Skip to content

পঞ্চবটি

সাভারের নামাবাজার। পাঁচ বট মিলে একটি গাছ। লোকে ডাকে পঞ্চবটি। বহুকাল ধরে বহু ঘটনার সাক্ষী। দেখতে গিয়েছিলেন মাসুম সায়ীদ

মাঝ রাত। নিঝুম চার ধার।

জেগে আছি আমি। কারণ আমার ঘুম দরকার হয় না। আশ্বিন মাসের দুর্গাপূজা থেকে কার্তিক মাসের কালীপূজায় আমার এখানে মেলা চলে। তখন জায়গাটা থাকে সরগরম। বয়সীদের ভুলে ভরা জীবন। অল্প বয়সীরা আসে বুকভরা আশা নিয়ে। বলা ভালো, ভক্তদের ঢল নামে। দোকানিদের হাঁকডাকও শোনা যায় জবর। আর এমনিতে নিরলেই থাকি। পাখিরা ডেকে যায় শুধু।

জন্মস্থান আর চারপাশ
নদীর মরণ তখনো এমন করে ঘনায়নি। প্রায় বারো মাসই থইথই করে জল। চলতে চলতে বংশী নদী হঠাৎ একটা খাল বেয়ে উঠে এসেছিল ডাঙার দিকে ঘোড়ার খুরের আকার নিয়ে। খালটা এগিয়ে গেল আরো খানিকটা সামনে। মাঝে রয়ে গেল একটা মাটির ঢিবি মাথা উঁচু করে। এই হার না-মানা ঢিবিটাই হলো আমার বাড়ি। উত্তরে খাল পেরোলে কোটবাড়ি। কেউ বলে রাজা

হরিশচন্দ্রের, কেউ বলে কর্ণ খাঁর দুর্গ। দূর থেকে পাহাড়ের মতো মনে হতো। পশ্চিম আর দক্ষিণ পাশটা জুড়ে বাজার। একদম নদীর গা ঘেঁষে। তাই লোকে নাম দিয়েছে নামাবাজার। শনি আর মঙ্গলবার এখানে হাট বসে। দশ গাঁয়ের লোক এসে জমা হয় হাটবারে। শুধুই কি হাট! রীতিমতো বন্দর এটা। দক্ষিণের সেই সন্দ্বীপ, চন্দ্রদ্বীপ থেকে নারায়ণগঞ্জ ছুঁয়ে জাহাজ এসে ভিড়ত এখানে। আসত পাল তুলে মহাজনী নাও সারিবেঁধে। উত্তরে কালীগঙ্গা আর ধলেশ্বরী বেয়ে লঞ্চ আসত গোয়ালন্দ থেকেও। মাঝিমাল্লার হাঁকডাক আর ঢেউয়ের দাপানিতে মুখর থাকত সারাক্ষণ। প্রতি নীল সন্ধ্যায় মাঝিমাল্লাদের তোলা উনুনের রান্নার ধোঁয়া এসে লাগত আমার গায়ে। বন্য লতা-পাতা, শিকড়-বাকড় কবিরাজপাড়ার মাধাই দাশ,

প্রফুল্লচন্দ্র, সুধাংশু কবিরাজের হামানদিস্তায় পিষ্ট হয়ে শুকনো ঘুঁটে আর তুষের আগুনের জ্বালে হালুয়া আর শালসা হয়ে ছড়িয়ে পড়ত সারা দেশে। এমনকি গোয়ালন্দ থেকে লঞ্চে করে কলকাতায়। তাদের মালমসলার জোগান দিতে হিমশিম খেত দোকানি পোদ্দার।

ফেলে আসা দিন
এক কিশোর একবার তিন আনা নিয়ে হাটে এসেছিল বাজারসদাই করতে। পাকা খেজুরের মস্ত একটা কাঁদি দেখে লোভ সামলাতে পারল না। তিন আনায় সেটা কিনে ছুটছে বাড়ির দিকে। বাড়ি ফিরে যে বকা খেতে হবে, সে হুঁশ নেই। পশ্চিম পাশে পানি পেরিয়েই খলিফাপট্টি। দর্জিকে লোকেরা বলত খলিফা। এখন তো দর্জিও বলে না, বলে টেইলার্স। আর এখানেই বা আসবে কেন এখন? যায় মার্কেটে। ভূতের ভয় কাটিয়ে কোটবাড়িতে কেউ কেউ বাড়িঘর তোলা শুরু করল। গ্রাম থেকে পরিবার-পরিজনসহ উঠে এসে ঘানি পাতল মোহাম্মদ আবুল হোসেন। তেল তাঁর খাঁটি। স্বাদে আর গন্ধে আলাদা। তাঁর তেল ছাড়া ভাজি-ভর্তায় মন ভরবে কেন দশ গাঁয়ের লোকের! ভিড় লেগে থাকত তাঁর ঘানির কাছে। হাটবারে পড়ত লাইন। রসগোল্লা আর লালমোহনে কালি সাহার নাম মুখে মুখে সবার। শুধু সাধারণ গ্রাহকই নয়, বালতি হাতে করে সকাল-সকাল এসে হাজির হতো ফেরিওয়ালারা। বালতি ভরে রসগোল্লা চলে যেত গঞ্জ থেকে শহরে।

ব্রহ্মচারী সাধু
এক সন্ধ্যায় সংসারবিবাগী এক সাধু এসে হাজির। গেরুয়া বসন আর হাতে ত্রিশূল। কাঁধে একটা পোঁটলা। উৎপাত এড়াতে তিনি আস্তানা পাতলেন আমাদের বড় দুই ডালের আড়ে। সাপখোপের ভয়ে কেউ আমাদের খোড়লযুক্ত কাণ্ড বেয়ে উঠতে সাহস করত না। সাধুর আবার ভয় কী? নির্বিঘ্নেই তিনি আসন পাতলেন। কোল দিলাম তাঁকে। দেখতে দেখতে কিছু ভক্তও জুটে গেল। বাড়তে থাকল লোকজনের আনাগোনা।

সিনেমা হল
একদিন শোরগোল শোনা গেল দক্ষিণের ভিটায়। বৃত্তান্ত শুনতে সময় লাগল না খুব একটা। মাসখানেক ধরে গুদামের মতো বড় যে ঘরটা হচ্ছিল, শোরগোলটা তাকে ঘিরেই। ওটা আসলে গুদামঘর নয়, সিনেমা হল। সিনেমাকে কেউ বলে টকি, কেউ বলে বই। বই দেখতে লোকের উৎসাহ আর আনন্দের সীমা নেই। নতুন নতুন সিনেমা আসে আর তার গল্প চলে আমার ছায়ায়।

একাত্তরের দিনগুলো
এক রাতে হঠাৎ মহা শোরগোল ভেসে এলো বাতাসে। ভয় আর আর্তচিৎকারের। তারপর বাতাসে রক্ত, লাশ আর বারুদের গন্ধ। নদীতেও ভেসে আসে লাশ সময়ে। সিনেমা হলে আগুন লাগল। কিছু দোকানপাট পুড়ল। লুটও হলো। লোকেরা পালাল দিগ্বিদিক। সাধু গিয়ে আশ্রয় নিলেন নদীর পশ্চিমে। টানা সাড়ে ৯ মাস। দেশ স্বাধীন হলো। বাতাসে লাল-সবুজ পতাকা উড়ল। নামাবাজারের প্রাণ ফিরতে লাগল ধীরে ধীরে। সিনেমা হল চালু হলো। সাধু ফিরে এলেন আবার। তবে বোধ করি কিছু শত্রু নিয়ে। জমাট অন্ধকারের এক রাত। কে বা কারা জানি না। বিড়ালের মতো নিঃশব্দ পায়ে এসে হাজির হলো। কিছু বুঝে ওঠার আগেই সব কিছু শেষ হয়ে গেল। সাধু মারা পড়লেন।

বিস্তারিত জানতে ছবিতে ক্লিক করুন।

ভালোবাসা মরে না
মানুষ মরে যায় কিন্তু ভালোবাসা মরে না। সাধুকে ভালোও বাসত লোকে। সত্যিকারে, মন থেকে। তাঁর স্মরণে উঠল মন্দির উঁচু চূড়া নিয়ে। পাশে টিনের চালার নাটমন্দির। মন্দিরের চূড়া আমার বুকসমান। দূর থেকে দেখলে মনে হয় মায়ের বুকে খোকা।

ওই দেখো, খলিফাপট্টিতে বিয়ের কাপড় বানাতে দিয়ে বসে আছে সেই কিশোর। বাজারসদাই বাদ দিয়ে খেজুর কিনে একদিন যে বকা খেয়েছিল, আজ সে ইঞ্জিনিয়ার।

মন্দিরের ঘণ্টা শুনি সকাল-সন্ধ্যায়। আরতিতে ভক্তিভরা নামজপ—হরে কৃষ্ণ, হরে কৃষ্ণ। কৃষ্ণ কৃষ্ণ, হরে হরে। ঝড়ঝাপটাও কম যায়নি আমার ওপর দিয়ে। তুফানের কথা বাদ। মানুষও কেটেছেঁটে দমিয়ে রেখেছে আমাকে। তবে মন্দিরটা বাঁচিয়ে দিয়েছে আমাকে। পুরো এলাকাটা এখন আশ্রম। রামকৃষ্ণ মন্দির ছাড়াও এখানে আছে দেবী দুর্গা, দেবতা শনি ও ব্রহ্মার স্থায়ী মন্দির। মহাকালীর পূজা হয়। আশ্রম না থাকলে আমার মূল উপড়ে কবেই এখানে দালান হতো! সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *