দীপঙ্কর রায়
হাওড়া থেকে শতাব্দী এক্সপ্রেস ধরে রাত প্রায় ১১টার সময় নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন। সেখানে নেমে শিলিগুড়ির প্রধাননগরে কোনোরকমে রাতটুকুর জন্য মাথা গোঁজার একটা আশ্রয় জোটাতেই প্রায় ১২টা বেজে গেল। সকাল বেলা তাড়াতাড়ি ঘুম ভাঙলেও গাড়ির অপেক্ষায় প্রায় দেড়ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকলাম।
আমাদের গন্তব্য পশ্চিম সিকিমের স্বল্পপরিচিত জনগণ সিংলিং। সেরেং থেকে প্রায় ৮ কিলোমিটার ওপরে পাখিদের স্বর্গরাজ্য এই সিংলিং। নিউ জলপাইগুড়ি থেকে যার দূরত্ব প্রায় ১২৭ কিলোমিটার। সিংলিংয়ের রুনচেনবং হোম-স্টের কর্ণধার দুশন রাই গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে। পৌনে ৮টা নাগাদ মহানন্দা অভয়ারণ্যের বুক চিরে আমাদের গাড়ি সেবকের কাছে জলখাবারের বিরতি নিল। কেউ চানা বাটোরা, কেউ টোস্ট-অমলেট-সাথে নদীর ছোট ছোট মাছভাজা দিয়ে জলখাবার পর্ব সমাধা হলো।
আজ ২৭ মার্চ, ২০১৩। দোল পূর্ণিমা, বসন্তের মনোরম আবহাওয়া, যদিও এখানে রঙ খেলার উৎসাহ তেমন চোখে পড়ল না। তিস্তার কাছে রাস্তা চওড়া করার কাজ চলার জন্য গাড়ির গতি কম, ধুলো উড়ছে, কয়েকটা জায়গায় রাস্তার অবস্থা খারাপ। রোদের তেজ কখনো গাঢ় আবার কখনো হালকা। দুশনজি বললেন, গত কয়েকদিন ধরেই ‘মৌসম খারাব হ্যায়, বারিস কা চান্সেস জাদা হ্যায়’। মনে মনে প্রমাদ গুনলাম। আকাশের এই অবস্থা থাকলে তো পাখি দেখা ও ছবি তোলার সমস্যা। এখানে আসার আগে যতটুকু হোমওয়ার্ক করেছি তাতে দেখেছি কাঞ্চনজঙ্ঘা বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভ ও বার্সে রডোডেনড্রন অভয়ারণ্যের বেশ কিছু প্রজাতির পাখির আবাসস্থল এই সিংলিং। এসব ভাবতে ভাবতেই মেল্লি পেরিয়ে গেলাম।
মেল্লি পেরিয়ে কিতাম বার্ড স্যাংচুয়ারির প্রবেশদ্বারকে ডানদিকে রেখে একটু এগিয়েছি, এই সময় একটা চেস্টনাট বি-ইটার রাস্তার পাশে গাছের ডালে এসে বসল। ছবি তুলতে যাব, হঠাৎ উল্টোদিক থেকে আসা গাড়ির হর্ন সব ভেস্তে দিলো। দাঁড়িয়ে কিছুটা অপেক্ষা করছি, এই সময় সঙ্গী অর্পিতাদি হাত নেড়ে অনতিদূরে একটা গাছের ডালের দিকে ইঙ্গিত করতেই দেখলাম দুটো চেস্টনাট বি-ইটার। পাশাপাশি বসে আছে। মন ভরে ছবি নিয়ে আবার পথ চলা শুরু।
পৌঁছে গেলাম জোড়থাং। সব দোকানপাট বন্ধ। জোড়থাংয়ে একটা ছোট চা বিরতি আর প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসপত্র কিনে নিয়ে রঙ্গিত নদীর ব্রিজ পেরিয়ে ডুম হয়ে সোরেংয়ের দিকে চলমান। রাস্তা বেশ খাড়াই, গাড়ির গতি বেশ ধীর, যত ওপরে উঠছি ঠাণ্ডার প্রকোপ ততই বাড়ছে, সোরেং পৌঁছার মিনিট কুড়ি আগেই পুরো রাস্তা মেঘে ঢেকে গেল।
সোরেংয়ে আমাদের টাটা সুমো ছেড়ে দিয়ে ফোর হুইল ড্রাইভের কমান্ডার জিপে উঠে বসলাম। সোরেং একদম ছোট পাহাড়ি জনপদ, একটা ছোট গাড়ির স্ট্যান্ড, বাজার আর একটা বিএড কলেজ ও প্রাইমারি স্কুল চোখে পড়ল। সোরেং বাজার ছাড়িয়ে আপার সোরেংয়ের দিকে উঠতে শুরু করলাম। রাস্তা বেশ খারাপÑ কোথাও ইট বিছানো, কোথাওবা একদম কাঁচা। যাই হোক, ৭ কিলোমিটার এসে একটা গুল্ফার সামনে দাঁড়ালাম। দুশনজি সবাইকে গাড়ি থেকে নেমে যেতে বললেন। এখান থেকে প্রায় ৬০০-৭০০ মিটার উতরাই পথ বেয়ে আমাদের গন্তব্যে পৌঁছাতে হবে। গাড়ি থেকে নেমে পাইন বনের মধ্যে পা রাখতেই নানারকম পাখির কুজন কানে এলো। তার মধ্যে নাটহ্যাচ, হিমালয়ান বারবেট, রুফাস সিবিয়ার আওয়াজ স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি। চারদিকে গাঢ় থেকে হালকা জঙ্গল, এর মধ্য দিয়ে হেঁটে চলেছি। চলার পথে কখনো এক-আধটা বাড়িঘর চোখে পড়ছে, কখনো সবুজের সুউচ্চ সমারোহ, এই রাস্তায় হালকা উতরাই পথে অনেকটাই নেমে গিয়েছি, হঠাৎ দুয়েক ফোঁটা বৃষ্টির আবির্ভাব। অরণ্যের আকাশ ছুঁতে চাওয়া গাছের পাতা ভেদ করে দু-তিন ফোঁটা গায়ে পড়ল। প্রতি পদে একটা রোমাঞ্চকর অনুভূতি। অবশেষে আমাদের নির্ধারিত গন্তব্য রুনচেনবং হোমস্টেতে এসে পৌঁছলাম।
সহজ সরল গ্রামীণ সৌন্দর্য। চারদিকে সবুজের সমারোহের মধ্যে আধুনিক সুসজ্জিত বাড়ি। গৃহকর্ত্রী বেরিয়ে এসে হাতজোড় করে নমস্কার করলেন। বাড়ির সামনে লনের ওপর কাঠের বেঞ্চিতে একটা ব্লু হুইসলিং থ্রাশ উড়ে এসে বসল। এখানে আসার পথে বিভিন্ন প্রজাতির পাখি চোখে পড়লেও আলোর অভাবে ছবি নিতে পারলাম না।
মালপত্র যথাস্থানে রেখে লনে এসে দাঁড়ালাম। আশপাশে একটু চোখ বোলাবার ফাঁকেই চা এল। দুশনজির নিজের বাগানের আর্গনিক চা। চায়ের কাপ হাতে নিয়ে চারদিকে তাকাতেই বুঝতে পারলাম দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ পাহাড়ের মধ্যে বিচ্ছিন্ন একটা দ্বীপের মতো বিরাজমান এই হোমস্টে। একটি দ্বিশয্যাঘর ও একটি বড় ঘর হোমস্টে গড়ে তোলা হয়েছে। বড় ঘরটার চারদিক বড় কাচের জানালা দিয়ে ঘেরা। পর্দা সরালেই সবুজ উপত্যকা। দূরে রঙবেরঙের কিছু প্রার্থনা-পতাকা। ঘরে দুটো খাট, সোফা, এ ছাড়া আরো চার-পাঁচটা বিছানা করা আছে। দেখে মনে হলো যেন আমরাই প্রথম উদ্বোধন করব এই হোমস্টে। প্রায় সাড়ে চারটে বাজে, স্কোয়াশের তরকারি, ডাল, শাক, ডিম, পাঁপড় ও আলুভাজা দিয়ে মধ্যাহ্নভোজন শেষ করলাম। চারদিকে কুয়াশা। আমরা আট বন্ধু মিলে গল্প করতে করতে ঘুমিয়ে পড়লাম।
সাড়ে ছটা নাগাদ কফির ডাকে ঘুম ভাঙল। চারদিকে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। দুশনজি বললেন, তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিন, ক্যাম্প ফায়ারের ব্যবস্থা করছি।’ ঘরের পাশেই ক্যাম্প ফায়ারের আয়োজন। দুশনজির দশ বছরের ছেলে গিটার নিয়ে হাজির। সাথে সিন্থেসাইজার, বঙ্গো আগুনের উত্তাপ আর পাহাড়ি লোকসঙ্গীতের সুর, সাথে ঝিঁঝিঁ পোকার কনসার্টে এক মায়াবী সন্ধে আমাদের মোহিত করে দিচ্ছিল। বন্ধুর অনির্বাণ থাকতে না পেরে কি বোর্ডে আঙুল সঞ্চালনা করতেই সহেলি, অর্পিতা, তাপসদাও গলা মেলালেন। দুশনজি নিজে দুটো রবীন্দ্রসঙ্গীতের অনুরোধ করলেন। পটেটো চিপস আর চিকেন ফ্লাইয়ের প্লেট শেষ না হতেই সাড়ে নটা নাগাদ ডিনারের ডাক পড়ল। রুটি, চিকেন, স্যালাড, সবজি আর শাক ভাজা দিয়ে নৈশাহার সম্পন্ন করলাম। প্রায় সাড়ে দশটা বাজে। হঠাৎ একটু চা খাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করতেই দুশনজির স্ত্রী হাসিমুখে চা নিয়ে হাজির। আকাশটা এখন অনেক পরিষ্কার, চায়ে চুমুক দিতে নিতে দুয়েকটা তারা দেখলেও আজ দোলপূর্ণিমা রাতে পূর্ণিমার চাঁদ একদম দেখা গেল না। একটু বিষণ্ণ মনেই ঘুমাতে গেলাম।
ভোরবেলা ঘুম ভেঙে জানলার পর্দা সরাতেই দেখি চারদিকে ঘন কুয়াশা। রাতের বেলা অল্প বৃষ্টিতে পাহাড় ধুয়ে মুছে সাফ হলেও দৃশ্যমানতা খুবই খারাপ। দুশনজির ছেলে জানাল, আকাশ পরিষ্কার থাকলে এখান থেকে খুব ভালো সূর্যোদয় দেখা যায়। সামনের লনে এসে দাঁড়ালাম। কুয়াশাটা এবার অনেকটা কম। চোখটাকে একবার ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরিয়ে নিলাম। মাঝ আকাশে অল্প একটু নীল ছাড়া বাকি সব সবুজ। সবুজের এত অজস্র শেড আগে দেখিনি। ফার আর ওকের জঙ্গল, মাঝে মধ্যে পাইন আর বিক্ষিপ্তভাবে দুয়েকটা লাল রডোডেনড্রন চোখে পড়ছে।
ব্রেকফাস্ট সেরে ঝটপট তৈরি হয়ে ক্যামেরা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। বাড়ির সামনে থেকে নিচের রাস্তাটা ধরলাম। দু-পা এগনো মাত্র একটা রুফাস বেলিড নিলটাভা ফ্রেমে বন্দী হয়ে গেল। বাড়ির কিচেন-লাগোয়া গাছের ডালে একটা ব্ল্যাক থ্রোটেড টিট এসে বসল। সামনের ভুট্টাখেতে একটা ব্লু টেইলড মিনলা ও স্কারলেট মিনিভেট। ছবি নিয়ে আরো জঙ্গলের দিকে নেমে গেলাম। এক জায়গায় দেখলাম জঙ্গলটা বেশ হালকা হয়ে গেল। সামনে অনেকটা জায়গা। সূর্যের আলো ঠিকঠাক না ঢুকলেও চলার রাস্তা আছে। এক জায়গায় এসে একটা জলের নালা পেলাম।
নালাটা পেরিয়ে রাস্তায় উঠে দাঁড়াতেই দেখলাম একটা বড় ফর্কটেল। ছবি নিয়ে জলের রিজার্ভারের দিকে চলেছি, এই সময় গ্রেটার নিলটাভা চোখে পড়ল। ধীরে জলের রিজার্ভারটার কাছে এলাম। একটা লাফিং থ্রাশ, একটা রুফাস সিবিয়া, আর দূরে রিজার্ভারের এক ধারে একটা ফিমেল ওয়াটার রেডস্টার্ট। রিজার্ভারের সামনে একটা লাল রডোডেনড্রন গাছের সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ফেরার পথ ধরলাম।
ফেরার পথে ফ্লাওয়ার পেকার ও ব্লু টেইলড মিনলার ছবি একসঙ্গে গাছের ডালে পেয়ে গেলাম। প্রায় সাড়ে দশটা বাজে, এখান থেকে বেরিয়ে আনডেন যেতে হবে, তাই ফেরার পথ ধরলাম। মেঘ সরছে, সিঁড়ি দিয়ে নামব, দেখি ফায়ার ব্রেস্টেড ফ্লাওয়ার পেকার গাছের ডালে বসে শিস দিচ্ছে। হালকা রোদও উঠছে।
কিভাবে যাবেন
সিংলিং যাওয়ার সরাসরি কোনো গাড়ি নেই। নিজস্ব গাড়িভাড়া করে সোরেং আসতে হবে। অথবা জোড়থাং এসে শেয়ার জিপে করে সেরেং। সোরেংয়েরা জিরো পয়েন্ট এসে গাড়ি ছেড়ে দেবেন। সোরেং থেকে তিন কিলোমিটার ওপরের দিকে গেলেই আপার সোরেং যা সিংলিং নামে পরিচিত। জিরো পয়েন্ট থেকে দুশন রাইয়ের জিপ গাড়ি আপনাকে সিংলিং নিয়ে যাবে।
কোথায় থাকবেন
দুশন রাইয়ের বাড়িতে হোমস্টে ব্যবস্থায় জনপ্রতি প্রতিদিন থাকা-খাওয়ার খরচ ১,০০০-১,২০০ টাকা। এর মধ্যে সোরেং থেকে গাড়িতে করে সিংলিং যাতায়াত, বেড টি থেকে ডিনার, ক্যাম্পফায়ার, বার-বি-কিউ সব খরচ ধরা আছে। যোগাযোগ : ৯৭৩৩০-৭৬২৫৩, ৯৮৩১৩-০৫৮৩৭।