Skip to content

পেয়ারার রাজ্যে

এসএম মুকুল
পিরোজপুর জেলার স্বরূপকাঠি উপজেলার পেয়ারা বিদেশে জেলি তৈরির কাজে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। আখাউড়া সংলগ্ন ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার মুকুন্দুপুরের পেয়ারার সুখ্যাতি বহু আগে থেকেই। পেয়ারা একরকমের সবুজ রঙের বেরি জাতীয় ফল। পেয়ারার বৈজ্ঞানিক নাম চংরফরঁহ মঁধলধাধ । বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, মেক্সিকো, মধ্য আমেরিকা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া প্রভৃতি স্থানে পেয়ারা বেশি জন্মে। পেয়ারার প্রায় ১০০টিরও বেশি প্রজাতি আছে। এশিয়ার বিখ্যাত এ পেয়ারাকে স্থানীয় ভাষায় গৈয়া কিংবা সবরি বলা হয়। তবে জাতীয়ভাবে এটি পেয়ারা নামে পরিচিত। পেয়ারা ভিটামিন সি, ক্যারোটিনয়েডস, ফোলেট, পটাশিয়াম, আঁশ এবং ক্যালসিয়াম প্রভৃতিতে সমৃদ্ধ।

Guava2

জানা যায়, প্রায় ৫০ বছর আগে চানপুর গ্রামের হাজি মো. সাইফুর রহমান মোল্লা ওরফে ছবুদ্দি মোল্লা বাণিজ্যিকভাবে এ পেয়ারার চাষ শুরু করলেও এর বিস্তার ঘটে আরও পরে_ ১৯৮০ সালের দিকে। এ সময় দুর্গাপুর গ্রামের একমাত্র নারী চাষি তারা বানু, কাছাকাছি সময়ে রামধননগর গ্রামের বর্গাচাষি রফিকুল ইসলাম পতিত অনাবাদি জমিতে গড়ে তোলেন পেয়ারা বাগান। তাদের সাফল্য দেখে একে একে সীমান্তের আটটি গ্রামের প্রায় এক হাজার একর জমিতে পেয়ারা চাষ ছড়িয়ে পড়েছে। কথিত আছে, অবিভক্ত বাংলার ত্রিপুরা রাজ্যের রাজা বীরেন্দ্র কিশোর মানিক্য বাহাদুর বাগানের গাছ থেকে নিজ হাতে পেয়ারা পেড়ে খাওয়ার জন্য সৈন্যসামন্তসহ মুকুন্দপুর আসতেন। মুকুন্দপুরের সেই পেয়ারা ছড়িয়ে যায় আখাউড়ার উত্তর ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোতে।

পেয়ারা চাষাবাদ

বাংলাদেশের সব জায়গাতেই কম-বেশি পেয়ারা জন্মে। বাণিজ্যিকভাবে বরিশাল, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, চট্টগ্রাম, ঢাকা, গাজীপুর, কুমিল্লা, মৌলভীবাজার, খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি প্রভৃতি এলাকায় এর চাষ হয়ে থাকে। বিভিন্ন জাতের দেশি পেয়ারা চাষের পাশাপাশি বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্ভাবিত বিভিন্ন উন্নত জাতের পেয়ারার চাষ হচ্ছে দেশের অনেক জায়গায়। বাংলাদেশে পেয়ারার অনেক জনপ্রিয় জাত রয়েছে। উল্লেখযোগ্য জাতগুলো হচ্ছে_ কাজি পেয়ারা, বারি পেয়ারা -২, বারি পেয়ারা -৩, বাউ পেয়ারা -১(মিষ্টি), বাউ পেয়ারা -২ (রাংগা), বাউ পেয়ারা -৩ (চৌধুরী), বাউ পেয়ারা -৪ (আপেল), ইপসা পেয়ারা -১, ইপসা পেয়ারা-২, কাঞ্চন নগর, মুকুন্দপুরী, থাই পেয়ারা, পলি পেয়ারা, আঙগুর পেয়ারা ইত্যাদি।

আপেল কমলার চেয়ে উত্তম পেয়ারা

পুষ্টিমান বিবেচনায় কমলার মান যেখানে ১৮৬ পয়েন্ট সে ক্ষেত্রে পেয়ারার পুষ্টি মূল্যমান ৪২১ পয়েন্ট। পেয়ারায় কমলার চেয়ে ৪ গুণ বেশি ভিটামিন-সি আছে। পেয়ারার খোসায় কমলার চেয়ে পাঁচ গুণ বেশি ভিটামিন সি থাকে। পেয়ারায় লৌহ উপাদানও পর্যাপ্ত পরিমাণে বিদ্যমান।

পেয়ারা রাজ্য

পেয়ারা উৎপাদনে বিখ্যাত বরিশাল জেলা। বরিশাল বিভাগের সব স্থানে পেয়ার ফলন হলেও উন্নত ও সুস্বাদু পেয়ারা বরিশাল, ঝালকাঠি ও পিরোজপুরে উৎপাদন হয়। এ কারণে তিন জেলাকে বলা হয় ‘পেয়ারা রাজ্য’। পেয়ারার রাজ্য খ্যাত ঝালকাঠি-বরিশাল-পিরোজপুর জেলার ৫৬টি গ্রাম। হাজার একর জমির ওপর গড়ে উঠেছে পেয়ারা বাগান। মৌসুমের তিন মাস পাকা পেয়ারার সুবাসে সুরভিত থাকে গ্রামের বাতাস।

রফতানি হচ্ছে স্বরূপকাঠির আপেল পেয়ারা

ব্যাপক ফলনে এ অঞ্চলের দেশের চাহিদা মিটিয়ে বাংলার আপেল নামে পরিচিত স্বরূপকাঠির পেয়ারা দ্বারা উন্নতমানের জেলি তৈরির কাঁচামাল হিসেবে বিশ্বের কয়েকটি দেশ পর্তুগাল, মেক্সিকো, কলম্বিয়া, ব্রাজিল, ভারত, মালয়েশিয়া ও পাকিস্তানে রফতানি হচ্ছে। উপজেলার ২৩টি গ্রামে ১৬ হাজার একর জমিতে ২০৪১টিরও বেশি পেয়ারা বাগান রয়েছে। এসব বাগান থেকে বছরে প্রায় ১৬ লাখ মণ পেয়ারা উৎপাদন হয়, যার মূল্য প্রায় ৬০ কোটি টাকা। এ টাকার তিন ভাগের এক অংশ টাকাই বিদেশ থেকে আসছে। ২০৪১টি বাগানের মালিকসহ প্রায় ৮ হাজার পেয়ারা চাষি এতে শ্রম দিচ্ছেন। এদের অর্থ উপার্জনের একমাত্র পথ পেয়ারা চাষের ওপর নির্ভরশীল। রফতানিমুখী পেয়ারা প্রথমে বাঁশ দ্বারা তৈরি সাঁঝির মধ্যে কলাপাতা দিয়ে আটকিয়ে ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, যশোর ও টাঙ্গাইলসহ প্রধান প্রধান বিভাগীয় শহরে পাঠানো হয়। পরে পেয়ারা ব্যবসায়ীরা উন্নতমানের প্যাকেটের মাধ্যমে রফতানি করছে বিদেশে। শ্রাবণ মাসে পেয়ারার চাষ শুরু হলেও আশ্বিন মাসে এর মৌসুম শেষ হয়। কার্তিক, অগ্রহায়ণ, পৌষ, মাঘ, ফাল্গুন_ এ ৫ মাস এসব পেয়ারা বাগানে বাড়তি আয়ের জন্য চাষিরা লাউ, শিম, করলা, আলু, বাঁধাকপি, মুলা, মরিচ, ধনিয়া, শসা ও বিভিন্ন শাকসবজি চাষ করেন। মুকুন্দপুরী জাতের এ পেয়ারা স্থানীয়ভাবে দেশি পেয়ারা বলে পরিচিত। নারিকিলি, অমৃত আর মধু পেয়ারা হিসেবেও এর পরিচিতি আছে।

চট্টগ্রামের কাঞ্চন পেয়ারা

চন্দনাইশ উপজেলার হাশিমপুর ও কাঞ্চনাবাদের পেয়ারা গ্রাম নামে দেশ-বিদেশে বেশ পরিচিতি রয়েছে। কাঞ্চননগর গ্রামে উৎপাদিত পেয়ারার নাম হয়েছে কাঞ্চন পেয়ারা। এ পেয়ারা আকারে বড়, সুস্বাদু ও রসালো। দেশে-বিদেশে ব্যাপক চাহিদা। দেশের চাহিদা মিটিয়ে এ পেয়ারা মধ্যপ্রাচ্যের কাতার, বাহরাইন, দুবাই, ওমান, সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশে রফতানি হচ্ছে কাঞ্চন পেয়ারা। এ ছাড়া দক্ষিণ চট্টগ্রামের পটিয়া, চন্দনাইশ, সাতকানিয়া, লোহাগাড়া ও বাঁশখালী এই পাঁচ উপজেলায় পাহাড়ি অঞ্চলে এক হাজার হেক্টরের অধিক জমিতে চার হাজারের অধিক পেয়ারা বাগানে উৎপাদিত হচ্ছে পেয়ারা। এ ছাড়া পটিয়া উপজেলার হাইদগাঁও ও শ্রীমাই, বাঁশখালী উপজেলার জলদী, বৈলছড়ি, কালিপুর ও গুনাগরি, সাতকানিয়া উপজেলার চূড়ামনি, মার্দাশা, সোনাকানিয়া, এঁওচিয়া ও পুরানগড় এবং লোহাগাড়া উপজেলার চুনতি, কলাউজান, পুটিবিলা, পদুয়া ও বড়হাতিয়ার পাহাড়ি অঞ্চলে প্রতি বছর পেয়ারা চাষ হয়। প্রতিদিন গড়ে চার থেকে পাঁচ লাখ টাকার এবং প্রতি বছর প্রায় পাঁচ কোটি টাকার পেয়ারা বিক্রি হয়।

মাগুরায় কোটি টাকার পেয়ারা

মাগুরা শহর থেকে ৭ কিলোমিটার পশ্চিমে মাগুরা-ঝিনাইদহ সড়কের পাশে হাজরাপুর, ইছাখাদা, মিঠাপুর, কালিমপুর, উথলী, নন্দলালপুর, নোয়াপাড়া, ছাচানি, রাউতরা, গৌরিচরনপুর, হাজীপুর ইউনিয়নের আলাইপুর, আড়য়াকান্দি, আড়ালিয়া, হৃদয়পুর, রাঘবদাইড় ইউনিয়নের পাকাকাঞ্চনপুর, বীরপুর, দোরামথানা, বেরইলসহ জেলার অপর তিনটি উপজেলায় ব্যাপক পেয়ারা চাষ হচ্ছে। জেলায় মোট ৫ থেকে ৭ হাজার পেয়ারা বাগান রয়েছে। সঠিক পরিচর্যায় ভালো ফলন হলে এখান থেকে ৫ থেকে ৬ কোটি টাকার পেয়ারা উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে।

পেয়ারা পাতায় চা

পেয়ারা গাছের কোনো কিছুই ফেল না নয়। পেয়ারা পাতারও রয়েছে বিশেষ গুণ। পেয়ারা পাতা দিয়ে এক ধরনের চা তৈরি করেছে জাপান, যা মানবদেহের জন্য খুবই উপকারী। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পেয়ারা পাতার চা ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। বিশেষ করে ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীন এ চা মানবদেহকে সতেজ করে, দাঁত মজবুত ও মুখের দুর্গন্ধ দূর করে। পেয়ারা পাতা প্রক্রিয়াজাত করে রফতানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করাও সম্ভব। অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, বাংলাদেশি পেয়ারা পাতার বিশ্ব বাজারে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।

প্রাণের পেয়ারা পাল্পিং নাটোরে

কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠান প্রাণ ২ হাজার টন পেয়ারা সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে পেয়ারা থেকে খাদ্যপণ্য প্রস্তুত করতে নাটোরের ফ্যাক্টরিতে পেয়ারা পাল্পিং শুরু করেছে। পেয়ারা থেকে প্রাপ্ত পাল্প দিয়ে পেয়ারার জুস, মিক্সড ফ্রুট জ্যাম-জেলি প্রভৃতি প্রস্তুত করা হবে। বহির্বিশ্বে এসব পণ্যের ব্যাপক চাহিদা থাকায় রফতানির ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে।

পেয়ারার ভাসমান হাট

পেয়ারার পাইকারি বাজার ঝালকাঠি ভিমরুলীর ভাসমান বাজার। তিনটি খালের সংযোগস্থলে এ হাটটি অবস্থিত। একটি খাল থেকে নৌকা যায় স্বরূপকাঠি, একটি থেকে কাউখালী, অন্যটি থেকে ঝালকাঠির দিকে। দৈনিক সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত নৌকার ভাসমান এ বাজারে চলে পেয়ারার কেনাবেচা। ডিঙ্গি নৌকা করে পেয়ারা নিয়ে আসে চাষিরা। নৌকা ভরা পেয়ারা এই ভাসমান বাজারের পাইকারদের কাছে বিক্রি করা হয়। ভিমরুলী, শতদশকাঠি, জগদীশপুরের খালে লাইন ধরে চলে পেয়ারা ভর্তি নৌকা। পাইকাররা পেয়ারা কিনে কার্গো ও ট্রলারযোগে চালান করে দেশের বিভিন্ন জেলায়। প্রতিবছর পেয়ারার মৌসুমে বিভিন্ন স্থান থেকে নৌপথে পেয়ারা বাগানে আসে পর্যটকরা। পেয়ারা বাগানে এসে মুগ্ধ হয়ে এখান থেকে পেয়ারা কিনে নিয়ে যান পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনদের জন্য।

Guava

পেয়ারার মোকাম

আষাঢ়, শ্রাবণ ও ভাদ্রের অর্ধেক এই আড়াই মাস জমে ওঠে পেয়ারা বেচাকেনা। পেয়ারা চাষ ও ব্যবসাকে কেন্দ্র করে এসব এলাকায় গড়ে উঠেছে ২০টিরও বেশি ছোট-বড় ব্যবসা কেন্দ্র। মোকামগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে আটগড়, কুড়িয়ানা, ভিমরুলী, ডুমুরিয়া, শতদশকাঠি ও বাউকাঠি। প্রতিদিন সকালে এসব মোকামে চাষিরা ছোট ছোট ডিঙ্গি নৌকায় সরাসরি বাগান থেকে পেয়ারা নিয়ে আসে পাইকারদের কাছে। তা কিনে ট্রলারে নৌপথে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলায়। ঝালকাঠির ভিমরুলীর ন্যায় পিরোজপুরের আটগড়, কুড়িআনা, বরিশালের বানারীপাড়াসহ ছোট বড় প্রায় ২০টি বাজারে পেয়ারা বেচাকেনা হচ্ছে।

যোগাযোগে বাড়বে সম্ভাবনা

বছরের পর বছর ধরে পেয়ারা উৎপাদিত এসব এলাকার চাষিদের একমাত্র সমস্যা হিমাগার ও সড়কপথে যোগাযোগের ব্যবস্থা না থাকা। প্রতি বছর হিমাগারের অভাবে এসব এলাকার কয়েক কোটি টাকার পেয়ারা নষ্ট হয়। দ্রুত পেকে যাওয়ায় তা সংরক্ষণ করে রাখার কোনো ব্যবস্থা নেই। পিরোজপুর, ঝালকাঠি ও বরিশালের উৎপাদিত পেয়ারা সড়ক পথে নেওয়ার কোনো ব্যবস্থা আজ পর্যন্ত গড়ে ওঠেনি। পেয়ারা চাষিদের মতে, সড়কপথে যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠলে পেয়ারা দ্রুত বাজারজাত করা যেত। ভিমরুলী দক্ষিণাঞ্চলের সবচেয়ে বড় পেয়ারার মোকাম। এখানে মৌসুমে প্রতিদিন প্রায় ১০ হাজার মণ পেয়ারা বিক্রি হয়। ভিমরুলী মোকাম থেকে নৌপথে খুলনা, ফেনী, ঢাকা, সিলেট, পটুয়াখালী, ভোলা, মাদারীপুর, নাটোর, বরিশালে হাজার হাজার মণ পেয়ারা যাচ্ছে। কিন্তু সড়কপথে যোগাযোগ থাকলে তাৎক্ষণিকভাবে এসব জেলায় পেয়ারা নেওয়ার জন্য পাইকাররা চাষিদের আরও বেশি দাম দিয়ে পেয়ারা কিনত। দেশের অন্যতম পেয়ারা অঞ্চল হলেও আজ অবধি এসব এলাকায় সরকারিভাবে কোনো হিমাগার নির্মাণ করা হয়নি। নেই কোনো জেলি কারখানাও। এমনকি সড়ক পথেরও উন্নয়ন না হওয়ায় পেয়ারা চাষিরা ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। সূত্র : সমকাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *