বৈচিত্র্যময় নানা স্থান এবং ষোড়শ শতকের সাংস্কৃতিক রাজধানী খ্যাত কিশোরগঞ্জ। নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর ঐতিহ্যবাহী সব স্থাপনা আপনাকে মোহিত করবে। জানাচ্ছেন— আহমেদ তানভীর, ছবি : আবু হুরায়রা।
ভাটি অঞ্চলের জেলা কিশোরগঞ্জ। ঈশা খাঁর স্মৃতিবিজড়িত, নরসুন্দা নদীবিধৌত, হাওর অধ্যুষিত, গ্রাম বাংলার শাশ্বত রূপবৈচিত্র্য ও সোনালি ঐতিহ্যের ধারক কিশোরগঞ্জের রয়েছে সমৃদ্ধ পুরাণ, কৃষ্টি ও সংস্কৃতি। আর সময় এখন বর্ষার। প্রকৃতি এখন সেজেছে ঝুম বর্ষার এক অপূর্ব মেলবন্ধনে। তাই তো ভ্রমণপ্রিয় মানুষের অবকাশ যাপনে ঢাকার কাছাকাছি ঐতিহ্য আর প্রাকৃতিক হাওরাঞ্চল কিশোরগঞ্জের বৈচিত্র্যময় নানা স্থানই হতে পারে ভ্রমণবিলাসীদের আদর্শ। প্রাণের আশ মিটিয়ে বেড়াতে একটু সময় নিয়ে ঘুরে আসা ভালো।
ঐতিহাসিক জঙ্গলবাড়ী
ঈশা খাঁর দ্বিতীয় রাজধানী। হাজরাদী পরগনার জঙ্গলবাড়ীতে ঈশা খাঁ তার দ্বিতীয় রাজধানী স্থাপন করেন। অনুপম স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত তিন গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ, দরবারগৃহ ও পরিখাবেষ্টিত দুর্গের ধ্বংসাবশেষ উজ্জ্বল অতীতের স্মৃতি বহন করে। কিশোরগঞ্জ শহর থেকে ৬ কিলোমিটার পূর্বে করিমগঞ্জ উপজেলার কাদির জঙ্গল ইউনিয়নে জঙ্গলবাড়ীর অবস্থান। জেলা সদরের একরামপুর মোড় থেকে অটোরিকশা বা পা-চালিত রিকশায় যাওয়া সহজ।
ঐতিহাসিক এগারসিন্দুর দুর্গ
এটি মোগল সেনাপতি মানসিংহের সঙ্গে ১৫৯৫ খ্রিস্টাব্দে সংঘটিত ঈশা খাঁর ঐতিহাসিক যুদ্ধের স্মৃতিবাহী যুদ্ধক্ষেত্র। বর্তমানে এই দুর্গের ধ্বংসাবশেষ ছাড়াও নিরগীন শাহ্, শাহ্ গরীবুল্লাহর সমাধি, শাহ মাহমুদের মসজিদ ভিটা ও বালাখানা অবস্থিত যা আজও কালের সাক্ষ্য বহন করে। ব্রহ্মপুত্র নদের বাঁকে অবস্থিত এ এলাকাটি ষোড়শ শতাব্দীতে প্রসিদ্ধ নৌবন্দর হিসেবে খ্যাত ছিল। পাকুন্দিয়া উপজেলার এগারসিন্দুর ইউনিয়নে এর অবস্থান। জেলা সদর থেকে দূরত্ব ৩০ কিলোমিটার। যাওয়ার মাধ্যম বাস ও অটোরিকশা।
সুকুমার রায়ের বাড়ি
বিখ্যাত ছড়াকার ও শিশুসাহিত্যিক সুকুমার রায়ের পৈতৃক বাড়ি। এটি কটিয়াদি উপজেলার মসুয়া গ্রামে অবস্থিত। জেলা শহরের বত্রিশ সিএনজি স্টেশনের পথ পাড়ি দিয়ে বাকি পথ রিকশায় যাওয়া যায়।
কবি চন্দ্রাবতীর শিবমন্দির
বঙ্গের আদি মহিলা কবি চন্দ্রাবতীর স্মৃতিবিজড়িত মন্দির। ষোড়শ শতকের মনসা মঙ্গল কাব্যের বিখ্যাত কবি দ্বিজ বংশীদাসের কন্যা ও বঙ্গের আদি মহিলা কবিরূপে খ্যাত চন্দ্রাবতীর বহু কাহিনী সমৃদ্ধ এ মন্দিরটি খ্রিস্টীয় ষোড়শ শতাব্দীতে নির্মিত। কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার মাইজখাপন ইউনিয়নের কাচারীপাড়া গ্রামে ফুলেশ্বরী নদীর তীরে কবি চন্দ্রাবতীর সুবিখ্যাত শিবমন্দিরটির অবস্থান। কিশোরগঞ্জ শহর থেকে দূরত্ব ৬ কিলোমিটার।
ঐতিহাসিক পাগলা মসজিদ
আধুনিক স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত পাগলা মসজিদটি ঐতিহাসিক ও দর্শনীয় স্থাপনা হিসেবে খ্যাত। জনশ্রুতি আছে, পাগলবেশী এক আধ্যাত্মিক পুরুষ খরস্রোতা নরসুন্দা নদীর মধ্যস্থলে মাদুর পেতে ভেসে এসে বর্তমান মসজিদের কাছে স্থিতু হন এবং তাকে ঘিরে অনেক ভক্ত সমবেত হন। পাগলের মৃত্যুর পর তার সমাধির পাশে মসজিদটি গড়ে ওঠে বলে কালক্রমে এটি পাগলা মসজিদ নামে পরিচিত হয়। মসজিদটি প্রায় সব ধর্মাবলম্বীর কাছে অত্যন্ত পবিত্র ধর্মীয় কেন্দ্র হিসেবে পরিগণিত। মসজিদটি শহরের হারুয়া এলাকায় অবস্থিত। শহরের যে কোনো স্থান থেকে রিকশায় সহজেই যাওয়া যায়।
শোলাকিয়া ঈদগাহ
এশিয়া মহাদেশের সর্ববৃহৎ ঈদগাহ শোলাকিয়া ঈদগাহ সর্বজনবিদিত। এ ঈদগাহে ঈদের জামায়াতে প্রায় তিন লাখ মুসল্লি পবিত্র ঈদের নামাজ আদায় করে থাকেন। কথিত আছে, বহু বছর আগে এই ঈদগাহের একটি জামাতে সোয়া লাখ মুসল্লির সমাগম ঘটেছিল। এ সোয়া লাখ শব্দটিই পরবর্তীতে ‘শোলাকিয়া ঈদগাহ’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। শহরের যে কোনো স্থান থেকে রিকশায় খুব সহজেই শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানে যাওয়া যায়।
দৃষ্টিনন্দন লেকসিটি
শত সহস্র বছরের নানা ঐতিহ্যের প্রাণকেন্দ্র কিশোরগঞ্জে সম্প্রতি গড়ে উঠেছে দৃষ্টিনন্দন লেকসিটি। শহরের ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ গুরুদয়াল সরকারি কলেজের পূর্বপাশে বিস্তৃত এলাকায় অবস্থিত এ লেকসিটির অংশ হিসেবে রয়েছে মুক্তমঞ্চ, একাধিক নান্দনিক সেতু, মিনি পার্ক ও ওয়াচ টাওয়ার। পড়ন্ত বিকেলের হলুদ আলো আর ফুরফুরে হাওয়ায় লেকসিটিতে ঘুরে-ফিরে সময় কাটালে নিঃসন্দেহে মন্দ লাগবে না।
হাওর অঞ্চল
কিশোরগঞ্জ জেলার ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রাম উপজেলার হাওরাঞ্চলের দৃশ্য বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে হাওরের দৃশ্য খুবই মনোমুগ্ধকর। হাওর অঞ্চলের বিস্তীর্ণ বৈচিত্র্যের অপূর্ব লীলাভূমি দেখে সবাই আকৃষ্ট হয়। আর তাই এ হাওরাঞ্চল দিন দিন পর্যটক ও ভ্রমণবিলাসীদের বেড়াবার এক অন্যতম পছন্দের এলাকা হয়ে উঠেছে। হাওরে যেতে হলে জেলা সদরের সতাল-চামড়া বাসস্ট্যান্ড থেকে বাসে করে চামড়া বন্দর পৌঁছে সেখান থেকে ট্রলারে যেতে হবে।
এ ছাড়াও কিশোরগঞ্জ জেলা শহরের আশপাশে ঘুরে দেখতে পারেন বৌলাই জমিদার বাড়ি, মিঠামইন উপজেলায় অবস্থিত সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে প্রতিষ্ঠিত মোগল স্থাপত্যশৈলীর অন্যতম নিদর্শন দিল্লির আখড়া।
আবাসন ও রেস্তোরাঁ
কিশোরগঞ্জ শহরে বেশকিছু অভিজাত আবাসিক হোটেলে আবাসনের সুব্যবস্থা রয়েছে। ক্যাসেল সালাম ইন, হোটেল রিভারভিউ, হোটেল গাংচিল, হোটেল উজানভাটির মধ্যে আপনার পছন্দসই যে কোনো একটি আবাসিক হোটেলে রাতযাপন করতে পারেন। স্বল্প খরচে বিভিন্ন স্বাদের মানসম্মত দেশি খাবার খেতে বেছে নিতে পারেন ইষ্টিকুটুম, ধানসিঁড়ি, গ্রামবাংলা, গাংচিল, ময়নামতি, মাছরাঙার মতো রেস্তোরাঁগুলোকে। আর হ্যাঁ, কিশোরগঞ্জে বেড়াতে এলে এখানকার প্রসিদ্ধ রসমালাই খেতে ভুলবেন না যেন! এর অতুলনীয় স্বাদ আপনার স্মৃতিতে অনেক দিন জাগিয়ে রাখবে ঐতিহ্যের কিশোরগঞ্জকে। সৌজন্যে: বাংলাদেশ প্রতিদিন