ফেরদৌস জামান
শুভলং ঝরনা, প্যাদা টিং টিং ও আশপাশ ঘুরে দেখার ব্যবস্থা করে দিতে রাঙ্গামাটি শহরে রয়েছে একাধিক টুর অপারেটর। শহরের রিজার্ভ বাজারে গিয়ে পৌঁছতেই ঘিরে ধরল অপারেটরদের বেশ কয়েকজন। মজার ব্যাপার এদের অধিকাংশই নৌকা চালক। কারণ রাঙ্গামাটি ঘুরে বেড়াতে হলে কাপ্তাই লেকে আপনাকে ভাসতেই হবে। আর এ জন্যই নৌকার ব্যবস্থা। দেড় থেকে দুই হাজার টাকায় নৌকা ভাড়া পাওয়া যায়। কয়েক ঘণ্টায় দেখে ফেলা যায় উল্লেখিত স্পটগুলো।
সব দেখাব স্যার, ধীরে ধীরে নৌকা চালাব, লেকের পানিতে সাঁতার কাটা বা গোসল করতে পারবেন- এমন সব লোভনীয় প্রস্তাব উপেক্ষা করে পা বাড়ালাম হোটেলের খোঁজে। আগে রাতে থাকার বন্দোবস্ত করতে হবে। ততক্ষণে ঘাগু অপারেটরদের বুঝতে বাকি রইল না যে, আমরা তাদের টোপ আপাতত গিলছি না। তারপরও তারা নাছোড়বান্দা! পেছনে পেছনে হোটেল পর্যন্ত এলো। এবার তাদের আরেক অফার- স্যার, বুজছি, রাতে লেকে বেড়াতে চান, সমস্যা নাই। সে ব্যবস্থাও আছে। সারা রাত বেড়াতে চাইলে রয়েছে স্পেশাল আয়োজন।
সেই স্পেশাল আযোজনটা কী জানতে ইচ্ছা হলো না। কারণ আমাদের উদ্দেশ্য ভিন্ন। আমরা স্পষ্ট বলে দিলাম, আমরা ওসব শুভলং-টুভলং বা টিং টিং-ফিং ফিং নয়, নৌ-পথে রাঙ্গামাটি থেকে খাগড়াছড়ির মারিশ্যা যাব। ব্যাস, এবার রক্ষা পাওয়া গেল। তারা শুকনো মুখে যে যার রাস্তা খুঁজে নিল।
থাকার জন্য দেখেশুনে এমন একটি হোটেল নির্বাচন করলাম, যে হোটেলের বারান্দা থেকে কাপ্তাই লেক স্পষ্ট দেখা যায়। হ্যাঁ সত্যিই তাই, টলটলে জলের পরশ মাখা বাতাস এসে শরীর-মন অনবরত সতেজ ও চাঙ্গা করে দিচ্ছে। দূর থেকে দেখছি, ছোট নৌকাগুলো জলের বুকে সাঁতার কাটছে। তিরতির করে কোথা্য় যাচ্ছে মাছ ধরার নৌকা। এ দিকে মনের মধ্যে আকুলিবিকুলি করতে থাকল- কখন ওই জলে ভেসে রওনা দেব মারিশ্যার উদ্দেশে। মাঝে প্রতীক্ষা কেবল রাতটুকু। সন্ধ্যার আগে বের হলাম সমস্ত খোঁজখবর নেয়ার জন্য। জানলাম, রিজার্ভ বাজার ঘাট থেকে প্রতিদিন সকাল সাড়ে সাতটায় মারিশ্যার উদ্দেশে ছোট্ট একটি দুইতলা লঞ্চ ছেড়ে যায়।

পথে যেতে যেতে চোখে পড়ল পাহাড়ের এমন দেয়াল
কোনমতে কেটে যায় রাত, ভোরে গিয়ে বসে থাকলাম ঘাটে। লঞ্চের ম্যানেজার বলল, ছাড়তে দেরি আছে, নাস্তা-টাস্তা খেয়ে সকালের শহরটা ঘুরে দেখেন। তার কথা মতো নাস্তা খেয়ে কিছুক্ষণ পর গিয়ে বসলাম জানালার পাশের আসনে। দেখতে দেখতে যাব, কোনো কিছু মিস করতে চাই না! কিন্তু লঞ্চ তো ছাড়ে না! অবশেষে সাড়ে আটটায় লঞ্চ ছাড়ার সময় হলো। ভেতরে বসে না থেকে আসন ছেড়ে সকলেই গিয়ে বসলাম পেছনের খোলা অংশে। সূর্যের আলোয় ছোট ছোট ঢেউয়ের ভাঁজে সোনালি রংয়ের ঝলক, পাখিরা ব্যস্ত মাছ শিকারে, যেদিকে চোখ যায় কেবল পাহাড়ের দীর্ঘ দেয়াল। ধীরে ধীরে দৃষ্টিসীমায় ক্রমশ ছোট হয়ে এলো রিজার্ভ বাজার, আর আমরা হারিয়ে যেতে থাকলাম লেকের জলের স্বচ্ছতায়।

খাগড়াছড়ির পথে যাত্রাবিরতি
কত শুনেছি এই কাপ্তাই লেকের কথা- ঝুলন্ত ব্রিজ আছে, বিদ্যুৎ কেন্দ্র আছে, আরও কত কি! চলতে চলতে প্রবেশ করি ভিন্ন একটি উপজেলায়। হাতের বাম পাশের পাহাড়ের গায়ে স্টিলের শিট কেটে বড় করে লেখা- স্বাগতম বরকল উপজেলা। পাশ দিয়েই উঠে গেছে সরু ট্রেইল। তার খানিক পরেই শুকনো খটখটে হয়ে যাওয়া শুভলং ঝরনা। দূর থেকে শুভলং বাজার দেখে মনে হয় শিল্পীর হাতে আঁকা ছবিটি যেন জলের বুকে ভাসছে। বাজার ঘাটে পনেরো মিনিট যাত্রা বিরতি, কিন্তু বাজার দেখতে নামার সুযোগ মিললো না। সরু মই দিয়ে কেবল যাত্রী ও মালপত্র ওঠানো হলো। এরপর আবার লঞ্চ ছেড়ে দিল। লঞ্চে চায়ের ব্যবস্থা আছে। তেষ্টাও বেশ পেয়েছে। বলার প্রায় ত্রিশ মিনিট পর চা এলো। দেরি হওয়ায় হৃদয় বলছিল- চা আনতে বোধহয় সিলেটের বাগানে গিয়েছে। সেই চায়ে চুমুক দিতেই বুঝলাম, চা তো নয় যেন বুড়িগঙ্গার পানি। লেকের বুকে ভাসছে বাঁশের ভেলার দীর্ঘ সারি, কাগজের কলে সরবরাহের জন্য দূর থেকে বিশেষ পদ্ধতিতে ভাসিয়ে বাঁশ নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এভাবে বাঁশগুলো রাঙ্গামাটি পৌঁছতে নাকি কয়েক সপ্তাহ লেগে যায়।

ঘাট থেকে নেমেই উঠতে হলো এই আজব চান্দের গাড়িতে
ব্রিটিশ ভারতের পূর্ববাংলায় সবচেয়ে বৃহৎ জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের স্বার্থে কাপ্তাইয়ের জলে ডুবে গেছে হাজার হাজার হেক্টর আবাদী জমি। যার ফলে ভিটে মাটি ছাড়া হয়েছে লাখ মানুষ। বিপন্ন ভবিষ্যত নিয়ে কে যে কোথায় চলে গেছে তার ঠিক নেই। বর্তমানে দেশে এককভাবে সর্বাধিক পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয় এই লেকের প্রবাহ থেকে। অথচ বাস্তবতা হলো, লেকের আশপাশের জনগণ আজও পর্যন্ত বিদ্যুতের মুখ দেখেনি। যাই হোক, হঠাৎ লঞ্চ থেমে গেল। শুকনো মৌসুম হওয়ায় পানির গভীরতা কমে গিয়েছে, লঞ্চ আর এগুবে না। অগত্যা মারিশ্যার ঠিক আগে লংগধু থানা ঘাটে নামতে বাধ্য হলাম আমরা।
দিনের আলো থাকতেই পৌঁছতে হবে বোয়ালখালী। সেখানে অপেক্ষায় রয়েছেন থানার এস আই এহতেশাম ভাই, ভ্রমণের মধ্য দিয়েই যার সঙ্গে সখ্য হয়েছে। লংগধু থেকে ভাড়া করতে হলো মোটর সাইকেল। খোঁজ নিয়ে জানলাম, বাইট্টাপাড়া গিয়ে মিলবে চান্দের গাড়ি। আজব বাহন এই চান্দের গাড়ি। এর চেয়েও অধিক আজব সেই গাড়ির চালক। আমরা মোটর সাইকেলে বাইট্টাপাড়া চলে এলাম। এবার উঠতে হবে চান্দের গাড়িতে। কিন্তু পা রাখারই তো জায়গা নেই-এত ভিড়! ছাদে-বাম্পারে মানুষ, সামনের বেয়নেটেও মানুষ ও মালপত্রে ঠাসা। আমি কোনো মতে ছাদে উঠে গেলাম, চালকের ঠিক মাথার ওপর। পা দুটো সামান্য ফাঁক করে ঝুলিয়ে দিলাম; মানে দিতে বাধ্য হলাম সামনের কাঁচের ওপর। সেই সামান্য ফাঁকের মাঝ দিয়ে দেখে দেখে গাড়ি চালাতে লাগল অভিজ্ঞ চালক। বিপজ্জনক পাহাড়ি পথ- এই ওঠা তো এই নামা, এই ডানে তো এই বামে। চন্দ্রবাহন আমাদের নিয়ে চললো তার আপন খেয়াল ও গতিতে। মনের মানুষ নামক জায়গা হয়ে পৌঁছে গেলাম মেরুন বাজার। বাজারে নেমে গেলাম, খেতে হবে। সেখানে খেয়ে অন্য আরেক গাড়িতে চলে এলাম সোজা বোয়ালখালী।
বোয়ালখালীতে থাকার জায়গা হলো সদর ডাকবাংলো। চমৎকার ব্যবস্থা পেয়ে বন্ধুদের চোখেমুখে খুশির জোয়ার। মাঝ রাতে ফলাহারের আয়োজন করেছেন এহতেশাম ভাই। কলা, পেঁপে, কাঁঠাল, আনারস, জাম্বুরা, সবই পাহাড়ি প্রজাতির। এ ছাড়াও জংলী ফল চিনল ও রক্তগুলাসহ আরও অনেক কিছু আছে। রক্তগুলার লাল রসে হাত-মুখ লালে লাল হয়ে গেল! লম্বা একটা ঘুম শেষে শরীরের সমস্ত ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলে সকাল দশটায় ছুটলাম ১০ নাম্বার ঝরনা দেখতে। দিঘীনালা থেকে সাজেক ভ্যালী যাওয়ার পথে অবস্থিত ১০ নাম্বার পুলিশ ক্যাম্প। ক্যাম্পের নাম অনুসারে ঝরনাটার নাম রাখা হয়েছে বা পরিচিতি লাভ করেছে। পথে মিলে গেল সেনাবাহিনীর খাদ্য পরিবহনের একটি জিপ। সেই জিপে উঠে পড়লাম। দয়া করে তারা নামিয়ে দিলেন ঝরনার ট্রেইলের মাথায়। ছড়া পথে ৪৫ মিনিট এগিয়েই মনোমুগ্ধকর ১০ নাম্বার ঝরনা। উপর থেকে নামছে অবিরাম জলের ধারা। জনমানবহীন পাহাড়ি জঙ্গল এই ঝরনার পানি সতেজ করে রেখেছে দিনের পর দিন। এই ঝরনায় সারা বছরই পানি থাকে। দৃষ্টিনন্দন ঝরনাটি প্রকৃতিপ্রেমীদের নজরে এখনও তেমনভাবে আসেনি। বন্ধুরা সবাই পাশ দিয়ে উঠে গেল ঝরনার উৎসের সন্ধানে। আমি একা বসে রইলাম জলের ফোয়ারায়। সূত্র : রাইজিংবিডি