সাজিদ আরাফাত
কালের সাক্ষী হয়ে সারি সারি দাঁড়িয়ে আছে পুরনো বাড়িগুলো। প্রতিটি ইটের দেয়ালে ইতিহাস আর ঐতিহ্যের গন্ধ। আবহমান বাংলার শিল্প ও সংস্কৃতির ধারক ও বাহকের ভূমিকায় এখানকার পুরনো, জীর্ণ ভবনগুলো।
বলছি ঢাকার অদূরে সোনারগাঁয়ে পানাম নগরের কথা। পানাম নগর বাংলার প্রাচীনতম শহর। এক সময় ধনী হিন্দুসম্প্রদায়ের লোকেদের বসবাস ছিল এখানে। ছিল জমজমাট মসলিনের ব্যবসা। প্রাচীন এই নগরীর অন্য সবকিছু অবশিষ্ট নেই। এখন আছে শুধু ঘুরে দেখার মতো ঐতিহাসিক পুরনো বাড়িগুলো। আর তা দেখার জন্যই নগরের কোলাহল ছেড়ে ছুটে চলা! ঢাকা থেকে খুব কাছে বলে সিদ্ধান্ত হলো পানাম নগর ঘুরে আসার।
সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গেল ৩০ মার্চ ২০১৫ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভ এর যোগাযোগ ও গণমাধ্যম বিভাগের উদ্যোগে পানাম নগরে হয়ে গেল বাৎসরিক শিক্ষা সফর। চৈত্রের রৌদ্রজ্জ্বল সকালে একদল উচ্ছল, তারুণ্যদ্দীপ্ত, প্রাণবন্ত আর সৃজনশীল একদল শিক্ষার্থীর ছুটে চলা। এ সফরে সঙ্গী ছিল বিভাগের ডীন আহামুদুল্লাহ মিয়া, প্রভাষক শাহিনুল হক, বারেক হোসেন সহ বিভাগের সমন্বয়কারী ড. মফিদুল ইসলাম।
তিলোত্তমা রাজধানী ছেড়ে বাস ছুটে চললো ঈসা খাঁ কর্তৃক স্থাপিত ‘বাংলার প্রথম রাজধানী’ সোনারগাঁও’র দিকে। সবার চোখেমুখে আনন্দের অভিব্যক্তি। সারাটা পথ যেতে যেতে চললো হৈ-হুল্লোড়, আর নাচ-গান। ঢাকার খুব কাছেই হওয়ায় দুপুর নাগাদ পৌঁছে যাই আমরা। এবার পুরোটা ঘুরে দেখার পালা। কারো চোখেমুখে ক্লান্তির ছিটেফোঁটাও নেই। পুরোটা ঘুরে দেখতে দেখতে মনে হতে লাগলো যেন ঐতিহাসিক অতীতে ফিরে গেছি!
পানাম নগরে ঢুকতেই চোখে পড়বে একটি সরু রাস্তার ধারে সারি সারি পুরনো দালান। কোনটা দোতলা কোনটা আবার এক তলা। বাড়িগুলোর স্থাপত্য নিদর্শন দেখেই বোঝা যায় এখানে ধনী বণিক শ্রেণীর লোকেরা বসবাস করতেন। বাড়ীগুলোতে মোঘল ও গ্রীক স্থাপত্যশৈলীর মিশ্রণ দেখা যায় এবং প্রতিটি বাড়ির কারুকাজ স্বতন্ত্র। কারুকাজ, রঙের ব্যবহার এবং নির্মাণকৌশলের দিক থেকে নতুন নতুন উদ্ভাবনী কৌশলের প্রমাণ পাওয়া যায় এখানে। নগরীর ভিতরে আবাসিক ভবন ছাড়াও আছে মসজিদ, মন্দির, গির্জা, মঠ, গোসলখানা, নাচঘর, পান্থশালা, চিত্রশালা, দরবার কক্ষ, গুপ্ত পথ, বিচারালয়, পুরনো জাদুঘর।
ঐতিহাসিক পানাম নগরে এক সময় ঈসা খাঁর যাতায়াত ছিল। ১৫ শতকে ঈসা খাঁ বাংলার প্রথম রাজধানী স্থাপন করেছিলেন । সেই সময়টাতেই অর্থাৎ সুলতানি আমলে বাংলার শিল্প ও সংস্কৃতি বিকাশ লাভ করে। পূর্বে মেঘনা আর পশ্চিমে শীতলক্ষ্যা নদীপথে বিলেত থেকে আসতো বিলাতি থানকাপড়, দেশ থেকে যেতো মসলিন। শীতলক্ষ্যা আর মেঘনার ঘাটে প্রতিদিনই ভিড়তো বড় বড় পালতোলা নৌকা। প্রায় ঐ সময়েই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্যিক কার্যক্রম ও চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে ইউরোপীয় অনুপ্রেরণায় নতুন ঔপনিবেশিক স্থাপত্যরীতিতে গড়ে উঠে পানাম নগরী। ইংরেজরা এখানে নীলের বাণিজ্যকেন্দ্র খুলে বসে। সেই সাথে মসলিনের বাজার দখল করে নেয় নীল বাণিজ্য।
সোনারগাঁয়ের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করার জন্য পানামের আশেপাশে অনেক সেতু তৈরি করা হয়েছিল। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল পানাম পুল, দুলালপুর পুল। পানাম পুল এখন আর সেখানে নেই। কালের বিবর্তনে আজ হারিয়ে গেছে। এই পুলগুলো এবং এর সাথে যোগাযোগ রক্ষাকারী সড়ক তৈরি করেছিলেন মোঘলরা।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হবার উপক্রম। উফ! এতসব দেখতে দেখতে আর ভাবতে ভাবতে ক্ষুধায় প্রায় কাহিল। এবার খাবারের সর্বশেষ আপডেট নেয়ার পালা। খাবারের আয়োজনও প্রায় শেষের দিকে। এর ফাঁকে অনেকেই ছুটলো পুকুরে গোসলের উদ্দেশ্যে। ফাঁকে ফাঁকেই চলতে লাগলো সবার গল্প, আড্ডা, নাচ, গান হৈ-হুল্লোড় আর ছবি তোলার কাজ। প্রিয় মুহূর্তগুলোকে ফ্রেমবন্দী করার প্রচেষ্টায় সবাই কমবেশি ব্যস্ত সময় পার করলো।
খাবার প্রস্তুত! এবার খাওয়ার পালা। সবাই সারিবদ্ধভাবে খাবার সংগ্রহ করে যে যার মতো খেতে বসি। খাওয়ার পর্ব শেষে শিক্ষক-শিক্ষার্থী মিলে শুরু হয় সার্বিক আলোচনা পর্ব। এরপর অভিজ্ঞতা বিনিময় পর্ব। এতে সবাই তাদের অভিজ্ঞতা, অভিব্যক্তির কথা শেয়ার করেন।
এর মাঝেই বিকেলের পড়ন্ত সোনালী রোদের ছটা গায়ে এসে লাগতে শুরু করেছে। গোধূলি বেলার আলোয় পানাম নগরও উজ্জ্বল রং ধারণ করতে শুরু করেছে। এবার ফেরার পালা। ভাবতেই মনটা বিষাদে ছেয়ে যায় অবস্থা! আবার ফিরে যেতে হবে ব্যস্ত নগরীতে। আবারও রুটিন মাফিক ক্লাস, পরীক্ষা আর অ্যাসাইমেন্ট এর বাঁধা ধরা নিয়মের বেড়াজালে। হ্যাঁ যেতে তো হবেই। এর ব্যতয় করা কি আর চলে? ফেরার পথে সফরকে স্মরণীয় করে রাখতে সবাই মিলে সম্মিলিত ছবি তোলা আর এক নজর প্রাচীন লাল ইটের দালানগুলোকে ফিরে ফিরে দেখা…।
সোনারগাঁয়ে পানাম নগর এবং লোকশিল্প জাদুঘর দুটোই পাশাপাশি। তাই সময় নিয়ে এলে এটিও দেখতে পারেন। ১০ টাকা দিয়ে টিকিট কেটে জাদুঘরে প্রবেশ করতে হবে। এর প্রতিটি গ্যালারিতে দুর্লভ ঐতিহ্যের নিদর্শন সংরক্ষিত আছে। সূত্র : সময় টিভি