Skip to content

প্রকৃতি-পাহাড়-মেঘের সান্নিধ্যে

:: কামাল হোসাইন সৈকত ::
‘অনেক দিন ধরেই আমার একটি পাহাড় কেনার শখ,
কিন্তু পাহাড় কে বিক্রি করে তা জানি না।
যদি তার দেখা পেতাম দামের জন্য আটকাত না।’
-সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়র

ইট-কংক্রিটের এই শহরে রোবটিক জীবনে যেন হাবুডুবু খাচ্ছি। কম্পিউটারের মনিটর শেষে মোবাইলের স্ক্রিন। এভাবেই কেটে যায় সকাল থেকে রাত। নিজেকে ফিরে পাওয়ার চেষ্টায় কবিতার বইয়ের পাতা উল্টাতেই চোখে পড়ল সুনীল বাবুর উপরিউক্ত লাইনগুলো। মনের অব্যক্ত কথা খুঁজে পেলাম। সত্যিই আমার একটি পাহাড় চাই।

মরুভূমি-সাগর-পাহাড় এগুলোর মধ্যে অদ্ভুত এক বিশেষত্ব রয়েছে পাহাড়ের। পাহাড় মানুষকে কাছে টেনে নেয় চুম্বুকের ন্যায়। সেখানে পাওয়া যায় প্রকৃতির সান্নিধ্য। ঠাই নেওয়া যায় ভাসমান মেঘের বুকে।

ইমরান ভাইয়ের নেতৃত্বে চারজন গাইডকে সঙ্গে নিয়ে ৪০ জনের গন্তব্য হরিশচন্দ্র-দেবতা পাহাড় পরবর্তী আমিয়াখুম-নাফাখুম। থানচিতে সীমান্ত বাহিনীর কাছ থেকে অনুমতি শেষে নিজেদের রয়েল, বেঙ্গল, টাইগার নামে তিনটি গ্রুপে ভাগ করে নৌকায় চড়ে বসলাম। সাঙ্গুর অপার সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে পদ্মঝীরিতে প্রথম গন্তব্য।

দুপুর ১২টা। বৃষ্টি-রোদ-জোকসহ সব কিছু মোকাবিলা করার প্রস্তুতি নিয়ে শুরু হলো কষ্টেভরা রোমাঞ্চকর ট্রেকিং। গন্তব্য থুইসাপাড়া। প্রতিকূল আবহাওয়াকে সঙ্গে করে হাজারো বাঁধা বিপত্তি-চড়াই উৎরাই শেষে ঘুটঘুটে কালচে অন্ধকারে সিলেটি ইমরান ভাইয়ের সহায়তায় রেমাক্রী খাল পাড়ি দিয়ে ১২ জনের একটি গ্রুপ পৌঁছালাম থুইসা পাড়ায়। পরের ২৮ জনের গ্রুপটি আসে চার ঘণ্টা পর। তাদের মুখে শুনি ১২ জন অন্ধকারে রাস্তা হারিয়ে এদিক ওদিক ছোটাছুটি শেষে ক্লান্ত হয়ে জুম ঘরে আশ্রয় নেওয়ার পরিকল্পনা করে।

দ্বিতীয় দিনের প্রত্যূষেই সেতু আপুর উচ্চ কর্কষ আওয়াজে ঘুম ভাঙ্গল। তৈরি হওয়ার তাগাদা দিল ফারহানা ভিউ ও মাসুম ভাই। নাস্তা পর্ব শেষে উদ্দেশ এবার আমিয়াখুম। তীব্র আকাঙ্ক্ষিত জায়গাটিতে যেতে মন যেন তর সইছিল না। ৩ ঘণ্টার রাস্তা দুই ঘণ্টাতেই শেষ করে দেবতা পাহাড় পাড়ি দিয়ে পৌছালাম আমিয়াখুম। মুহুর্তেই যেন বাকহীন হয়ে পড়লাম। স্রষ্টা পাহাড়ের পাদদেশে এমন করে গড়ে প্রকৃতি সাঝিয়ে রেখেছিলেন যা দেখতে অবর্ণনীয়, অকল্পনীয়। লাফালাফি ঝাপাঝাপি শেষে ভেলায় চড়ে নাইক্ষং মুখে সাহসী যাত্রা শেষে পুনরায় গন্তব্য থুইসা পাড়া।

গৌধুলি লগ্নে থুইসা পাড়ার মাচায় বসে সান্ধ্যকালীন উপভোগের চা পান। মনে হল এমন একটি সময়ের প্রতীক্ষায় ছিলাম বহুকাল। ঝুপ করে রাত্রী নেমে আসল, বসল জলসার আসর। নাইম ভাইয়ের বেসুরে গলায় গান সাথে আইটি-নন আইটি বিতর্ক, ইমরান গ্রুপ, নিশাদের রসালো আলাপচারিতা, আমিয়াখুম রিটার্ন্স, নিরীহ গ্রামবাসী সব মিলে আড্ডা ছিল জম্পেশ। রাতের পূর্ণিমার আকাশে ছিল হাজার তারার মিলনমেলা ও বিশালাকৃতির চাঁদ।

প্রত্যুষেই ‘আবার আসিব ফিরে’ বলে থুইসা পাড়াকে বিদায় জানিয়ে উদ্দেশ্য এবার নাফাখুম। ঝিরির ধারায় চলতে চলতে দূর্ঘম রোমাঞ্চকর পথ পাড়ি দিয়ে পৌছালাম নাফাখুম। জলকেলিতে মাতোয়ারা টিজিবি বাহিনী মাতল ‘যমুনার জল দেখতে কালো স্লান করিতে লাগে ভালো যৌবন মিশিয়া গেল জলেতে’।

নাফাখুম জলপ্রপাত শেষে গলা পানি রশির সাহায্যে পাড়ি দিয়ে সাঙ্গু নদীর বোটে চড়ে বসলাম। আশপাশ তাকিয়ে প্রকৃতিতে নয়ন জুড়ানোর সময় হঠাতই আগমন তুমুল বৃষ্টির। মুহূর্তেই সাঙ্গু যেন রূপ নিল দানবের ন্যায়। বড় বড় শ্রোতে বিশালাকৃতির পাথরের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে বোট ডুবে যাওয়ার বেশ কয়েকবার উপক্রম হয়েছিল। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটল পাথরের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে মোড় ঘোড়াতে গিয়ে মাঝি ছিটকে পড়ে গেল বোট থেকে। আমরা যাত্রীরা কেউ দেখতে পাইনি। তবে পেছনে আমাদের জন্য দাঁড়িয়ে থাকা গাইড হারুন ভাই, ইমরান ভাই, রাজভাইয়ের সাহসিকতা ও উদ্যোগে সর্বোপরি স্রষ্টার ইচ্ছেয় মনে হলো এ যাত্রায় পার পেয়ে গেলাম। থানচিতে এসে রবি ঠাকুরের কথাটিই বার বার মুখে দোল খাচ্ছিল- ‘মরিতে চাহিনা আমি সুন্দর ভুবনে, মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।’

থানচি বিদায় দিয়ে গন্তব্য এবার ঢাকার পথে। প্রকৃতির যে নির্যাস-রসদ পেয়েছি তা দীর্ঘদিন শক্তি সঞ্চারিত করবে বলে মনে হয়। দেশের ট্যুরিজম খাতকে এগিয়ে নেওয়ার অগ্রগামিতায় ভূমিকা রাখার জন্য কৃতুজ্ঞতা ট্যুর গ্রুপ বিডি কে ও ধন্যবাদ আমিয়াখুম ট্রিপের সার্বিক তত্ত্বাবধায়ক ইমরান উল আলমের আন্তরিকতার জন্য। বিশেষত নিম্নোক্ত বচনের জন্য- ‘ভাইয়া খান কিছু দেই।’ সৌজন্যে: এনটিভি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *