Skip to content

পিঠার সাতকাহন

Pitha

আসিফুর রহমান সাগর
‘পৌষ পার্বণে পিঠা খেতে বসি খুশিতে বিষম খেয়ে/ আরও উল্লাস বাড়িয়াছে মনে মায়ের বকুনি পেয়ে…।’ কবি সুফিয়া কামালের কবিতায় গ্রাম-বাংলায় কিশোর বয়সে পিঠা খাওয়ার আনন্দ ধরা পড়েছে এইভাবে। ভাওয়াইয়া গানেও রয়েছে মানুষের পিঠা খাওয়ার বাসনার কথা — ‘মনটা মোর পিঠা খাবার চায়’।

পিঠার নাম শুনলেই জিভে জল আসে না এমন বাঙালি পাওয়া যাবে না। পিঠা বাঙালির জীবন ও সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। যদিও শহুরে সংস্কৃতিতে পিঠার অবস্থান খুব নগণ্য। বিভিন্ন স্টলে বার্গার, পিত্জার জোয়ারে হারিয়েই গেছে পিঠা। কিন্তু তারপরও শীত এলেই পিঠার স্মৃতি মনের ভেতরে নাড়া দিয়ে যায়। একসময় দাদী-নানীর হাতের পিঠা খাওয়ার টানে শীতে গ্রামে যাওয়ার রেওয়াজ ছিল প্রায় প্রতিটি পরিবারে। গ্রামীণ নারীদের হাতে তৈরি পিঠার সেই নান্দনিক পরিবেশনা আমাদের সংস্কৃতির এক অনন্য দৃষ্টান্ত।

সাধারণত নতুন ধান ওঠার পরে আতপ চালের গুঁড়া দিয়ে তৈরি হয় পিঠা। সব ঋতুতেই পিঠা তৈরি হয়। তবে শীতে খেজুর গুড় ও খেজুরের রসে ভেজা পিঠার স্বাদ ভোলা যায় না। সেজন্য শীতকালেই রকমারী পিঠা তৈরির চল রয়েছে আমাদের সংস্কৃতিতে। তবে পিঠার নকশাগুলো খুব আকর্ষণীয়। গ্রামের নারীদের শিল্পবোধের পরিচয় তুলে ধরে পিঠার বাহারি ডিজাইন। এখন শিল্পীরাও এই পিঠার ডিজাইন থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তাদের ছবিতে, নকশায় ব্যবহার করছেন তা।

লোকজ ফর্ম নিয়ে নানা ধরনের কাজ করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের প্রধান শিল্পী ও অধ্যাপক শাবিন শাহরিয়ার। তিনি বললেন, ‘গ্রামে জামাই এলে বা মেয়েরা বাড়িতে এলে পিঠা বানানোর রীতি রয়েছে। দেখা যায় এসব পিঠার ফর্ম প্রকৃতির বিভিন্ন বিষয় থেকে নেয়া; যেমন মাছ, পান, কুলা, ফুল ইত্যাদি। নকশী পিঠার ক্ষেত্রে ফুল ও আল্পনার কাজ প্রাধান্য পেয়ে এসেছে ঐতিহ্যগতভাবে। এসব পিঠা বানানোর যে ছাঁচ সেগুলোও আমাদের গ্রাম-বাংলার মেয়েরা নিজেরা তৈরি করেন। কুশলী পিঠার ফর্ম তো আধখানা চাঁদের ফর্ম। এই ফর্মগুলো মেয়েরা তাদের নকশীকাঁথাতেও সুঁই-সুতোয় ফুটিয়ে তোলেন। আবার ওই ফর্ম নিয়ে শিকড় সন্ধানী শিল্পীরা নতুন ফর্ম তৈরি করেন। আমি এই ধরনের নকশী পিঠার ফর্ম নিয়ে কাজ করেছি। পিঠাকে চাঁদ হিসাবে দেখা হচ্ছে, কখনো ফুল হিসাবে দেখেছে। বাংলাদেশের পিঠা লোকধারা ও শিল্পের ক্ষেত্রে অত্যন্ত শক্তিশালী একটি ফর্ম। বাংলাদেশকে চেনার জন্য উল্লেখযোগ্য একটি উপকরণ।’ তবে এখন নাগরিক নানা ব্যস্ততায় নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের পিঠার সঙ্গে পরিচয় নেই বললেই চলে। অবশ্য কয়েক বছর ধরে রাজধানীসহ বিভিন্ন শহরে আয়োজন করা হচ্ছে পিঠা উত্সবের। শিল্পকলা একাডেমীর সবুজ চত্বরে গত আট বছর ধরে নিয়মিতভাবেই বসছে পিঠা উত্সব। নানা স্বাদের পিঠা সাজিয়ে বসেন মেয়েরা। এই পিঠা উত্সব গ্রামের সেই রঙিন দিনগুলোর কথাই মনে করিয়ে দেয়।

Pitha2

পিঠা উত্সব উদযাপন পরিষদের সদস্য সচিব খন্দকার শাহ আলম বললেন, ‘২০০৮ সালে যখন দেশে সকল সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড স্থবির, তখন পিঠা উত্সবের শুরু করা হয়। সেই উত্সব আট বছরে মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে। এখন দল বেঁধে মানুষ আসে এ উত্সবে।’ তিনি জানান, শুধু উত্সব আয়োজনই নয় যাতে মেয়েদের মাঝে পিঠা তৈরির আগ্রহ সৃষ্টি হয় সেজন্য প্রতিবছর সেরা কয়েকজন শিল্পীকে পুরস্কৃতও করা হয়। এবছর ২২ জানুয়ারি থেকে ৯ দিনব্যাপী এ উত্সব শুরু হতে যাচ্ছে বলে তিনি জানান। এছাড়া বাংলাদেশ শিশু একাডেমীও কখনও কখনও পিঠা মেলার আয়োজন করে থাকে। বিভিন্ন মহিলা সমিতি ও সংস্থাও পিঠা মেলার আয়োজন করে। বিভিন্ন মিনাবাজারের বড় আকর্ষণ পিঠা। ওইসব অনু্ষ্ঠানে বিচিত্র ধরনের পিঠা প্রদর্শিত হয়।

বাহারি পিঠা: বেশিরভাগ পিঠাই মিষ্টি জাতীয়, তবে ঝাল-টক পিঠাও রয়েছে। সারাবছরই পিঠা তৈরি হয়, এর মধ্যে কিছু কিছু পিঠা মৌসুমী। তবে শীতকালের পিঠা সবচেয়ে সুস্বাদু। এ সময়ে খেজুরের রস, খেজুর ও আখের গুড় পাওয়া যায়, যা দিয়ে উপাদেয় পিঠা তৈরি হয়। আসলে পিঠার মৌসুম শুরু হয় হেমন্তে, যখন কৃষকরা ঘরে ধান তোলে। বেশ কিছু পিঠা আছে যা দেশের সর্বত্রই তৈরি হয়। তবে প্রত্যেক এলাকায় আলাদা ধরনের পিঠা রয়েছে। আবার একই ধরনের পিঠা এলাকা ভেদে বিভিন্ন নামেও পরিচিত। এমন কিছু পিঠা আছে যা সারাদেশেই জনপ্রিয়। এগুলো হচ্ছে: ভাঁপা পিঠা, ঝাল পিঠা, ছাঁচ পিঠা, ছিটকা পিঠা, চিতই পিঠা, দুধ চিতই, বিবিখানা, চুটকি পিঠা, চাপড়ি পিঠা, চাঁদ পাকান পিঠা, ছিট পিঠা, সুন্দরী পাকান, সরভাজা, পুলি পিঠা, পাতা পিঠা, পাটিসাপটা, পাকান পিঠা, পানতোয়া, মালপোয়া, মেরা পিঠা, মালাই পিঠা, মুঠি পিঠা, আন্দশা, কুলশি, কাটা পিঠা, কলা পিঠা, খেজুরের পিঠা, ক্ষীর কুলি, গোকুল পিঠা, গোলাপ ফুল পিঠা, লবঙ্গ লতিকা, রসফুল পিঠা, জামদানি পিঠা, হাঁড়ি পিঠা, ঝালপোয়া পিঠা, ঝুরি পিঠা, ঝিনুক পিঠা, সূর্যমুখী পিঠা, নকশি পিঠা, নারকেল পিঠা, নারকেলের ভাজা পুলি, নারকেলের সেদ্ধ পুলি, নারকেল জিলাপি, তেজপাতা পিঠা, তেলের পিঠা, তেলপোয়া পিঠা, দুধরাজ, ফুলঝুরি পিঠা, ফুল পিঠা, বিবিয়ানা পিঠা, সেমাই পিঠা প্রভৃতি।

পিঠা তৈরির সাধারণ উপাদান হচ্ছে চালের গুঁড়া, ময়দা, গুড় বা চিনি, নারিকেল ও তেল। অনেক সময় কিছু কিছু পিঠাতে মাংস ও সবজিও ব্যবহার করা হয়, যেমন সবজি পুলি, সবজি ভাপা, ঝাল কিংবা মাংস পাটিসাপটা। কোন কোন সময় কাঁঠাল, তাল, নারিকেল, কলা ইত্যাদি ফল দিয়েও পিঠা বানানো হয়। ঐসব পিঠায় ব্যবহূত ফলের নামেই পিঠার নামকরণ করা হয়। পাতায় মুড়িয়ে এক ধরনের বিশেষ পিঠা তৈরি হয়, যাকে পাতা পিঠা বলা হয়। কিছু কিছু পিঠার আকার অনুযায়ী নামকরণ করা হয়, যেমন বড় ধরনের পিঠাকে হাঁড়ি পিঠা এবং ছোট আকৃতির এক ধরনের পিঠাকে খেজুর পিঠা বলা হয়। বরকে বরণ করা উপলক্ষে কারুকার্যখচিত, বর্ণাঢ্য ও আকর্ষণীয় নানা রকমের পিঠা তৈরি হয়। এ ধরনের পিঠার নাম বিবিয়ানা; যার অর্থ বিবি বা কনের পারদর্শিতা। এ ধরনের পিঠাকে জামাই ভুলানো পিঠাও বলা হয়ে থাকে। সৌজন্যে : ইত্তেফাক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *