‘ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ট্রাভেলার ফটো কনটেস্ট ২০১৫’-এ দ্বিতীয় হয়েছে বাংলাদেশি তরুণ আলোকচিত্রী ফয়সাল আজিমের ছবি ‘গ্র্যাভেল ওয়ার্কম্যান’ (নুড়িপাথর শ্রমিক)। সারা বিশ্বের ১৭ হাজার ছবির মধ্যে তাঁর তোলা চট্টগ্রামের পাথর ভাঙার শ্রমিকদের মুখচ্ছবি কীভাবে জয় করে নিল আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি? সেই গল্প শোনালেন আলোকচিত্রী ফয়সাল আজিম।
পাথর ভাঙার তিন শ্রমিক। মাথায় গামছা প্যাঁচানো। পরনে মলিন শার্ট। মুখে ধুলার আস্তরণ। চোখের পাপড়িতেও জমেছে ধুলা। চেহারার বলিরেখায় হাড়ভাঙা খাটুনির ছাপ স্পষ্ট। কাচের ওপার থেকে শূন্য দৃষ্টি। কী খুঁজে ফেরে এই তিন জোড়া চোখ? হ্যাঁ, নিজেদের অনিরাপদ জীবন আর বঞ্চনার কথাই যেন বলছে চোখগুলো।
এটি একটি ছবির গল্প। তরুণ আলোকচিত্রী ফয়সাল আজিমের ক্যামেরার ফ্রেমে ধরা পড়ে এই দৃশ্য, চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির পাথর ভাঙার একটি কারখানা থেকে তোলা। শ্রমিকের ঘাম ঝরার ছবি হামেশাই তো তোলা হয়। কিন্তু এখানে কাহিনি ভিন্ন। যুক্তরাষ্ট্রের ‘ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ট্রাভেলার ফটো কনটেস্ট ২০১৫’-এ দ্বিতীয় সেরা হয়েছে এই ছবি। ১৭ হাজারের বেশি ছবির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে বাংলাদেশের ছবিটি স্থান করে নিয়েছে সেরা ছবির তালিকায়।

শ্রমিকের মুখচ্ছবি: ফয়সাল আজিমের তোলা এই ছবি দ্বিতীয় সেরা নির্বাচিত হয়েছে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের প্রতিযোগিতায়
সেই সব মুখচ্ছবি
সময়টা ২০১৪ সালের ১৯ ডিসেম্বর। হাড়কাঁপানো শীত। ভোর পাঁচটায় ব্যাগ গুছিয়ে রওনা হন চট্টগ্রাম শহর থেকে ৩৬ কিলোমিটার দূরের উপজেলা ফটিকছড়ি। পৌঁছাতে পৌঁছাতে সকাল সাতটা। তখনো ঘন কুয়াশা। এর মধ্যেই কর্মচঞ্চল পাথর কারখানা। বিকট শব্দে যন্ত্র ভাঙছে পাথর। শ্রমিকদের ব্যস্ততা। চারদিকে উড়ছে ধুলা। কারখানার কাচের ঘেরা ঘর থেকে ক্যামেরা তাক করলেন ফয়সাল, ক্লিক ক্লিক…। ফ্রেমে ধরা পড়ল তিন শ্রমিকের মুখ।
ফয়সাল বলেন, ‘পাথর ভাঙার শ্রমিকদের কিছু ছবি মনের মতো তোলার চিন্তা ছিল। এদিক-ওদিক খোঁজ করি, পাওয়া যায় না। শেষে পেলাম ফটিকছড়ির এই কারখানা। ছবিটার মুড ও কম্পোজিশন আমাকেও মুগ্ধ করে। তবে এই পর্যায়ে যাবে, তা কখনোই কল্পনা করিনি।’

বৃত্তবন্দী জীবন। ছবি: ফয়সাল আজিম
সেই শ্রমিকদের নামধাম কিছু কি জানা আছে তাঁর? ফয়সাল জানালেন, না মালিকপক্ষের কড়াকড়িতে সেই সুযোগটা আর হয়ে ওঠেনি তাঁর। মাত্র মিনিট দেড়েক সময় পেয়েছিলেন। এর মধ্যে কথা বলার সুযোগ কই?
ফয়সাল আরও জানান, তাঁদের আর খোঁজ পাননি। এই শ্রমিকেরা ছয় মাসের জন্য ভাড়ায় আসেন কারখানায়। এরপর চলে যান অন্য কোনো জায়গায়। কিন্তু বাংলাদেশের অসাধারণ পরিশ্রমী এই সব মানুষের প্রতি তাঁর কৃতজ্ঞতারও শেষ নেই।
ফয়সাল বলেন, ‘ছবিটা তুলতে সময় পেয়েছি মাত্র দেড় মিনিট। কারণ, কারখানায় মালিকের কড়াকড়ি। তাঁদের সঙ্গে ঠিকমতো কথাও বলতে পারিনি। তবে মানুষগুলোকে আমি খুঁজে ফিরব সব সময়। তাঁদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। তাঁদের জন্য আজ এত বড় অর্জন। আমার ছবির আসল নায়ক তো তাঁরাই।’
ভ্রমণ আলোকচিত্র
‘ট্রাভেল ফটোগ্রাফি’ নিয়ে এমনিতেই আগ্রহ ফয়সালের। সে ক্ষেত্রে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ট্রাভেলার ফটো কনটেস্ট একটা বড় পরিসরের প্রতিযোগিতা। এতে অংশ নেওয়ার কথা সব সময়ই মাথায় থাকত তাঁর। কিন্তু জুতসই ছবি না পাওয়ায় এত দিন অংশ নেওয়া হয়নি। এবারই প্রথম অংশ নেওয়া। এই বছরের জুন মাসে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকে ই-মেইলে পাঠিয়ে দেন ছবি। শিরোনাম দেন ‘গ্র্যাভেল ওয়ার্কম্যান’।
এরপর ১৩ জুলাই ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ফটো কনটেস্ট টিম থেকে সেই কাঙ্ক্ষিত ফোন। শুনুন ফয়সালের মুখে, ‘ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক থেকে ফোন করে আমার ছবির মূল ফাইলটি চাইল। আমি পাঠিয়ে দিলাম। মনে কিছুটা আশার সঞ্চার হলো। ছবিটা হয়তো বিচারকদের ভালো লেগেছে। পরে ৩ আগস্ট ওয়েবসাইটে যখন ফলাফল প্রকাশিত হলো, চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। খুব আনন্দ লেগেছে। সবচেয়ে বড় ব্যাপার, আমার নামের সঙ্গে উচ্চারিত হবে বাংলাদেশের নামও।’
প্রতিযোগিতায় জেতা পুরস্কার হিসেবে ফয়সাল পাবেন যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েলো স্টোনে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের একজন আলোকচিত্রীর সঙ্গে ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফিকের সুযোগ। অংশ নেবেন একটি কর্মশালায়। আর পুরস্কার পাওয়া ছবিটি ছাপা হবে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ম্যাগাজিনে।
হিসাবপত্র ছেড়ে ক্যামেরায় চোখ
ফয়সাল আজিমের পড়াশোনা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। বিবিএ ও এমবিএ করেছেন। পাস করে বছর খানেক; চাকরিও করেন ঢাকার একটি বেসরকারি কোম্পানিতে। কিন্তু মন বসে না। ফয়সালের ভাষায়, ‘কেমন যেন শূন্যতা গ্রাস করে। আমার কাজ মনে হয় এটা নয়।’ একদিন সব ছেড়ে আবার চট্টগ্রাম। আবার কাঁধে ক্যামেরা। একেবারে পুরোদস্তুর আলোকচিত্রী, এখন এটাই পেশা। কাজ করছেন ফটোব্যাংক গ্যালারির জ্যেষ্ঠ আলোকচিত্রী ও ফটো আর্ট ইনস্টিটিউটের প্রশিক্ষক হিসেবে।

যাত্রীরা কোথায়? ফয়সাল আজিমের তোলা আরেকটি ছবি
ফয়সাল বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই আলোকচিত্রী হওয়ার স্বপ্ন ছিল। ঘরে আমার মামা শোয়েব ফারুকী নামী আলোকচিত্রী। তাঁকে দেখেই বড় হয়েছি। প্রথম ক্যামেরা হাতে নিই ২০০৩ সালে। তখন আমি উচ্চমাধ্যমিকের ছাত্র। ফিল্ম ক্যামেরায় মায়ের একটি ছবি তুলি। প্রিন্ট করানোর পর সবাই বলল, “ভালো তো”। এই পিঠ চাপড়ানোতে আমিও পড়ে গেলাম ক্যামেরার প্রেমে। ফটো আর্ট ইনস্টিটিউটে কোর্স করি। পড়ার ফাঁকে সময় পেলেই বেরিয়ে পড়তাম ক্যামেরা নিয়ে। শখের বশে শুরু করে এখন পেশা হিসেবে নিয়েছি। এ ক্ষেত্রে আমার মা (হামিদা বেগম) সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা করেছেন। সব সময় প্রাধান্য দিয়েছেন আমার ইচ্ছাকে।’
২০০৯ সালের শেষ দিকে চাকরি ছেড়ে ফয়সাল পুরোপুরি আলোকচিত্রে মন দেন। ফলও পান হাতে হাতে, তিন মাস পর। ২০১০ সালের শুরুর দিকে চ্যানেল আই আয়োজিত আলোকচিত্র-বিষয়ক রিয়েলিটি শো ‘লুমিক্স ক্লিক টু ফেইম’-এ সেরা পাঁচজনের মধ্যে ছিলেন। এই প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে যেন নিজেকে নতুন করে খুঁজে পান ফয়সাল। ২০১২ সালে এসে পুরস্কার জেতেন আন্তর্জাতিক পরিসরে—সংযুক্ত আরব আমিরাতের সপ্তম এমিরেটস ফটোগ্রাফিক কনটেস্ট অ্যাওয়ার্ড। ২০১৩ সালে অর্জন করেন লন্ডনের এটকিনস সিটি স্কেইপ অ্যাওয়ার্ড। ‘লাইফ ইন দ্য সার্কেল’ শিরোনামের ছবির জন্য এই পুরস্কার পান। একই ছবির জন্য ২০১৪ সালে লাভ করেন আশাহি শিম্বুন বিশেষ অ্যাওয়ার্ড। ওই বছর আরবান ফটোগ্রাফার অব দ্য ইয়ার প্রতিযোগিতায় পুরস্কার পান ‘হয়ার আর দ্য প্যাসেঞ্জারস?’ ছবির জন্য। ঈদে নাড়ির টানে বাড়ি ফেরা মানুষের চিত্র ছিল এতে। ২০১২ ও ২০১৪ সালে জেতেন ডেইলি স্টার সেলিব্রিটিং লাইফ অ্যাওয়ার্ড। সব মিলিয়ে দেশে-বিদেশে পেয়েছেন ২৫টি পুরস্কার।
স্বপ্ন বহুদূর…
ফয়সালের ফেসবুকে পেজের কভার ছবিতে রবার্ট ফ্রস্টের কবিতার লাইন, ‘বাট আই হ্যাভ প্রমিসেস টু কিপ/ অ্যান্ড মাইলস টু গো বিফোর আই স্লিপ’। এই লাইন দুটি সব সময় কানে বাজে ফয়সালের। ভাবেন, এখনো অনেক পথ বাকি। পাড়ি দিতে হবে বহুদূর। সূত্র : প্রথম আলো