রবিঠাকুরের বিশ্বভ্রমণ তার জীবন বৈচিত্র্যের অন্যতম উপাদান হিসেবে যোগ হয়। মূলত ১৯১৩ সালে নোবেল প্রাপ্তির পর থেকেই তিনি বিশ্বভ্রমণে আগ্রহী হয়ে উঠেন।
নোবেল প্রাপ্তি অনন্য গৌরব অর্জনের পর সারা বিশ্বেই তিনি সমাদৃত হন এবং বিভিন্ন দেশ থেকে তাকে আমন্ত্রণ জানানো শুরু হয়। এসব আমন্ত্রণে সাড়া দিয়েই তিনি জাহাজযোগে বহু দেশ ভ্রমণ করেছেন। বিশ্বভ্রমণে তিনি দেখা করেছেন বিখ্যাত ব্যক্তিদের সঙ্গে।
এ সময় তিনি বহু স্থানে, বহু বিদ্যায়তনে, বহু সভায় স্বকণ্ঠে কবিতা পাঠ করে শুনিয়েছেন। তার বক্তৃতা সম্মোহনে মুগ্ধ হয়েছে অসংখ্য মানুষ। বিশ্বজুড়ে তার সমাদর হয়। বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের জীবনোপলব্ধি ও দর্শন মানুষের হৃদয় জয় করেছে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে তার কাব্যের মর্মবাণী পৌঁছেছে অনন্য গৌরবে।
১৮৭৮ থেকে ১৯৩২ সাল পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পাঁচটি মহাদেশের তেত্রিশটিরও বেশি দেশ ভ্রমণ করেছিলেন। তবে ইংল্যান্ড ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাদ দিলে অন্য দেশসমূহ ভ্রমণ করেছেন ১৯১৩-তে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির পর।
দেশগুলো হলো- ফ্রান্স, হংকং, চীন, বেলজিয়াম, সুইজারল্যান্ড, জার্মানি, ডেনমার্ক, সুইডেন, অস্ট্রিয়া, চেকোশ্লোভাকিয়া, আর্জেন্টিনা, ইতালি, নরওয়ে, হাঙ্গেরি, যুগোশ্লাভিয়া, বুলগেরিয়া, রুমানিয়া, গ্রিস, মিসর, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, জাপান, বার্মা, হল্যান্ড, সোভিয়েত রাশিয়া, ইরান, ইরাক ও শ্রীলঙ্কা। ১৯৩৪ এ শ্রীলঙ্কা (সিংহল) ভ্রমণ শেষে কবি শান্তিনিকেতনে ফেরেন ২৮ জুন।
এরপর তিনি আর বিদেশ ভ্রমণে যাননি। এ ভ্রমণগুলোর মধ্যে অনেকগুলোই রবীন্দ্রনাথের জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তার বিদেশ ভ্রমণ শুরু হয় ১৮৭৮ সালে প্যারিস হয়ে লন্ডন গমনের মাধ্যমে। ১৯১২ সালের ২৭ মে রবীন্দ্রনাথ যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য ভ্রমণে বের হন। লন্ডনে মিশনারি তথা গান্ধীবাদী চার্লস এফ অ্যান্ড্রুজ, অ্যাংলো-আইরিশ কবি উইলিয়াম বাটলার ইয়েটস, এজরা পাউন্ড, রবার্ট ব্রিজেস, আর্নেস্ট রাইস, টমাস স্টার্জ মুর প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তি তার গুণমুগ্ধে পরিণত হন।
১৯১৬ সালের ৩ মে থেকে ১৯১৭ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রে বক্তৃতা দিয়ে বেড়ান।
ভারতে প্রত্যাবর্তনের অব্যবহিত পরেই ৬৩ বছর বয়সী রবীন্দ্রনাথ পেরু সরকারের কাছ থেকে পেরু ভ্রমণের একটি আমন্ত্রণ পান। পেরু থেকে তিনি যান মেক্সিকোতেও। ১৯২৭ সালের ১৪ জুলাই দুই সঙ্গীকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চার মাসব্যাপী সফরে বের হন। ১৯৩০ সালের জুন থেকে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত তিনি ডেনমার্ক, সুইজারল্যান্ড ও জার্মানি পর্যটন করেন। এরপর যান সোভিয়েত ইউনিয়নে। পারসিক কবি হাফিজের কিংবদন্তি ও রচনার গুণমুগ্ধ ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ১৯৩২ সালের এপ্রিলে জীবনের শেষপর্বে তিনি তাই যান ইরানে। এ ভ্রমণের সময়ই তিনি সফর করেন ইরাক (১৯৩২) ও সিংহল (১৯৩৩)।
জীবনের শেষার্ধব্যাপী এ বিশ্বভ্রমণে রবীন্দ্রনাথ আলবার্ট আইনস্টাইন, রবার্ট ফ্রর্স্ট, টমাস মান, জর্জ বার্নার্ড শ, এইচ জি ওয়েলস ও র’মা রঁলা প্রমুখ সমসাময়িক যুগের বিশিষ্ট বহু ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। সূত্র : বাংলাদেশ প্রতিদিন