বুলবুল সরওয়ার
বাংলাদেশের সেরা জ্যোতিষী মহাজাতক কৈশোর থেকেই আমায় আকর্ষণ করেছেন তার নামের জন্য। ম-হা-জা-ত-ক! নামটাই অদ্ভুত। বারবার আমি মাহবুব ভাইর কাছে জানতে চাইতাম, লোকটা কেমন? সে-কি গুরুগম্ভীর, না ঋষিসুলভ?
মাহবুব ভাই হেসে বলতেন, আরে না-না, শহীদ একেবারেই আধুনিক মানুষ।
আধুনিক মানুষ? আমি অবাক না-হয়ে পারি না। আধুনিক মানুষ জ্যোতিষ চর্চা করে?
হ্যাঁ, করে। আধুনিক মানুষেরই তো অকাল্ট রিসার্সে আগ্রহী হওয়া উচিত। অদৃশ্যই যদি আগ্রহ জাগাতে না পারল, তো তুমি আধুনিক হলে কেমন করে?
জ্যোতিষীদের বুঝতে হলে বুঝি আধুনিকও হতে হয়?
খানিকটা তো হয়ই। চাইলেই কি তুমি হাজার মানুষকে ভেল্কি দেখাতে পারো? তাহলে তো সবাই জুয়েল আইচ হত।
আমি আরো অবাক হই মাহবুব ভাইর কথায়। শেষে বলি, আমাকে একদিন নিয়ে চলুন না?
চলো।
কবে?
যখন তুমি যেতে চাও।
কিন্তু আমার আর যাওয়া হয়ে ওঠে না। ব্যস্ততার নীচে চাপা পড়ে থাকে কৌতূহল, উৎসাহ আর অবিশ্বাস!
মিস্টার সারোয়ার?
ইয়েস।
বসতে পারি?
আমাকে অবাক করে হোস্নী এসে টেবিল দখল করল। আলবেনিয়ার মেয়ে হোস্নী। কাল রাতে পরিচয়। ইস্তাম্বুলের অ্যাম্বেসীতে কাজ করে। মিশর-শাসক মোহাম্মদ আলী পাশার জন্মস্থান আলবেনিয়া। গভর্ণর হিসেবে মিশরে যেয়ে শেষ পর্যন্ত সেখানকার স্বাধীন অধিপতি হয়ে মোহাম্মদ আলী ফাটল ধরান ওসমানী-খিলাফতের সুদৃঢ় দেয়ালে।
তোমার জন্য কি করতে পারি, হোস্নী?
কিছু না। কালকের ড্রিংসের হ্যাংওভার কাটেনি বলে ব্রীজ-ডেকে এলাম। বাট, তোমার হাতে কার বই?
আত্তারের বই।
আত্তার… মানে, ফরিদুদ্দীন আত্তার?
জ্বি-হাঁ। কিন্তু তুমি অবাক হচ্ছ কেন? আমি জানতে চাই।
কিন্তু সে নির্বিকার।
আবারও তার মুখে জিজ্ঞাসা, ফরিদউদ্দীন আত্তারকে কিভাবে চেন তুমি? তিনি কি তোমার দেশে জনপ্রিয়?
না।
তাহলে তোমার হাতে তার বই যে!
বাহ্! তাতে কি হয়েছে? চিনি না বলেই তো পড়ব।
কিনেছ? না কেউ দিয়েছে?
ইউরোপকে আমি যতটা চিনি, কেউ এমন ব্যক্তিগত বিষয়ে চর্চা করে না। অবাক হয়ে বললাম, ব্যাপার কি হোস্নী? এনিথিং রঙ উইদ আত্তার?
নো-নো। খানিকটা ধাতস্থ হয়ে বলল সে, আই বিলংস্ টু আত্তারস্ ফ্যামিলি-ট্রি। ইট্স অ্যামেজিং, সো…। তার গলা ভারী হয়ে এলো আবেগে।
ইট মিন্স, ইউ আর এ মোজলেম?
নট রিয়েলি। আই হ্যাভ নো বিলিভ। বাট মাই গ্র্যান্ড ফাদারস্ ওয়্যার টু বি। তুমি কি ইভো আন্দ্রিচের ‘ব্রীজ অন দ্রীনা’ পড়েছ? আমাদের আসলে কোন ধর্ম নেই। আছে কিছু স্মৃতি, কিছু ইতিহাস; আর চেতন-অচেতন বিদ্রোহ। গত দুশো বছরের সাম্প্রদায়িকতা ইউরোপের প্রাচ্য-সংস্কৃতিকে পুরোটাই পাল্টে দিয়েছে।
ইউরোপের প্রাচ্য-সংস্কৃতি? আমার চোখ কপালে উঠে যায়। সে আবার কি?
এই বইটা দেখ। হোস্নী তার টাওয়েলের ভাঁজ খুলল।
হোস্নীর হাত থেকে আমি বইটা নিলাম। কোন আগ্রহ ছাড়াই খুললাম প্রথম পৃষ্ঠা। খুলেই নি:শ্বাস আটকে এলো আমার। বইটির নাম ‘দ্য গার্ল ফ্রম দ্য গোল্ডেন হর্ন’! লেখক: কুরবান সাঈদ। কুরবান সাঈদ, মানে আলী এন্ড নিনো’র অথর?
ইউ আর রাইট।
তার এ-নামে কোন বই আছে বলে তো জানতাম না। ভেরি স্ট্রেঞ্জ!
আরো অনেক স্ট্রেঞ্জ তুমি পূর্ব-ইউরোপে খুঁজে পাবে। যদি পৃথিবীতে সত্যিকারের স্বাধীনতা থাকত, তাহলে হয়ত বলতাম, এখনো আমরা প্রাচ্যকে ভালবাসি। কিন্তু সাধারণ মানুষের কি কোনদিন সত্য বলার স্বাধীনতা ছিল?
আমার নির্বাক চোখ তার দিকে তাকিয়ে রইল। হোস্নী আসলে কি বলতে চায়? নাটকীয়তা বা ভাবাবেগ ইউরোপীয়ানদের বৈশিষ্ট নয়। হোস্নী কি তবে—? নাহ্, আমি কিছুই মেলাতে পারলাম না।
ফরিদ উদদীন আত্তার, হোসনী আর শহীদ আল বোখারীর স্মৃতি আমাকে নিয়ে গেল সুফী সাধনার মর্মমূলে। পারস্যের প্রাচীন মৃত্তিকা এর বীজতলা হলেও আধুনিক দুনিয়ায় মরমীবাদ, সুফি-চেতনা আর মওলানা রুমী প্রায় একাকার হয়ে গেছেন। যদিও ‘মসনবী’ আসলে কবিতার সংকলন এবং তার রচয়ীতা একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য। দীর্ঘতম এই কাব্য রচনা করেছেন মহান শিক্ষাবিদ ও দার্শনিক জালালউদ্দীন রুমী; যিনি সুফীদের-রাজা বলেই খ্যাত। এবং আশ্চর্যের বিষয়, তিনি এসব কবিতা লিখেছেন জীবনের প্রায় শেষাংশে। প্রথমাংশে তিনি ছিলেন শিক্ষক, ধর্মবেত্তা ও ফিলসফার। তার জন্ম আফগানিস্তানের বল্খে, ১২০৭-এর ৩০ সেপ্টেম্বর। ফার্সী ভাষার সবচেয়ে খ্যাতিমান এই প্রতিভা পিতা বাহাউদ্দীনের সাথে পালিয়ে যান তুরস্কের কোনিয়া’য়- মোঙ্গলদের ধ্বংসলীলা থেকে বাঁচার জন্য। পথে নিশাপুরে তাদের সঙ্গে দেখা হয় ফরিদউদ্দীন আত্তারের। বাপের পেছনে রুমীকে আসতে দেখে আত্তার বলেন: একটি সাগর আসছে, পেছনে আরেক মহাসাগরকে নিয়ে।…
আশ্চর্য! আমি অবাক হয়ে বলি। এ-যে রূপকথাকেও হার মানায়!
হ্যাঁ। ফরিদউদ্দীন আত্তার ছিলেন তার সময়ের সবচেয়ে বড় চিন্তাবিদ। রুমীকে তিনি দোয়া করেন এবং তার ভবিষ্যতে সম্পর্কেও উজ্জ্বল ভবিষ্যদ্বানী করেন।
শাম্সে তাবরিজের ব্যাপারটা কি?
তাবরিজের শামস্ও ছিলেন উঁচু মাপের আধ্যাত্বিক সাধক। সত্যের সন্ধানে তিনি ব্যস্ততা ও ভীড় থেকে পালিয়ে বেড়াতেন। সে যুগে, যখন সক্রেটিক পদ্ধতিতে শিক্ষাদানই ছিল বিধান, শিক্ষকদের জন্য পালানোটা সহজ ছিল না। তার অস্থিরতা দেখে একবার ফরিদউদ্দীন আত্তার তাকে বললেন, তুমি আসলে নি:সঙ্গতার প্রেমিক নও। তুমি খুঁজছ প্রেম, যদিও তুমি তা জানো না। আমার মনে হচ্ছে, তোমায় যেতে হবে তুর্কিস্থানে। কোনিয়ার জালালুদ্দীন হবে তোমার প্রত্যাশিত বন্ধু।
শামস্ তুর্কিস্থানে পৌঁছে দেখেন, একটি চৌবাচ্চার পাড়ে বসে রুমী তার পিতার লেখা বই ‘মারিফ’ পাঠ করছেন আর গভীর মনযোগে তার শিষ্যেরা শুনছে। শামস্ তার হাত থেকে বইটি কেড়ে নিয়ে পানিতে ফেলে দেন এবং বলেন: যদি তুমি জালালুদ্দীন হয়ে থাকো, এই পাঠের কোন প্রয়োজন নেই।
সবচেয়ে প্রিয় বইয়ের এই দশা দেখে রুমী চেচিয়ে উঠলেন- এ আপনি কি করলেন, শায়খ? মা’রিফ ছাড়া আমার জীবন অচল।
তাই? বলে পানির মধ্যে হাত ডুবিয়ে শামস্ বইটি তুলে এনে বললেন, নাও; পড় তাহলে।
রুমীর চোখের সামনে বইটির ঝরঝরে শুকনা পাতা উড়ছিল। ভেড়ার চামড়ার পোষাক-পরা আজনবীর দিকে তাকিয়ে তিনি বল্লেন, ঠিকই বলেছেন। মা’রিফ ওখানেই থাকুক। আমার জীবনে অন্য কিছু এসে গেছে…।
আমি অবাক হয়ে হোস্নীর গল্প শুনি। সে-আমার জীবনে দেখা প্রথম শ্বেতাঙ্গিনী, যে সুফীবাদের জটিল তত্ত্ব নিয়ে কথা বলছে। হেসে বলি, আমি যদি দুটো অ্যাপ্রিকট জুস আনতে বলি, কিছু মনে করবে হোস্নি?
থ্যাংকস্ সারোয়ার। সে আবার বলতে শুরু করে, আমার পিতৃপুরুষ আত্তারের বংশধর এবং আত্তারের শিষ্য রুমী। কিন্তু কি বিচিত্র দেখ, রুমী লিখেছেন কবিতা; যদিও তিনি ছিলেন কোনিয়া বিদ্যালয়ের মহাধ্যক্ষ। আর আত্তার লিখেছেন গল্প, যদিও তিনি পড়াতেন কবিতা।
আমার হাত থেকে ‘কনফারেন্স অভ দ্য বার্ডস’ বইটি হাতে নিয়ে হোস্নী ভাবাবেগে আপ্লুত হল।
এ বইয়ে আত্তার অসংখ্য পাখির কন্ঠে মানব চরিত্রের বহুবিচিত্র রূপ একেঁছেন। যদিও রুমির ‘ফানা’ (খেলা) এবং ‘বাকা’ (ব্যবচ্ছেদ) থেকে এর উপস্থাপনা পুরোপুরিই ভিন্ন, কিন্তু আসলে দুটো একই বিষয়। সুফীবাদ যে সত্যকে অনুভব করে চেতনার গভীর থেকে গভীরতর স্থানে, দুটোই তার ভিন্ন ভিন্ন স্তর মাত্র।
আমার চোখে ভেসে উঠল দুটি দৃশ্য: মহাজাতক নামক জ্যোতিষী- অর্থাৎ শহীদ আল বোখারীর হাতে-বানানো কালো ভি-গলার ফতুয়ার উপর উজ্জ্বল ফর্সা হাসি-হাসি মুখ এবং তুরস্কের মধ্য-পশ্চিম শহর কোনিয়ার জালালুদ্দীন রুমীর মাজারের ছবি। মহানবী ছাড়া একমাত্র রুমীর কবরেই আমি সবুজ গম্বুজ দেখেছি। নবীর গম্বুজ গোলাকার, মসৃন, অর্ধেক-কাটা উল্টানো তরমুজের মত। রুমীর কবরের গম্বুজ লম্বা রকেটের আকৃতি, যার তীক্ষ্ম শীর্ষদেশ একত্ববাদের পরম-সত্তার দিকেই অঙ্গুলী নির্দেশ করে। দুটি কৌনিক-মিলনের অ্যাঙ্গেল সিরামিকের জরি দিয়ে ঢাকা- যেন তা ফানা এবং বাকা’র মিলন ঘটাবার জন্যই সদা জাগ্রত।
রুমীর জন্যই সম্ভবত কোনিয়া বা আইকোনিয়ামের নাম সিটি অভ মেলভি (মৌলভী)। কেউ-কেউ সুফীদের কেন্দ্রও বলেন একে। রুমী মারা যান ১৭ ডিসেম্বর, ১২৭৩-এ। ডিসেম্বরের এই দিনে, প্রতি বছর কোনিয়া হয়ে ওঠে বিশ্বেও তাবৎ সুফীদের স্বপ্নপুরী। লক্ষাধিক রুমী-ভক্ত জড় হয় এখানে এবং তারা পালা করে রুমী, তার পিতা বাহাউদ্দীন, বন্ধু শাম্সে তাবরেজী এবং পরবর্তী সুফীদের কবর জিয়ারত করে। রুমীর পিতার কবর রুমির কবর থেকে একটু পেছনে, উত্তরে এবং সামান্য তীর্যক। এর ব্যাখ্যায় বলা হয়, রুমী এমনই বড় মাপের সুফি যে সবার আগে তাকে বিনয়-বিগলিত সালাম জানায় তারই জন্মদাতা পিতা বাহাউদ্দীন।
আমার চোখে ভেসে উঠল কবরের সোনার কাজ করা সেই উজ্জ্বল লাল আচ্ছাদন আর বিশাল সবুজ পাগড়ির কথা। আশ্চর্য হয়ে আমি আওড়ালাম রুমিরই একটি কবিতা:
তুমি যেই হও বন্ধু, এসো
অবিশ্বাস বা অগ্নিপূজার জন্য গ্লানি নেই
ভয় কোর না অজ্ঞানতার অভিশাপকে
যদি ভুলেও থাকো অনুতাপের কথা
এসো,
প্রেমের মাহফিলে সবাই সমান।
যখন শামসে তাবরিজের সঙ্গে রুমীর দেখা হয়, তখন কোনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিল দশ হাজারেরও বেশি। তরুণ ও প্রবীন শিক্ষার্থীরা রুমীর কাছেই সরাসরি জ্ঞান লাভ করতেন ধর্মতত্ত্ব, কবিতা, সঙ্গীত, রন্ধন প্রণালী এবং পশুপালন বিষয়ে। রুমী বলতেন, পশুদের কাছেই আমরা শিখি এবং বাঁচার জন্য খাওয়াকে শিল্পে রূপ দেই; যেহেতু আল্লাহকে পাওয়ার উপায় হচ্ছে ধর্ম এবং প্রেমই তার বাহন; সুতরাং নিমগ্ন ও আত্মহারা হবার জন্য কাব্য এবং সঙ্গীত চর্চায় মনোযোগ দেয়া কর্তব্য। সত্তা সেখানেই পরম সত্তার সাথে লীন হয় শুধুমাত্র প্রেমে, মিলনে এবং এক হয়ে যাওয়ায়।
শামসের সাথে রুমীর আলোচনা, অনুসন্ধান এবং বিতর্ক এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে রুমী তার বিদ্যালয় ও শিক্ষার্থীর কথা ভুলে যান। এতে বাকী শিক্ষকরা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এবং রুমীকে শামস থেকে বিচ্ছিন্ন করার অবিরাম চেষ্টা চালায়। মূখ্য বিষয় ছিল অর্থ, কারণ রুমীর নামেই স্কুলের উপার্জন। তিনি উদাসীন হলে তো আর্থিক ক্ষতি! তারা ষড়যন্ত্র করে শামসকে তাই ইরানে চলে যেতে বাধ্য করে। কিন্তু রুমীর আহ্বানে আবার তিনি কোনিয়ায় ফিরে আসেন। শেষ পর্যন্ত কিছু শিক্ষক, মুরীদ এবং রুমীর পুত্র আলাউদ্দীন মিলে শামসে তাবরিজকে হত্যা করে এবং তার লাশ লুকিয়ে রাখে।
রুমী এই আঘাত সহ্য করতে না পেরে যে-খেঁজুর গাছের নীচে দু’বন্ধু শেষবার আলোচনায় রত ছিলেন- সেই গাছের সঙ্গে নিজেকে বেঁধে ঘুরতে থাকেন আর বিরহের কবিতা আবৃত্তি করেন। এই প্রতীকী-ঘূর্ণন থেকেই জন্ম হয়েছে সুফী নৃত্যের, ‘সেমা’ নামে যা আজো তার অনুসারীরা পালন করে। পশ্চিমা অনেক দার্শনিক সুফীদের এই চক্রনৃত্যের সাথে মিল খুঁজে পেয়েছেন ছায়াপথ, গ্রহ-উপগ্রহ এবং অনু-পরমানুর মূলতত্ত্বের; যার প্রতিটি বন্ধনেই রয়েছে ঘূর্ণন।
রুমী তার জীবনের শেষ বারো বছরে একটি মাত্র দীর্ঘ কবিতা লেখেন- যার নাম মসনবী। চৌষট্টি হাজার লাইনের এই কাব্য ছ’টি অধ্যায়ে বিভক্ত। কবিতার লিপিকার হুশাম সেলেবি ছিলেন শামসের শিষ্য। ফুটনোটে তিনি লিখে গেছেন বন্ধুর প্রতি বন্ধুর প্রগাঢ় প্রেমের বর্ণনা, যা আত্মার সাথে পরমাত্মার মিলনাকাংখার মত দুর্জ্ঞেয় কিন্তু বিরামহীন। রুমীর মৃত্যু বার্ষিকীকে এজন্যই তিনি উল্লেখ করেছেন ‘ওরস’ বা বাসর-রাত্রি নামে!
হোস্নী আমাকে ফিরিয়ে আনল এজিয়ানের সুনীল ঢেউয়ে। তার উত্তেজক পোষাক এবং ইউরোপীয়-অনুতাপ সহসা আমার কাছে পরস্পর বিরোধী মনে হল এবং আমি ভালো করে বুঝতে চাইলাম, আসলেই সে আত্তারের অনুসারী কিনা।
আমি জানি, তোমার মধ্যে সংশয় জেগেছে। জাগাটাই স্বাভাবিক, সারোয়ার। তোমাদের মুঘল সম্রাট আকবরের রাজ্য সমগ্র ইউরোপের চেয়ে বড় ছিল। কিন্তু আকবরের সেই শাসনামল জ্ঞান-বিজ্ঞানে কেন এত কূপমন্ডুক হলো যে তিনি নিজেই নিজেকে ‘ঈশ্বর’ বানাবার চেষ্টা করলেন? এটি কি ‘গ্রেট আকবরের’ সাথে মানানসই?
আমি হতভম্ব হয়ে হোস্নীর দিকে তাকিয়ে আছি। তার টাইট অন্তর্বাসের কিনারে কিনারে উদ্বেলিত যৌবন। কিন্তু তা-যে বেদনার যুক্তিতেও এত অকাট্য, আমার যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না।
হ্যাঁ, সারোয়ার। পূর্ব ইউরোপও তেমনি। খিলাফতের বিলুপ্তির সাথে সাথে আমাদের রাজনৈতিক সীমানাই কেবল লোপ পায়নি, মিটে গেছে আমাদের জ্ঞানপিপাসা, মুক্তবুদ্ধি এবং সত্যের অন্বেষা। এগুলো না থাকলে যা থাকে, তার নাম বেঁচে থাকা হলেও, জীবন নয়।
মোস্তফা কামাল শুধু যে টুপির বদলে হ্যাট পরেছেন আর বোরকাকে নিষিদ্ধ করেছেন তাই নয়, তিনি টান দিয়েছেন আমাদের আত্মার মূল অস্তিত্ব ধরেও। তুমি নিশ্চয়ই জান, রুমীর মাযারকে ১৯২৭-এ তিনি যাদুঘরে রূপান্তরিত করেন। কিন্তু তাতে কি সিক-ম্যান-অভ-ইউরোপ গ্রেট-ম্যান হয়েছে? না, মোটেই না। বরং তুরস্ক হারিয়ে ফেলেছে তার স্বকীয়তা, তার পরিচয়, তার অস্তিত্ব। যেমন, আমরা যখন বলি যে আমাদের কোন বিশ্বাস নেই, ধর্ম নেই– তখন ভান করি যে, এটা আমাদের গৌরব। আসলে তো আমরা আমাদের আত্মাহীনতাকেই দুমড়ে-মুচড়ে মেলে ধরি। আমাদের অন্তরাত্মা চিৎকার করে বলে: কেউ আমাদেরকে আপন করে নাও; বুকে জড়িয়ে ধরে কেউ বলো, আমি তোমাকে ভালোবাসি। কিন্তু কেউ তা বলে না বলেই আমাদের রুমীকে প্রয়োজন হয়। দরকার পড়ে ফরিদ উদ্দীন আত্তারের।
বই দুটো টেবিলে রেখে হোস্নী হুট করে উঠে গেল আমাকে বিস্ময় ও বিপন্নতায় পাথর করে দিয়ে। তাহলে কি পুরো পূর্ব ইউরোপের আত্মাই এমন রিক্ততায় হাহাকার করে ফিরছে? আযারবাইজান-আর্মেনিয়া-বসনিয়া-হার্জেগোভিনা-থ্রেস-বুলগেরিয়া কাঁদছে কোনো দৃঢ় অবলম্বনের জন্য?
হঠাৎ করেই আমি ফিরে গেলাম কুরবান সাঈদ-এ। এই ছদ্মবেশি লেখক আসলে কে? কে তার রক্তস্নাত কলমে লিখে রেখে গেছেন আযারবাইজানের আত্মার আর্তনাদ? পশ্চিমীরা যেমন দাবী করে যে সাঈদ আসলে ইহুদী থেকে ধর্মান্তরিত লেভ নাসিমবাম বা আসাদ বে, কিন্তু সার্বিক যুক্তিতে তা হওয়া প্রায় অসম্ভব। কারণ ধর্মান্তরিত হলেই কেউ কোনো জাতির আত্মার আর্তিকে বুঝতে পারে না। যে গভীর দেশপ্রেম ও নৈতিকবোধ ‘আলী ও নিনো’র পাতায়-পাতায় পল্লবিত, তার তুলনা কেবলমাত্র মুহম্মদ আমাদের ‘রোড-টু-মেক্কা’য় ছাড়া কোথাও আমি দেখি না। আসাদও ধর্মান্তরিত মুসলমান, কিন্তু তার জীবনাচারণ ও লেখার স্পিরিটের মধ্যে যে সঙ্গতি ও সমন্বয়, তা তো নাসিমবামের লেখায় পাওয়া যায় না। এই যে ‘গার্লস ফ্রম দ্য গোল্ডেন হর্ণ’পৃষ্ঠা ওল্টাতে ওল্টাতে আমি দেখলাম, এতে চাতুর্য আছে ঠিকই, কিন্তু নেই সেই আত্মার-স্পন্দন, যা আমি পাই সিদ্ধার্থ কিংবা কুয়ো ভাদিসে। যে-কোন মহৎ সাহিত্যেই এই অচঞ্চল লেখক-পরিচয় পাওয়া যাওয়ার কথাÑ হোক তা হেনরী রাইডার হ্যাগার্ডের মুন অভ ইজরাইল কিংবা হযরত আলীর নাহাজুল বালাগা। কেন আসাদ বে’র অন্য কোনো বইতেই তা নেই? তবে কি আলী ও নিনোর সত্যিকার লেখক লেভ নাসিমবাম নন?
দ্বিধান্বিত মন আমার ফিরে গেল মসনবীতে পুনর্বার। কী আশ্চর্য সত্যে উদ্ভাসিত রুমীর কথামালা:
বিচ্ছিন্ন হয়ো না সত্য থেকে
হে আমার অস্তিত্ব
ছিন্ন কোর না রক্তের বন্ধন।
পাখিরাও ফিরে আসে
প্রতি বসন্তে
দেহকে ছেড়ে দিওনা রেণুর বণে;
আত্মা আমার
পাখা মেলো, পাখা মেলো চিরসুন্দরে!
‘পাখিদের পার্লামেন্ট’– মনে মনে আমি নাম দিলাম আত্তারের ‘কনফারেন্স অভ বার্ডস’-কে এবং পড়লাম তার ভূমিকা। অনুবাদক ভূমিকায় মসনবী সম্পর্কে বলেছেন: ‘প্রিন্সিপল্স অভ দ্য প্রিন্সিপল্স অভ দ্য প্রিন্সিপল্স অভ রিলিজিয়ন।’ সাধে কি আর পার্সীরা বলে, মসনবী হল দ্বিতীয় কোরান!
রেলিঙে ভর-দেয়া হোস্নীর সাদা পিঠের উপর সাপের মত কালো-কালো চুল আছড়াচ্ছে, যেন আকাশ থেকে দেখা দানিয়ুব– যা ইউরোপকে সংযুক্ত ও বিচ্ছিন্ন করেছে পরতে পরতে। কেউ কি ভাবতে পারে, ঐ শতধা বিচ্ছিন্ন ভূখন্ডে এখনো আত্মার অনুসন্ধান করে ফিরছে সেই সব মানুষ, যাদের কারো পূর্বপুরুষ ফরিদ উদ্দীন আত্তার, কারো জালাল উদ্দীন রুমী?
দীর্ঘশ্বাস চেপে আমি দেহ ও মনকে এলিয়ে দিলাম এজিয়ানের ইজিচেয়ারে। সূত্র : নতুন ঢাকা ডাইজেস্ট