রাসেল মাহমুদ
লগি হাতে তৎপর ওরা, দৃষ্টি আকাশের দিকে। একটা ঘুড়ি ভোঁকাট্টা হলেই ভোঁ-দৌড়। যে আগে পৌঁছাতে পারবে, ঘুড্ডিটা তার। বয়স ছয় কি সাত; ঘুড়ি শিকারের জন্য নিজের থেকে তিন গুণ লম্বা লগির মাথায় বেঁধে নিয়েছে ঝোপঝাড়। বৃহস্পতিবার ওদের দেখা গেছে রাজধানীর পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়ার পথে পথে। আর এলাকার আকাশ রঙিন ঘুড়িতে সয়লাব! পৌষসংক্রান্তি উৎসবের ঘুড়ি।
পঞ্জিকামতে, বাংলা পৌষ মাসের শেষের দিন উদ্যাপন করা হয় পৌষসংক্রান্তি। বর্তমানে ‘পৌষসংক্রান্তি’ শুধু ‘সংক্রান্তি’ নামে পরিচিতি লাভ করেছে; আর পুরান ঢাকার মানুষ একে বলে ‘সাকরাইন’। পৌষ গেলে শীতটা জমাট বাঁধে। ঘরে ঘরে তখন রসাল পিঠা। শোনা যায়, পৌষের শেষে জামাইরা শ্বশুরবাড়ি এলে তাঁদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হতো ঘুড়ি ও নাটাই। সব বাড়ির জামাইরা ঘুড়ি ওড়ালে ঘটা করে সেসব দেখতেন গ্রামবাসী। এমনটা এখন আর হয় না। শহরেও শীত তার তীব্রতা খুইয়েছে। কিন্তু উৎসবটা রেখে গেছে। তাই ঘুড়ি ওড়ানো পৌষবিদায়ী উৎসবের অংশ হয়ে আছে।
বৃহস্পতি ও শুক্রবার পৌষসংক্রান্তি উপলক্ষে পুরান ঢাকার বাড়িতে বাড়িতে ‘সাকরাইন’ উৎসব উপলক্ষে ঘুড়ি ওড়ানো ছাড়াও ছিল নানা আয়োজন। বৃহস্পতিবার গেন্ডারিয়ার দীননাথ সেন সড়কের বেশ কিছু বাড়িতে ভীষণ শব্দে বাদ্য বাজতে শোনা গেছে। সেখানকার একটি বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ২৩ থেকে ৩০ বছরের যুবকেরা বাজনার সঙ্গে নাচছেন। তাঁদের একজন ইব্রাহিম লিংকন জানালেন, বুধবার সাততলার ছাদে স্পিকার তোলা হয়েছে। আশপাশের কেউ যেন বাদ্যের আওয়াজে তাঁদের পেছনে ফেলতে না পারে, সে জন্য আনা হয়েছে ১০ পিয়ার বক্স। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী গোলাম রাব্বানী বললেন, ‘১৫ বছর ধরে এই উৎসবটা করে আসছি আমরা। প্রতিবছর চাঁদার পরিমাণ বাড়িয়ে আয়োজনে চাকচিক্য আনা হয়।’ তাঁদের বন্ধুদলের নাম ব্যাড বয়েজ আর ছোটদের দলটার নাম জুনিয়র ব্যাড বয়েজ। দুটো আলাদা আয়োজন করেন তাঁরা। সবাই আলাদাভাবে ঘুড়ি ওড়ালেও ‘ব্যাড বয়েজ’কে প্রতিনিধিত্ব করে এমন একটি বিশেষ ঘুড়িও বানানো হয়। খাওয়ার জন্য থাকে খিচুড়ি, গরুর মাংস। সারা দিন এলাকা কাঁপিয়ে বাজতে থাকে গান, চলতে থাকে নাচ। সন্ধ্যার পর শুরু হয় মুখে কেরোসিন-আগুনের খেলা, ফানুস ওড়ানো। বাড়ির ছাদগুলো থেকে আকাশে ছোড়া হয় শাঁখারীবাজার, চকবাজার থেকে কিনে আনা রং-বেরঙের আতশবাজি। রাত ১১টা পর্যন্ত ডিজের সঙ্গে সঙ্গে নাচেন ছেলেমেয়েরা। রাব্বানী জানালেন, ওই এলাকার সব থেকে বড় আয়োজন করে ‘ব্যাড বয়েজ’। এ ছাড়া ইয়ুথ গ্রুপ, স্টোন গ্রুপসহ আরও বেশ কয়েকটি দল এই আয়োজন করে।

সাকরাইন উপলক্ষে ছেলেদের সঙ্গে দুই তরুণীও অংশ নিয়েছেন ঘুড়ি ওড়ানো উৎসবে। ছবিটি গতকাল তাঁতীবাজার এলাকা থেকে তোলা।
ইসলামপুরের ব্যবসায়ী আবদুল মালিক জানালেন, ‘সাকরাইন আমাদের পুরান ঢাকার প্রাচীন ঐতিহ্য। ছোটকাল থেকে দেখে আসছি, আমাদের পূর্বপুরুষেরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই আয়োজন করে আসছে। আগে পিঠা-টিঠা বানানো হতো। এখন বাড়িতে পিঠা বানানোর আয়োজন কমে গেছে।’
পুরান ঢাকার সূত্রাপুর, মিলব্যারাক, হাজারীবাগ, সদরঘাট, নবাবপুর, লালবাগ, চকবাজার, বংশাল, ওয়ারী ও পোস্তগোলা এলাকার মানুষ এখনো ঘটা করে সাকরাইন পালন করে। শুধু ঢাকাতেই নয়। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে পৌষসংক্রান্তির এই উৎসব পালনের রীতি চালু আছে। নেপালে একে বলে মাঘি, থাইল্যান্ডে সংক্রান, লাওসে পি মা লাও, মিয়ানমারে থিং ইয়ান, কম্বোডিয়ায় মহাসংক্রান এবং ভারতে মকরসংক্রান্তি। সৌজন্যে : প্রথম আলো