সমির মল্লিক
বনাঞ্চলে রয়েছে নানান রকম প্রাণী, দেখতে চাইলে রাঙামাটি থেকে যেতে হবে পানি পথে।
শরতের ঝকঝকে আকাশ, নদীর দুইপাড় জুড়ে সবুজ আর সারি সারি মানুষের বসতি, পানকৌড়ি আর অচেনার পাখির ঝাঁকে ঠাসা পুরোটা পথ। নদীর তীরজুড়ে বিস্তীর্ণ বালুর চর। নদীর নাম– কাচালং।
সীমান্ত থেকে বয়ে এসে বাঘাইছড়ির অরণ্যের মাঝ দিয়ে বয়ে চলছে নীরবধি, মিলেছে কাপ্তাইলেইকে। এবারের যাত্রা সেই নদীর পথে ধরে, সুন্দরবনের পরে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সংরক্ষিত বনাঞ্চলের পথে- পাবলাখালী বণ্যপ্রাণী অভয়ারণ্য।
রাঙামাটি সদর থেকে ১১২ কিলোমিটার দূরে এই বনাঞ্চল।
দূরছড়িতে যাওয়া হয়েছিল প্রায় তিন বছর আগে। এত কাছে মেঘের ভালোবাসা আগে কখনও পাইনি। দুই ঘণ্টার বেশি সময় ধরে স্রোতস্বিনী কাচালং নদীর পথ ধরে গিয়েছিলাম দূরছড়ি পর্যন্ত। সেবার যে আকাশ দেখেছিলাম, তা বুকে ধারণ করে তিন বছর পরে রওনা হলাম কাচালং নদী হয়ে সেই দূরছড়ি, উলুছড়ির পথে।
তবে এবারের ভ্রমণে আমাদের প্রধান আকর্ষণ ছিল পাবলাখালী বণ্যপ্রাণী অভয়ারণ্য। বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সংরক্ষিত বনাঞ্চল।
সকালে যাত্রা শুরু চাঁদের গাড়ি করে, তীব্র রোদ আর নীল আকাশ। মারিশ্যা ভ্যালির পাহাড় ঘেঁষে থাকা সর্পিল রাস্তা ধরে এঁকেবেঁকে। সবুজ পাহাড়ের উপর শুয়ে থাকা কালো পিচঢালা পথ বেশ মসৃণ। একসময় পৌঁছে যায় মারিশ্য ঘাটে। সেখান থেকে নৌকা করে দূরছড়ির পথে।
নদীর দুপাশে সারি সারি গ্রাম, পাড় ঘেঁষে গড়ে ওঠা সবুজ বনানী আর মাথার খুব কাছে নীল আকাশ। সবুজ বনে বুক চিড়ে হঠাৎ উড়ে যায় পাখির ঝাঁক।
কাচালং নদীর স্রোত বেশ তীব্র, এই স্রোতে নৌকার গতিও বেশ। যাহোক দুপুরেই পৌঁছায় দূরছড়ি। সেখানেই দুপুরের খাওয়া। তারপর যাত্রা শুরু পাবলাখালীর পথে।
দূরছড়ি বাজার থেকে পাবলাখালী পৌঁছতে নদী পথে সময় লাগে ৪০ মিনিটের মতো। অদূরের কালো কালো পাহাড়ের কোলে শান্ত নীরব বাড়িগুলো, নদীতে স্থানীয়দের মাছ শিকার, নদী পথে বয়ে চলে মালবাহী ইঞ্জিন বোট।
পাবলাখালী পৌঁছতে পৌঁছতে প্রায় বিকেল ৫টা। এই বন যেন পাহাড়ের সুন্দরবন! বুনো হাতির পাল, কয়েক প্রজাতির বানর, উল্লুক, বুনো কুকুর, বন্য শুকর, সাম্বার হরিণ, বনরুই প্রভৃতির বসবাস এই জঙ্গলে। আর প্রচুর পাখির সমারোহ ৪২ হাজার ৮৭ হেক্টর আয়তনের এই বনজুড়ে।
আছে সারি সরি আদি গর্জন, জারুল, চম্বল, সেগুন, কাঞ্চন, চাপালিশের মতো নানান প্রজাতির গাছ।
এত দীর্ঘকায় প্রাচীন বৃক্ষ পাহাড়ের অন্য কোথাও চোখে পড়ে না। এখানে বনবিভাগ তৈরি করেছে গেস্ট হাউজ, বনসাথী। পাশেই এক অদ্ভুত দৃশ্য— বড় বড় বানরের ঝাঁক, মানুষের এত কাছাকছি বানরের এমন সহজ বিচরণ বেশ আনন্দ দেয়।
কেয়ারটেকারের কাছ থেকে জানা গেল, কয়েকদিন আগে এই গেস্ট হাউজের খুব কাছ থেকে ঘুরে গেছে বন্য হাতির পাল।
গহীন বনের সবুজ পথ ধরে অনেকটুকু ঘুরে আসার পর অনুভব হয়— অনেকটাই অবহেলিত এই বিশাল বনাঞ্চল। হঠাৎ বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টির আগমন। সত্যিকারের রেইন ফরেস্টের দেখা পেলাম যেন!
বৃষ্টি শেষে কাছের আকাশটা দেখায় লাল টকটকে। বনের সবুজ পাতার ফাঁক দিয়ে চোখে পড়ে এই মনোমুগ্ধকর দৃশ্য। পুরো বিকেল বনে কাটিয়ে, সন্ধ্যার আলোয় রওনা হলাম দূরছড়ির পথে। তখনও ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। আর নীল আকাশে কেবল একখণ্ড লাল রেখা।
তীব্র গতিতে ইঞ্জিনবোট যখন ছুটে চলছে দূরছড়ির পথে তখন কাচালং নদীর ঢেউ তোলা স্রোতের সঙ্গে মনটাও ভেসে যাচ্ছিল মেঘের সঙ্গী হয়ে।
যেভাবে যাবেন
রাঙামাটি থেকে বাঘাইছড়ির উদ্দেশে ছেড়ে যাওয়া লঞ্চ করে পাবলাখালী যাওয়া যায়। ভাড়া জনপ্রতি ১৭০ থেকে ২শ’ টাকা মতো। তবে শুষ্ক মৌসুমে রাঙামাটি–বাঘাইছড়ি নৌপথ বন্ধ থাকে। সেক্ষেত্রে সরাসরি বাঘাইছড়ি হয়ে যেতে হবে। ইঞ্জিনবোটই তখন ভরসা।
থাকার জায়গা
পাবলাখালীতে থাকার একমাত্র স্থান– পার্বত্য চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগে নিজস্ব গেস্ট হাউজ। তবে সেক্ষেত্রে আগেই অনুমতি নিতে হবে বন বিভাগ থেকে।
প্রয়োজনীয় তথ্য
যেহেতু পানিপথে যেতে হবে সেক্ষেত্রে লাইফ জ্যাকেট নেওয়া জরুরি। বনের গেস্ট হাউজে বিদ্যুৎ সংযোগ নেই। যাওয়ার সময় প্রয়োজনীয় মোমবাতি নিয়ে যেতে হবে। সঙ্গে খাওয়ার পানিও নিন।
পাবলাখালীতে ট্যুর বিষয়ক যেকোন তথ্য কিংবা সহযোগিতার জন্য যোগাযোগ করতে পারেন ০১৫৫৬৭১০০৪৩, ০১৮১৫-৮৫৬৪৯৭ নম্বরে।
খেয়াল করবেন
মানুষ প্রকৃতির কাছে যাবে। তবে প্রকৃতি যাতে তার মতো করে সুন্দর থাকে সেই দায়িত্বটাও মানুষের হাতে। আপনার ব্যবহৃত কোনো প্রকার পলিথিন, পানির বোতল, প্যাকেট, ময়লা ইত্যাদি বনের ভিতরে ফেলবেন না, সঙ্গে করে নিয়ে আসবেন। ভালো থাকুক অরণ্য, সুন্দর থাকুক প্রকৃতি।
ছবি: লেখক। সূত্র : বিডিনিউজ