
পানি ছিটানো বৈসাবি উৎসবের রঙিন এক অংশ। ছবি: অয়ন আহমেদ
মাসুদুল হাসান জায়েদী
বৈশাখ আসি আসি করছে। আবহাওয়া তা জানান দিতে শুরুও করে দিয়েছে। শুরু হয়ে গেছে বর্ষবরণের প্রস্তুতি। বাংলা নববর্ষের পাশাপাশি উদ্যাপিত হবে পাহাড়ের ঐতিহ্যবাহী বৈসাবি উৎসব। পাহাড়িদের বর্ষবরণে কিছুটা ভিন্নতা রয়েছে। বাঙালিদের কাছে বৈশাখ শুধুই একটি সামাজিক উৎসব। আর পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর প্রধান সামাজিক ও ধর্মীয় উৎসব হলো এই বৈসাবি।
গত বছর বন্ধু অভিজিৎ তঞ্চঙ্গ্যার আমন্ত্রণে যোগ দিয়েছিলাম বৈসাবি উৎসবে। সেই অভিজ্ঞতা ছিল অভূতপূর্ব। ভোরবেলা যখন বাস বান্দরবানে থামল, তখনো শহর পুরোপুরি জেগে ওঠেনি। পরপর আরও কটা বাস এসে পড়ার পরই নির্জন বাসস্টপ যেন লোকে লোকারণ্য। বুঝলাম ভালো পরিমাণেই পর্যটক এসেছে পাহাড়ি এই শহরে। হোটেলে না উঠে সরাসরি চলে গেলাম বাজারে নাশতা করতে। কেননা, একটু দেরি করে গেলে যদি আর খাবার পাওয়া না যায়। হোটেল আমিরাবাদে গয়ালের পায়ার নেহারি দিয়ে উদরপূর্তি করে এলাম হোটেলে। আপাতত দুপুর পর্যন্ত কোনো কাজ নেই, তাই গড়াগড়ি করে রাতের ক্লান্তিটা ঝেড়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নিলাম।
দুপুরে অভিজিতের সঙ্গে দেখা হলো। হাসি-খুশি তাগড়া যুবক আমাকে দেখে ‘আরে দাদা, অনেক দিন পর দেখা’ বলেই বুকে জড়িয়ে ধরলেন। বললাম, ‘দুপুরের খাওয়াটা পাহাড়ি হওয়া চাই। সে আমাদের নিয়ে গেল মধ্যপাড়ার এক পাহাড়ি রেস্তোরাঁয়। একটা সাদা বোর্ডে হাতে লেখা মেন্যু। সেখান থেকে আমাদের চারজনের জন্য খাবার অর্ডার দিলাম। মুরগির চাটনি, গরু ভুনা, ঝিনুকের তরকারি, আদা ফুল দিয়ে ছোট মাছ, বান্দরগুলা (একধরনের সবজি) দিয়ে চিংড়ি, তোজা, বাঁশকুড়ুলের সবজি, আরও দু-একটা পদ। এত খাওয়ার পর নড়াচড়া করাই কষ্টকর হয়ে গেল। চা খেতে খেতে বিকেল পর্যন্ত আড্ডা দিয়েই কাটালাম।
শেষ বিকেলে যাই রাজার মাঠে। সেখানে মেলা বসেছে। মেলায় অবশ্য তেমন কোনো বৈচিত্র্য নেই। এখন বাংলাদেশের সব মেলার চেহারাই এক রকম। তবে এর মধ্যেও তাঁদের হাতে বোনা কাপড়ের পোশাক আর বাঁশের তৈরি জিনিস চোখে পড়ল। রাজার মাঠের পাশেই রাজার বাড়ির উল্টোদিকে আরেকটি ছোট মাঠে চলছে কনসার্ট আর পানি খেলা। ওখানে যখন গেলাম তখন মারমা ভাষার একটা গান হচ্ছিল। ভাষা না বুঝলেও আধুনিক বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার দেখে বুঝতে পারলাম, তাদের ভাষার গানও তারা আধুনিকায়ন করেছে। কিশোর-কিশোরীরা বোতলে আর পিচকারিতে পানি ভরে ছোটাছুটি করছে আর পানি ছিটাচ্ছে। পানি খেলা বৈসাবির অন্যতম বিশেষ আকর্ষণ।
সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত। মেলার ভিড় ছাড়িয়ে কথা বলতে বলতে সামনে এগোতে থাকলাম। আমরা রাতে যাব অভিজিতের শ্বশুরবাড়ি রেইসা। সেখানে সারা রাত অনুষ্ঠান হবে। যেহেতু সারা রাতের অনুষ্ঠান, তাই একটু বেশি রাতে রওনা দেব ঠিক করলাম। দুপুরের মহাভোজের পর রাতে ভাত খাব না ঠিক করলাম, তাই একটা পাহাড়ি খাবারের দোকানে ঢুকলাম। হাসি হাসি মুখ করে একজন দিদি বসে আছেন। আমরা নিলাম মুন্ডি, লাক্সু (মুরগির চাটনি) ও শিক কাবাব। খাওয়ার পর্ব শেষ করে যাই নতুন ব্রিজে হাওয়া খেতে। রাত ১০টার দিকে আমরা দুটি মোটরবাইকে করে রেইসা রওনা দিলাম। চারদিকে অন্ধকারে ঢাকা আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথটাকে বাইকের হেডলাইটে অদ্ভুত লাগছিল। রেইসা পৌঁছতে পৌঁছতে রাত ১১টা। বৈসাবি উদ্যাপনে সেখানে তো দেখি এলাহি কাণ্ড। আর হবে নাই বা কেন, বিষু মানে আনন্দ, হই-হুল্লোড়, বিষু মানে দলবেঁধে ঘুরে বেড়ানো। বিঝু মানে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন সৃষ্টি করা, সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করা, সর্বোপরি বিঝু মানে হলো মিলনমেলা।
এখানে উৎসব সম্পর্কে কিছু কথা বলে নেওয়া ভালো। চাকমা ভাষায় বৈসাবি উৎসবকে বিঝু, ত্রিপুরা ভাষায় বৈসুক, মারমা ভাষায় সাংগ্রাই, রাখাইন ভাষায় সাংগ্রে, তঞ্চঙ্গ্যাদের ভাষায় বিষু এবং অহমিয়দের ভাষায় বিহু নামে ডাকা হয়ে থাকে। প্রধান তিন সম্প্রদায়ের প্রাণের এই উৎসবের নামের আদ্যাক্ষর নিয়েই তাই এই উৎসবকে বলা হয় ‘বৈসাবি’ উৎসব।
বাংলা বছরের শেষ দুই দিন ও নববর্ষের প্রথম দিন—মোট তিন দিন ধরে পাহাড়ে চলে বৈসাবি। উৎসবের প্রথম দিনকে চাকমা ভাষায় বলে ফুল বিঝু, এই দিনে ঘরবাড়ি ও আঙিনা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয় এবং ফুল দিয়ে সাজানো হয় ও পাহাড়ি ছড়া বা নদীতে ফুল ভাসিয়ে দিয়ে পুরোনো বছরের গ্লানি ভুলে নতুন বছরকে স্বাগত জানানো হয়।
দ্বিতীয় দিন ‘মূল বিঝু’। এই দিনে প্রতিটি ঘরে নানা মজার মজার খাবার তৈরি করা হয়। বিশেষভাবে বলা যায় ঐতিহ্যবাহী ‘পাজন’-এর কথা। এ খাবার কমপক্ষে ২০ ধরনের শাকসবজি দিয়ে তৈরি করা হয়। এই পাজনে যে যত পদের সবজি মেশাতে পারবে, তার গুরুত্ব তত বেশি।
আর তৃতীয় দিনকে ‘নুয়াবঝর’ বা ‘গেজ্যা পেজ্যা দিন’ বলা হয়। এই দিনে দলবেঁধে মন্দিরে গিয়ে নতুন বছরের সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনা করা হয়। এই সময় বাড়ি বাড়ি যথেষ্ট খানাপিনার আয়োজন করা হয়।
বৈসাবি উৎসব উপলক্ষে পার্বত্যাঞ্চলে বিভিন্ন খেলার আয়োজন করা হয়। এসব খেলার মধ্যে রয়েছে ঘিলা খেলা, নাদের খেলা, বলীখেলা, ফোর খেলা, পুত্তি খেলা ও তুমুরো খেলা এবং তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে ওপরে ওঠা ইত্যাদি।
আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো যেখানে ঘিলা খেলা চলছিল। এই খেলাটি দলবেঁধে খেলতে হয়। এদের মনে হয় টুর্নামেন্ট চলছে, কারণ বাঁশ দিয়ে রিংয়ের মতো বানিয়ে কয়েকটা জায়গায় একই সঙ্গে খেলা চলছে। এক জায়গায় দেখলাম কোনো পৌরাণিক গাথার ওপর নির্মিত স্থানীয় গীতিনাট্য হচ্ছে।
আড্ডা আর হাসাহাসিতে কখন যে আকাশে লাল রং ধরেছে, খেয়ালই করিনি। আলো ফুটতেই বিদায় নিয়ে ফিরে এলাম বান্দরবান শহরে।
বান্দরবানসহ রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও কক্সবাজারে বর্ণিল বৈসাবি উৎসব হয়ে থাকে। সৌজন্যে : প্রথম আলো