
সিঙ্গাইর মসজিদ, অযোধ্যা বা কোদলা মঠ, ঠাকুরদিঘি ছবি: ইনজামামুল হক
মোর্শেদ নোমান
ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের খবর সংগ্রহ করতে গিয়েছিলাম বাগেরহাটে। যাওয়ার আগেই বন্ধুদের অনেকেই বলেছিলেন বাগেরহাট শহরেই যত পুরাকীর্তি রয়েছে তা দেশের অন্য কোথাও দেখা যায় না। ইউনেসকো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্যের মধ্যে বাংলাদেশে যে তিনটি স্থান আছে, তার মধ্যে দুটির অবস্থানই বাগেরহাটে। একটি সুন্দরবন, অন্যটি খানজাহান আলীর কীর্তি ষাটগম্বুজ মসজিদ। প্রথম আলোর বাগেরহাট প্রতিনিধি আহাদ হায়দার আর স্থানীয় তরুণ সাংবাদিক ইনজামামুল হককে বিষয়টি বলার সঙ্গে সঙ্গে ইনজামাম এক কথায় তৈরি হয়ে গেলেন সব ঘুরে দেখাতে। এটাও জানালেন, এক দিনে শহরের পুরাকীর্তিগুলো দেখা সম্ভব হলেও শহরের বাইরের দর্শনীয় স্থানগুলো দেখতে হলে আরও বেশি সময় লাগবে। তাই ইনজামামের সঙ্গী হয়ে বেরিয়ে পড়লাম বাগেরহাট শহর ও এর আশপাশের পুরাকীর্তিগুলো দেখতে।
শুরুতেই ঐতিহাসিক ষাটগম্বুজ মসজিদে। বাগেরহাট শহর থেকে সাত কিলোমিটার দূরে খুলনা-বাগেরহাট মহাসড়কের উত্তর পাশে ষাটগম্বুজ বাসস্টপেজ লাগোয়া সুন্দরঘোনা গ্রামে মসজিদটি। ২০ টাকার টিকিট কেটে ভেতরে ঢুকলাম। গেটের ডান দিকে মসজিদ প্রাঙ্গণের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে রয়েছে বাগেরহাট জাদুঘর। জাদুঘরটির ভেতরের তিনটি প্রদর্শনী কক্ষে ‘বাগেরহাটের ঐতিহাসিক মসজিদের শহর’-সংক্রান্ত প্রাচীন লেখা, সিরামিক, টেরাকোটা ও কারুকার্যময় ইটের নিদর্শন রয়েছে। খানজাহান আলী (রহ.)-এর ব্যবহৃত বিভিন্ন তৈজস; যেমন কষ্টিপাথরের থালাবাটি ও গ্লাস, শ্বেতপাথরের শিল ও নোড়া। জাদুঘর থেকে বেরিয়ে চলে গেলাম মসজিদের সীমানায়। বাংলাদেশে নির্মিত প্রাচীন আমলের মসজিদগুলোর মধ্যে এটা সবচেয়ে বড়। মসজিদের গায়ে কোনো শিলালিপি নেই। বাগেরহাট জাদুঘরের কাস্টোডিয়ান গোলাম ফেরদৌস জানালেন, ধারণা করা হয় পঞ্চদশ শতাব্দীতে ‘খান-উল-আযম উলুগ খান-ই-জাহান’ যিনি খানজাহান আলী নামে বেশি পরিচিত, মসজিদটি নির্মাণ করেন। মসজিদটি ষাটগম্বুজ নামে পরিচিত হলেও এতে মোট গম্বুজ আছে ৮১টি। মসজিদের চার কোণের মিনার বা বুরুজের ওপরের চারটি গম্বুজ বাদ দিলে গম্বুজের সংখ্যা ৭৭। মসজিদের ভেতরে পূর্ব-পশ্চিমে ছয়টি করে ১০টি সারিতে ৬০টি স্তম্ভ রয়েছে। সম্ভবত সেখান থেকেই এর নাম হয়েছে ষাটগম্বুজ মসজিদ। এ মসজিদকে খানজাহান আলী (রহ.) দরবার কক্ষ হিসেবেও ব্যবহার করতেন বলে শোনা যায়। এ মসজিদটিকে ১৯৮৫ সালে ইউনেসকো বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে মর্যাদা দেয়।
সজিদের পশ্চিমে রয়েছে বিশাল আকারের একটি দিঘি। নাম ঘোড়াদিঘি। দিঘির কাছে আসতেই শীতল বাতাসের পরশ লাগে গায়ে। এ দিঘি দৈর্ঘ্যে ২ হাজার ফুট এবং প্রস্থে ১ হাজার ২০০ ফুট। পূর্ব-পশ্চিমে লম্বা এ দিঘির নামকরণ নিয়েও রয়েছে নানা মত। ষাটগম্বুজ মসজিদের সবচেয়ে কাছে হওয়ায় ঘোড়াদিঘি ‘ষাটগম্বুজের দিঘি’ নামেও পরিচিত। ষাটগম্বুজ মসজিদ এলাকা থেকেই ইনজামামের মোটরসাইকেল ছুটল কাছের আরেকটি স্থাপনার দিকে। নাম বিবি বেগনি মসজিদ। এর অবস্থান ষাটগম্বুজ মসজিদ থেকে আনুমানিক ৮০০ মিটার পশ্চিমে, ষাটগম্বুজ ইউনিয়নের বারাকপুর গ্রামে। বারাকপুর বাজারের উত্তর পাশের পথ ধরে পৌঁছে গেলাম বিবি বেগনি মসজিদে। বর্গাকার এ মসজিদের চার কোণে চারটি গোলাকার বুরুজ বা মিনার এবং উপরিভাগে বৃহৎ আকার একটা গম্বুজ রয়েছে। এ মসজিদের উত্তরে চুনাখোলা গ্রামে রয়েছে আরেকটি মসজিদ, যার নাম চুনাখোলা মসজিদ। জনশ্রুতি আছে, খানজাহান আলীর বসতভিটার পশ্চিমে যে প্রহরা চৌকি ছিল, তাকে কেন্দ্র করে এক গম্বুজবিশিষ্ট এ মসজিদটি নির্মাণ করা হয়। এর কাছাকাছি রয়েছে খানজাহানের বসতভিটা। বছর দু-এক আগে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এ জায়গাটি খনন করে। মধ্যযুগের স্বীকৃত প্রত্নস্থান হিসেবে সুলতানি আমলের এ বসতভিটার খনন স্থান থেকে সুলতানি যুগের ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরনের শৌখিন তৈজসপত্র, মৃৎশিল্প, চুন দিয়ে তৈরি স্টোন ওয়্যার, মৃৎপাত্র ইত্যাদি পাওয়া যায়। এ জায়গাটি এখনো উন্মুক্ত। এর পাশে রয়েছে খানজাহানের আমলে তৈরি একটি সড়ক।

ষাটগম্বুজ মসজিদ
এরপর গেলাম সাবেকডাঙ্গা পুরাকীর্তি দেখতে। ষাটগম্বুজ মসজিদ থেকে প্রায় ছয় কিলোমিটার উত্তরে এটি। এটি ছিল খানজাহানের প্রার্থনা কক্ষ। এর কার্নিশ ধনুকের মতো বাঁকা এবং ভেতরের দেয়াল পোড়ামাটির ফুল-লতা-পাতার অপূর্ব কারুকাজে ভরপুর। এরপর চলে এলাম আরেকটি ঐতিহাসিক মসজিদ সিঙ্গাইর মসজিদে। এটি ষাটগম্বুজ মসজিদের উল্টো দিকে। পরের গন্তব্য দরিয়া খাঁর মসজিদ। খানজাহান আলীর ঘনিষ্ঠ সহচর এই দরিয়া খাঁর নাম আজ অনেকটাই বিস্মৃতপ্রায়। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের কাগজপত্রেও মসজিদটি এখন ‘রণবিজয়পুর এক গম্বুজ মসজিদ’ নামে পরিচিত।
খানজাহান আলীর মাজার মোড় থেকে উত্তরমুখী যে রাস্তাটি রণবিজয়পুর গ্রামে ঢুকেছে, সেটি ধরে সামান্য এগোলেই ‘ফকিরবাড়ি’ চৌরাস্তা। এই ফকিরবাড়ির প্রবেশপথের পাশেই ৬০০ বছরের ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মসজিদটি। লোকমুখে এটি ‘রণবিজয়পুর এক গম্বুজ মসজিদ’ বা ‘ফকিরবাড়ি মসজিদ’ নামে পরিচিতি পেয়েছে। বাগেরহাটে ঘুরতে গিয়ে খানজাহানের মাজার সৌধ না দেখলে বাগেরহাট দেখা যেন অসম্পূর্ণ থেকে যায়। এটি একটি এক গম্বুজবিশিষ্ট ভবন। এর স্থাপত্য অনেকটাই ষাটগম্বুজের মতো। সৌধে মোট তিনটি দরজা। সদর দরজা দক্ষিণ দিকে। এ দরজা বরাবর ভেতরে খানজাহান আলীর কবর। সমাধিসৌধের সামনে বিশাল এক দিঘি। এর নাম খাঞ্জালি দিঘি। এটি ঠাকুরদিঘি নামেও পরিচিত। দিঘির পশ্চিম পাড়ে আছে নয় গম্বুজ মসজিদ। এর কাছাকাছি আছে ছয় গম্বুজ মসজিদ। এটি রেজাখোদা মসজিদ নামেও পরিচিত। তবে এটি প্রায় ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় একটি নতুন দালান তৈরি হয়েছে এবং সেখানে প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ টিকে আছে।
বাগেরহাটের আরেকটি দর্শনীয় স্থাপত্য অযোধ্যা বা কোদলা মঠ। বাগেরহাট শহর থেকে আনুমানিক ১০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে পুরোনো রূপসা-বাগেরহাট সড়কের যাত্রাপুর বাজার থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার ভেতরে বারুইপাড়া ইউনিয়নের অযোধ্যা গ্রামে প্রাচীন ভৈরব নদীর পূর্ব তীরে এর অবস্থান। স্থানীয়ভাবে ‘অযোধ্যার মঠ’ নামেই বেশি পরিচিত। পোড়ামাটির অলংকরণে নির্মিত মধ্যযুগের এ মন্দিরটি স্থাপত্যশিল্পের এক উজ্জ্বল নিদর্শন। এটি রাজা প্রতাপাদিত্যের অন্যতম স্মৃতি। আনুমানিক ১৮ দশমিক ২৯ মিটার উঁচু এ মঠের বিশেষ আকর্ষণীয় দিক হচ্ছে এর বাইরের অপূর্ব কারুকাজসমৃদ্ধ অলংকরণ।
এক দিনের ঘোরাঘুরিতে দ্রুতই বাগেরহাট শহর আর এর আশপাশের ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলো দেখে অনেকটাই চাঙা হয়ে উঠলাম। কিন্তু বাগেরহাটে আরও দর্শনীয় স্থান রয়েছে। যাঁরা কয়েক দিন থাকার পরিকল্পনা নিয়ে যেতে পারবেন, তাঁরা সেসব দেখতে ভুলবেন না। এর মধ্যে মোরেলগঞ্জের নীলকুঠি, সুন্দরবনের করমজল পর্যটনকেন্দ্র, হিরণ পয়েন্ট, দুবলার চর, রাজা প্রতাপাদিত্যের শিবসা দুর্গ ও মন্দির, মংলা বন্দর, খুলনার প্রাচীন জমিদারবাড়ি অন্যতম।
যেভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে বাগেরহাটে যেতে পর্যটকদের খুলনা, গোপালগঞ্জ অথবা পিরোজপুর হয়ে বাগেরহাটে ঢুকতে হবে। মাওয়া হয়ে সংক্ষিপ্ত সময়ে জনপ্রতি ২০০ থেকে ২৫০ টাকায় বাগেরহাট পৌঁছানো যায়। প্রতিদিন সকাল ও দুপুরে গাবতলী ও সায়েদাবাদ বাসস্ট্যান্ড থেকে বাগেরহাটের উদ্দেশে বিভিন্ন বাস ছাড়ে। সাধারণ মানের বাসে ভাড়া ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা এবং চেয়ারকোচে ৩৫০ থেকে ৩৮০ টাকা। আরিচা-পাটুরিয়া হয়ে গেলে সময় এবং খরচ দুটোই কিছুটা বেশি। নদীপথে পিরোজপুরের হুলারহাট অথবা মংলা হয়ে বাগেরহাটে যেতে পারেন। থাকার জন্য শহরে মোটামুটি মানের বেশ কিছু হোটেল রয়েছে, যার ভাড়া ৩০০ থেকে ৮০০ টাকার মধ্যে। পর্যটন করপোরেশন ও বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের রেস্ট হাউসে খরচ কিছুটা বেশি। সৌজন্যে : প্রথম আলো