গত পহেলা জানুয়ারি থেকে শুরু হয়েছে ‘পর্যটন বর্ষ ২০১৬’। বিশ্বদরবারে বাংলাদেশকে পর্যটনের একটি সম্ভাবনাময় গন্তব্য হিসেবে পরিচিত করে তুলতে সরকার যে মহাপরিকল্পনা নিয়েছে, এর অংশ হিসেবে ‘ভিজিট বাংলাদেশ’ নামে উদযাপিত হবে পর্যটন বর্ষ। এ নিয়ে মুখোমুখি হয়েছেন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন। সাক্ষাত্কারটি নিয়েছেন রিয়াদ খন্দকার
‘পর্যটন বর্ষ’ নিয়ে আপনাদের বর্তমান কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে চাই।
২০১৬ সালকে পর্যটন বর্ষ হিসেবে ঘোষণা করেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। বছরের শুরুতেই কক্সবাজারে বিচ কার্নিভালের মাধ্যমে আমরা এই কার্যক্রম শুরু করেছি। আমাদের মূল লক্ষ্য হলো দেশের পর্যটন কেন্দ্রগুলোকে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরা।
যেমন—কক্সবাজার, বান্দরবান, সুন্দরবন, কুয়াকাটা। এছাড়া আমাদের কিছু নতুন পরিকল্পনা রয়েছে, যেমন বরিশালে ‘ব্যাকওয়াটার ট্যুরিজম’-এর ব্যবস্থা করা। এতে নদীতে নৌকার উপরে বিভিন্ন জিনিস বিক্রয়ের ব্যবস্থা থাকবে। বাইরের অনেক দেশেই এমন ব্যবস্থা রয়েছে, যা এখন বাংলাদেশেও করতে চাচ্ছি। এছাড়া কমিউনিটি ট্যুরিজম নিয়ে আমাদের কাজ করার ইচ্ছা রয়েছে। বিভিন্ন দেশের মানুষ এসে এখানে থাকবে, আমাদের জীবনযাত্রার সঙ্গে পরিচিত হবে, শিল্প-সংস্কৃতি-কৃষ্টির সঙ্গেও পরিচিত হবে। এই দুই ধরনের ব্যবস্থার সূচনা করতেই মূলত আমরা কাজ করে চলেছি। এরমধ্যে আমরা কক্সবাজারকে ডেসটিনেশন প্রমোশনের মধ্যে ফেলেছি। তারপর বান্দরবানে আমরা এশিয়া প্যাসিফিক টুরিস্ট এজেন্সির সঙ্গে কিছু কাজ করছি পর্যটক বাড়ানোর জন্য। এছাড়া সুন্দরবনের পরিবেশ আরও উন্নত করার জন্য এবং সেখানে ঘুরতে যাওয়ার জন্য গাইড ট্যুরের ব্যবস্থা করছি। এই এপ্রিলের ২ তারিখ থেকে এই ব্যাপারে কাজ শুরু হবে। আর কুয়াকাটাতে বর্ষা মৌসুমে বর্ষাবরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করার উদ্যোগ নেওয়া হবে। আর একটি পদক্ষেপ আমরা নিচ্ছি সেটা হলো ওশান ক্রু। এই বছরের এপ্রিলে আমেরিকার সিলভার ক্রু কোম্পানি আসবে চট্টগ্রামে। আগামী বছর নাগাদ আমরা এই সুবিধা চালু করতে পারব বলে আমার বিশ্বাস। প্রকৃতপক্ষে, প্রতিটা পর্যটন স্থানের স্বকীয় বৈশিষ্ট্য রয়েছে এবং আমরা সেগুলোকে ব্যবহার করেই প্রমোশনের ব্যবস্থা করতে চাচ্ছি। ২০১৬ সালকে পর্যটন বর্ষ ঘোষণা করা হলেও আমাদের এই পর্যটন বিষয়ক কার্যক্রমগুলো অব্যাহত থাকবে ২০১৮ সাল পর্যন্ত। এই বছরের শেষ দিকে আমরা আশা করছি প্রায় ১০ লক্ষ পর্যটককে আকৃষ্ট করতে সক্ষম হবো।
বিদেশি পর্যটকরা কেউ এককভাবে বাংলাদেশ ভ্রমণে আসতে চান না, পুরো এশিয়া ভ্রমণের একটি অংশ হিসেবে এখানে আসেন। এই ব্যাপারে কী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে?
এ বিষয়টি পর্যটন বর্ষ পালনের পিছনে অন্যতম কারণ ছিল। আমরা দূরের পর্যটক নয়, বরং আমাদের কাছাকাছি দেশগুলো যেমন ভারত, ভিয়েতনাম, শ্রীলঙ্কা এসব দেশের পর্যটকদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছি। এই ব্যাপারে আমরা বেশ কিছু কনফারেন্সে অংশগ্রহণ করছি। আমরা সেখানে যাচ্ছি, আমাদের গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনগুলো তুলে ধরছি। এই ব্যাপারে আমরা আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোর ট্যুর অপারেটরের সঙ্গে কিছু চুক্তিতে আসার চেষ্টা করছি। যেমন কেউ যদি মিয়ানমারে ৩ দিন থাকেন তো বাংলাদেশেও ৩ দিন থাকবেন, এ বিষয়টি অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। আর আমাদের নিজেদের ব্যবস্থা হিসেবে আমরা চেষ্টা করছি আভ্যন্তরীণ পর্যটন শিল্পকে উন্নত করতে। টাঙ্গাইলে আমরা কমিউনিটি ট্যুরিজমের ব্যবস্থা করছি। সেখানে জাপান, চীন ইত্যাদি বিভিন্ন দেশ থেকে মানুষ আসেন। তারা এই গ্রামের মানুষের সঙ্গে মিলেমিশে থাকছেন, কারো সঙ্গে ক্ষেতে কাজ করতে যাচ্ছেন, কারো সঙ্গে ধান ভানছেন। মোটকথা আমাদের সমাজ ও সংস্কৃতিকে তারা জানার ও চেনার চেষ্টা করছেন। এটাকে আমরা বিস্তৃত করার চেষ্টা করছি।
পর্যটন শিল্পের বিকাশে প্রচারণার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। অন্যান্য দেশে পর্যটন শিল্প নিয়ে যে পরিমাণ প্রচার-প্রচারণা দেখা যায়, আমাদের দেশে তা খুব একটা দেখা যায় না। এ বিষয়ে আপনার বক্তব্য জানতে চাচ্ছি?
ক্যাম্পেইনিং গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু এর জন্য যে পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন তা বরাদ্দ করা হয় না। আমরা বাজেটের জন্য আবেদন করি কিন্তু কাজ হয় না। আমরা ২০০ কোটি টাকার আবেদন করেছিলাম, আমরা পেয়েছি মাত্র ৬৭ কোটি টাকা। এই স্বল্প পরিমাণ টাকা দিয়ে তো আসলে কাজ করাই দুষ্কর হয়ে পড়ে, ক্যাম্পেইন তো দূরের কথা। আমাদের এখন প্রয়োজন বিজ্ঞাপন দেওয়ার, সিএনএন, বিবিসি ইত্যাদি চ্যানেলে। কিন্তু সেটা করা সম্ভব হচ্ছে না। আমি বিজ্ঞাপনের জন্য যেখানেই যাই আমাকে তো টাকা দিতে হবে। চ্যানেলগুলো একদিন হয়তো সৌজন্যতার খাতিরে বিনামূল্যে করতে পারে। সব সময় তো করবে না।
সরকার অন্যান্য ক্ষেত্রগুলোকে যেমন ডিজিটালাইজেশনের আওতায় আনার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, তেমন কোনো পরিকল্পনা পর্যটন খাতের জন্য রয়েছে কি না?
এই ব্যাপারে আমাদেরই প্রথম উদ্যোগ ছিল। বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনকে পুরোপুরি ডিজিটালাইজড করা। পর্যটন কর্পোরেশনের যেকোনো হোটেলে আপনি এখন অনলাইনে বুকিং করতে পারবেন। এছাড়া আমরা এয়ারটেলের সঙ্গে মিলে কক্সবাজারকে সার্ফিং সিটি হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করছি, যেখানে পুরো এলাকাই ওয়াই ফাই জোন করা হবে। সেজন্য আমাদের তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে। প্রাইভেট সেক্টরে যারা আছে, তাদেরকেও আমরা উত্সাহিত করছি বিনিয়োগের জন্য। আপনি যদি বলিভিয়া যান, দেখবেন অগণিত রিসোর্ট। ঢাকার আশপাশেও কিন্তু প্রচুর রিসোর্ট রয়েছে। এই ব্যাপারে প্রাইভেট খাতকে এগিয়ে আসতে হবে।
কিছুদিন আগে পর্যটন খাতে নিজের ক্যারিয়ার গড়ার কথা কেউ চিন্তাও করতে পারত না, এখন এই সেক্টরে ক্যারিয়ার গড়ার সুযোগ বেড়েছে। এ বিষয়ে আপনাদের নেওয়া পদক্ষেপগুলো জানতে চাই।
অবশ্যই। এখন অনেকে এই ক্ষেত্রে কাজ করছে এবং আমাদের হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট আরও উন্নত করার জন্য সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ দেওয়ার কর্মকাণ্ড শুরু হয়েছে। এছাড়া গাইড হিসেবেও প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে অনেক জায়গায়। গাইড কিন্তু খুবই ভালো একটা প্রফেশন। যারা গাইড হিসেবে কাজ করে তারা দেখা যায় পরবর্তীতে ট্যুর অপারেটর হয়ে যায়। এই প্রশিক্ষণ সেন্টারগুলোকে আরও বিস্তৃত করার জন্য আমরা প্রাইভেট সেক্টরগুলোকে উদ্যোগ নিতে বলছি।
প্রাইভেট সেক্টরে যারা এই খাতে কাজ শুরু করছে, সেই তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য প্রথম ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সুবিধা হিসেবে আমরা অর্থ সাহায্য করব। এছাড়া আরও কোনো ধরনের সুবিধা দরকার হলে আমরা তাদের পাশে আছি। এই ব্যাপারে আমাদের সরকারের সঙ্গে কথা হয়েছে। তবে নতুন উদ্যোক্তারা কে কেমন ধরনের সুবিধা চান সেটা তাদের সঙ্গে কথা বলে জানতে হবে। একেকজনের চাহিদা একেকরকম, তবে আমরা সকল ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিয়ে পাশে থাকার চেষ্টা করব। সৌজন্যে : ইত্তেফাক