায় শীতাতপনিয়ন্ত্রিত বেডরুমের সঙ্গে সুসজ্জিত বসার ঘর ও কিচেন থাকে।

আমাদের শেষ গন্তব্য ছিল পোভার, যা কেরালার রাজধানী ত্রিভেন্দাম থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরে আরব সাগরের পাড়ে অবস্থিত। এটি সুন্দর ছিমছাম ছোট্ট শহর, যা কেরালাকে তামিলনাড়ু থেকে আলাদা করেছে। হোটেলে পৌঁছেই আমরা বের হলাম হাওয়া বিচ ও তার পাশে লাইট হাউস বিচের উদ্দেশে। কেরালার অনেক বিচই পাথুরে, ফলে বিচে নামার জন্য হাওয়া বিচই আদর্শ। মালাবার ক্যাফেতে রেড স্ন্যাপার ফ্রাই অর্ডার দিয়ে তাদের ঠিক সামনের বিচে ঘণ্টা দুয়েক গোসল করে খাওয়া শেষে গেলাম লাইট হাউসে উঠতে। এখানে লাইট হাউসে লিফট থাকায় সবারই সুবিধা—ছোট ছোট বাচ্চারাও অনায়াসে উঠে যেতে পারে। লাইট হাউস থেকে সামনে-পেছনে সমুদ্রসৈকত খুবই আকর্ষণীয় দেখায়।

পরদিন আমরা গেলাম শ্বাসমূলীয় পোভার বনে এবং আরব সাগরের গোল্ডেন স্যান্ড বিচ দর্শনে। পোভার অনেকটা আমাদের সুন্দরবনের মতোই—ছোট ছোট খাল দিয়ে স্পিডবোটে এক ঘণ্টা বিভিন্ন প্রজাতির পাখি দেখতে দেখতে হঠাৎ আরব সাগরের সোনালি সৈকত দেখতে পেলাম। সবাই এখানে সূর্যাস্ত দেখতে আসে।

সাত রাত কেরালা ভ্রমণের পর এবার ফেরার পালা। আবার গেলাম কোভালাম সৈকতে। ঘণ্টাখানেক হাঁটাহাঁটি আর পা ভেজানোর পর সাগরপাড়ের রেস্তোরাঁয় দুপুরের খাবার শেষে ঢুকে পড়লাম ত্রিভেন্দাম বিমানবন্দরে। সৌজন্যে : প্রথম আলো

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *