Skip to content

পাহাড় জয়ের গল্প

Tracking

তানভীর আহমেদ আবদুল কাদের
এভারেস্টের দক্ষিণ-পশ্চিমে ২০ হাজার ২৯৫ ফুট উঁচু ‘কেয়াজো-রি’। সলু-খুম্বু অঞ্চলের অন্যতম দুর্গম পর্বত এটি। দুইবার এভারেস্টজয়ী পর্বতারোহী এম এ মুহিতের নেতৃত্বে থাকা দলটির অপর ছয় অভিযাত্রী কাজী বাহলুল মজনু, ইকরামুল হাসান শাকিল, নূর মোহাম্মদ, শামীম তালুকদার, শায়লা পারভীন ও ফৌজিয়া আহমেদ।

বাংলাদেশের পর্বতারোহী দলটি ২৭ অক্টোবর ২০১৫ নেপালের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করে। ৩০ অক্টোবর হিমালয়ের ৯ হাজার ৩১৭ ফুট উঁচু লুকলা বিমানবন্দর থেকে ট্রেকিং শুরু করেন এবং প্রায় ৫০ কি.মি. হেঁটে ৪ নভেম্বর বেস-ক্যাম্পে (১৪ হাজার ৭০০ ফুট) পৌঁছায়। ৬ নভেম্বর অভিযাত্রী দল ১৭ হাজার ২০০ ফুট উচ্চতায় হাই-ক্যাম্প স্থাপন করে। ৭ নভেম্বর রাত ১টায় হাই-ক্যাম্প থেকে গাইড দা কিপা শেরপা ও কিলি পেম্বা শেরপাকে সঙ্গে নিয়ে বাংলাদেশের পাঁচ পর্বতারোহী চূড়ান্ত-আরোহণ শুরু করেন। প্রায় ১ হাজার ৬০০ ফুট দীর্ঘ বিপজ্জনক পাথরের দেয়াল ও বোল্ডার পার হয়ে এবং প্রায় ১ হাজার ৫০০ ফুট খাড়া হিমবাহের দেয়ালে আইস-অ্যাক্স, ক্রাম্পন ও জুমারের সাহায্যে আরোহণ শেষে ৭ নভেম্বর ২০১৫ তারিখ নেপাল সময় সকাল সাড়ে ১১টায় বাংলাদেশের তিন পর্বতারোহী এম এ মুহিত, কাজী বাহলুল মজনু ও ইকরামুল হাসান শাকিল, ‘কেয়াজো-রি’ শীর্ষে আরোহণ করেন। পর্বতজয়ী এই পবর্তারোহীদের দল ফিরে এসে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানিয়েছেন তাদের অভিজ্ঞতা। রোমাঞ্চে ভরপুর সেই পর্বতজয়ের গল্প নিয়ে আজকের প্রবন্ধ।

পর্বতারোহণে তারুণ্য
তারুণ্য সব সময় দুর্বার। দুর্গম পথকে জয় করাই তারুণ্যের নীতি। হিমালয়ের দুর্গম পাহাড়ের দুঃসাহসিকতার গল্প অনেকেরই জানা নেই। দুঃসহ অভিযানের কথা সমাজে ছড়িয়ে পড়লে তারুণ্য নতুন কিছু শিখবে। ভবিষ্যতের তারুণ্য এতে উত্সাহী হবে। যার সুফল আমাদের তারুণ্য অপরাধ থেকে দূরে থাকবে। তরুণ সমাজ বিভিন্ন অপরাধে যুক্ত হয়ে গেছে। কথায় আছে, ‘অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা।’ তাই তারুণ্যকে অপরাধ থেকে ফেরাতে বিভিন্ন অ্যাডভেঞ্চারে উত্সাহী করতে হবে। এর অন্যতম মাধ্যম হতে পারে এভারেস্টের দুঃসাহিক অভিযান। এভারেস্টজয়ী এম এ মুহিত বলেন, আমাদের ‘বিএমটিসি’ ক্লাবের কোনো সদস্যই ধূমপানে আসক্ত নন। কারণ, তারা ভালো করেই জানেন ধূমপান করলে পর্বত আরোহণ করা সম্ভব নয়।

বর্তমান তারুণ্যকে পর্বত আরোহণে উৎসাহী করতে পারলে তারাও মাদক থেকে দূরে থাকবে। পর্বত আরোহণ শুধুই পর্বত আরোহণ তা কিন্তু নয়, এই দুঃসাহসিকতার সুফল সারা জীবনের পাথেয়। পর্বত আরোহণে ধৈর্যশীল ও পরোপকারী হতে হয়। যা সারজীবনের অভিজ্ঞতা হিসেবে কাজ করবে। পর্বত আরোহণে কেউ বিপদে পড়লে অন্য সদস্য তাকে নিয়ে নিচে নেমে আসাটাও একটি সহযোগিতার পরিচয় দেয়। তাই, আমাদের পর্বত আরোহণে এক ঐতিহাসিক বিপ্লব ঘটানো উচিত।

পাহাড় চূড়ায় লাল-সবুজের পতাকা
পর্বত আরোহণ অনেক ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। তবে জাতীয় পতাকা হাতে এভারেস্ট জয়ের আনন্দ বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব যেন বিশ্বজয় করা। এভারেস্টজয়ী এম এ মুহিত বলেন, ‘আমরা স্বাধীনতা দেখেনি। কিন্তু পর্বত আরোহণে গিয়ে বুঝতে পারি যে, পতাকার শক্তি রয়েছে। এটি ছোট্ট একটি কাপড় হলেও এর শক্তি প্রখর। পতাকার এ শক্তি কেবল জয়ী হওয়ার সময় উপলব্ধি করা যায়।’ মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদের বিনিময়ে যে স্বাধীনতা, তা সম্ভব হয়েছে পতাকার শক্তিতে। পর্বত আরোহণের অভিযাত্রীরা দুর্গম পাহাড়ের উপরে উঠতে উঠতে এক সময় শরীরে কোনো শক্তি থাকে না। দুঃসহ মুহূর্তে পা থেমে যায়। সেই মুহূর্তে বুক পকেট থেকে পতাকাটি বের করে মাথার উপরে তুলে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আধ্যাত্মিক শক্তি চলে আসে। পতাকার শক্তি তখন মজুবত ভিত তৈরি করে। তিনি আরও বলেন, ‘যখন এভারেস্টের চূড়া জয় করে লাল-সবুজের পতাকাটি মাথার উপরে তুলে ধরেছি মনে হচ্ছিল বাংলাদেশকে পৃথিবীর সর্বোচ্চ উচ্চতায় নিয়ে এসেছি।’ পৃথিবীর যত দুর্গম স্থানে আমাদের তরুণরা পতাকা হাতে সফল হবে তখন দেশের মানুষও সমানভাবে গর্বিত হবে।

Tracking2

এম এ মুহিত

লক্ষ্য : ২০ হাজার ২৯৫ ফুট কেয়াজো-রি জয় এই অভিযানে : সফলভাবে সামিট করেন।

এর আগে দুইবার এভারেস্ট জয় করেছেন এম এ মুহিত। তবুও প্রতিটি অভিযান তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। ৬ হাজার ১৮৬ মিটার উঁচু কেয়াজো-রি জয় ছিল লক্ষ্য। এবার সঙ্গে ছয় পর্বতারোহী নিয়ে অভিযানে গিয়েছিলেন। পুরো দলের দায়িত্ব নিয়ে যাত্রা করেন। দলের দুজন নারী পর্বতারোহী ছিলেন ট্রেইনি, এটাই প্রথম কোনো অভিয়ান ছিল তাদের। পুরো দলের নেতৃত্ব দিয়ে সফল হয়েছেন মুহিত। আরও দুজন পর্বতারোহীর সঙ্গে সফলভাবে সামিট করেন। পর্বত শিখরে উড়ান লাল সবুজের পতাকা। এই অভিযানে এ ছাড়াও উল্লেখযোগ্য ছিল প্রথমবারের মতো সঙ্গে আসা দুই নারী পর্বতারোহী সফলভাবে বেস ক্যাম্প পর্যন্ত আরোহণ করেন।

Tracking3

কাজী বাহলুল মজনু বিপ্লব

লক্ষ্য : ২০ হাজার ২৯৫ ফুট কেয়াজো-রি জয় এই অভিযানে : সফলভাবে সামিট করেন।

খুব ছোট থেকেই অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় ছিলেন। ৮ম শ্রেণিতে থাকতেই বাবার হাত ধরে সীতাকুণ্ডের চন্দ্রনাথ আরোহণ করেছিলেন। ছোট্ট বেলার এই অভিজ্ঞতা তো আর বৃথা যায় না। ২০০৯-এ প্রথম হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউট থেকে ট্রেনিং গ্রহণ করেন। বাংলাদেশ-নেপাল যৌথভাবে চ্যাকিগো পর্বত আরোহণে প্রথম বাংলাদেশি অভিযাত্রীরাই জয় করেন। সেখানে তার অবদান অনেক। এরপর থেকেই বাংলাদেশ নামে পর্বতটি পরিচিত। সেই অভিযানে দলনেতা ছিলেন এভারেস্ট জয়ী এম এ মুহিত। কেয়াজো-রি পর্বতেও তিনি সফলভাবে জয়ী। তিনি বলেন, ‘গত বছর কেয়াজো-রি জয় করতে না পারায় এবার চ্যালেঞ্জ নিয়েই নামি।’

Tracking4

ইকরামুল হাসান শাকিল

লক্ষ্য : ২০ হাজার ২৯৫ ফুট কেয়াজো-রি জয় এই অভিযানে : সফলভাবে সামিট করেন।

গ্রামের ছেলে। পাহাড় সম্পর্কে খুব বেশি ধারণা নেই বললেই চলে। এভারেস্ট জয়ীদের দেখেই আগ্রহী। ২০১২ সালে ‘বিএমটিসি’তে ক্লাবের মেম্বার হন। ট্রেনিং হিসেবে কেওক্রাডাং ও তাজিংডং আরোহণ করেছিলেন। এরপর দার্জিলিংয়ে ট্রেনিং শেষ করেই কেয়াজো-রি জয়ের উদ্দেশে দলে যুক্ত হন। হাজারো প্রতিকূলতার মধ্যেও সফলভাবে সামিট করেন। শাকিল প্রথম কেয়াজো-রি জয় সম্পর্কে বলেন, ‘পর্বতে আরোহণের একপর্যায়ে বরফের ক্রাম্পন খুলে যাওয়াতে বরফের গায়ে ঝুলে ছিলাম। পায়ের ওপর জোর দিতে না পারায় মনে হচ্ছিল এখনি পিছলে পড়ব। আর কেয়াজো-রি জয়ের পর আনন্দে বাকরুদ্ধ হয়ে প্রকৃতি দেখছিলাম।’

Tracking5

শামিম তালুকদার

লক্ষ্য : ২০ হাজার ২৯৫ ফুট কেয়াজো-রি জয় এই অভিযানে : ১৯ হাজার ৩০০ ফুট পর্যন্ত আরোহণ।

ফ্যাশন হাউসের ম্যানেজার শামিম তালুকদার। ছোটবেলা থেকেই অ্যাডভেঞ্চার পছন্দ করেন। ‘বিএমটিসি’র কেয়াজো-রি অভিযানের অন্যতম সদস্য। শখ থেকেই অভিযানে অংশ নেওয়া কিন্তু কষ্ট যে বেশি তা বুঝতে পারেননি।

অভিযানের শেষ প্রান্তে এসে মাত্র এক হাজার মিটার বাকি থাকতে হঠাত্ করেই আইসবুট ফেটে যায়। তাই নিয়তি মেনে নিয়ে অভিযান শেষ করেন। অতিরিক্ত ঠাণ্ডার কারণে ফেটে যাওয়ায় অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিনি বলেন, ‘ফুটবল খেলায় সবাই গোল করেন না, একজনের গোলে সবাই আনন্দ করে। অভিযানে আমিও তেমনি সফল হওয়ার কষ্ট নিয়ে সবার সঙ্গে আনন্দে মেতে উঠি।’

Tracking6

নূর মোহাম্মদ

লক্ষ্য : ৮ হাজার মিটার কেয়াজো-রি জয় এই অভিযানে : ১৯ হাজার ৩০০ ফুট পর্যন্ত আরোহণ।

২০০৪-এর এপ্রিলে দার্জিলিংয়ের হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউট থেকে পবর্তারোহণ ট্রেনিং গ্রহণ করেন। তিনি পাঁচটি ৬ হাজার মিটার পর্বত আরোহণ করেছেন। লক্ষ্য ছিল কেয়াজো-রি জয় করার। কিন্তু ‘বিপদে বন্ধুর পরিচয়’। তাই দলের এক অভিযাত্রীর বিপদে আত্মত্যাগের পরিচয় দিয়ে সফল না হয়েও জয়ী। সফলতার সঙ্গে পথ পাড়ি দিচ্ছিলেন তখনই শামিম তালুকদারের বিপদে পাশে থাকেন। মাত্র এক হাজার মিটার বাকি থাকতে তার এই আত্মত্যাগ পুরো দলকে গর্বিত করেছে। নূর বলেন, ‘জয়ের কাছাকাছি থেকে শামিমের অসুস্থতা আর বোমিটিং দেখে ওকে রেখে যেতে ইচ্ছে করেনি।’

Tracking7

শায়লা পারভীন বীথি

লক্ষ্য : ১৪ হাজার ৭০০ ফুট, বেস ক্যাম্প এই অভিযানে : ট্রেইনি। বেস ক্যাম্প পেরিয়ে ১৫ হাজার ৫০০ ফুট পর্যন্ত আরোহণ।

সিটি ইউনিভার্সিটির ছাত্রী। এভারেস্ট জয়ী কিংবদন্তিদের গল্পই তার অনুপ্রেরণা। সীতাকুণ্ডের চন্দ্রনাথ পাহাড় ও বান্দরবানের কেওক্রাডাং শিখর আরোহণ ছাড়া অভিজ্ঞতার ঝুলিতে কিছু নেই। তবুও ট্রেইনি হিসেবে বেস ক্যাম্প ছাড়িয়ে ১৫ হাজার ৫০০ ফুট পর্যন্ত আরোহণে সফল এই নারী। ট্রেনিং ও ফিটনেস ছাড়া এতটুকু অর্জনও কষ্টসাধ্য। পাহাড়ি ভয়ঙ্কর পথ আর ট্রেকিংয়ের শুধু পানি, স্যুপ, চা-কফি ও চকলেট খেয়েই বেস ক্যাম্প পর্যন্ত ট্রেনিয়ে সফল হন। বীথি বলেন, ‘প্রথম মনে হচ্ছিল পারব না। কিন্তু জয়ের নেশা চেপে বসায় বেস ক্যাম্পের ট্রেইনি হিসেবে সুস্থভাবেই অভিযান সফল করি।’

Tracking8

ফৌজিয়া আহমেদ রিনি

লক্ষ্য : ১৪ হাজার ৭০০ ফুট, বেস ক্যাম্প এই অভিযানে : ট্রেইনি। বেস ক্যাম্প পেরিয়ে ১৫ হাজার ৫০০ ফুট পর্যন্ত আরোহণ।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞানের ছাত্রী। প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা আর ভিন্ন কিছু করার প্রত্যয়েই অভিযানের মূল শক্তি। ভয়কে জয় করে কেয়াজো-রি অভিযানে ১৫ হাজার ৫০০ ফুট পর্যন্ত পাড়ি দেন। নারী হিসেবে ট্রেনিং ছাড়াই এই অর্জন। রিনি বলেন, ‘অভিযানে অংশ নিয়ে শারীরিক বা মানসিকভাবে স্ট্রং ছিলাম। কিন্তু চকলেট খেতে খেতে মুখে ঘা হয়, এতে কিছুটা অসুস্থ বোধ করি।’ হিমালয়ের পাহাড়ে ট্রেইনিংয়ে দক্ষতার পরিচয় দেন। বেস ক্যাম্পের ঠাণ্ডা বরফের দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে অভিযান সফল করেন। পরিবার ও সমাজের সমর্থন পেলে ভবিষ্যতে হিমালয় জয় করা অসম্ভব নয়। সৌজন্যে : বাংলাদেশ প্রতিদিন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *