Skip to content

প্রজাপতির পাহাড়

:: গাজী মুনছুর আজিজ ::

পাহাড়ের চূড়া দিয়ে হাঁটি। কিছুটা হাঁটার পর কোয়ান্টামের খেলার মাঠ দেখি। মাঠের এক কোণে সাইনবোর্ডে লেখা ‘গ্রাউন্ড অলিম্পিয়ান, অলিম্পিকে সোনা আমরা জিতবোই’। ভালো লাগলো এমন স্বপ্নের লেখা দেখে। চূড়ার ঢালে আনারসসহ নানা প্রজাতির ফলের বাগান আছে পাহাড়ের চূড়ায় ছাউনিওয়ালা ঘর। ঘরের চারপাশে আর কিছু নেই। শুধু দূরে দেখা যায় অন্য আরও পাহাড়।

নির্জন পাহাড়ের চূড়ায় এ ছাউনিওয়ালা ঘর মূলত ধ্যানের জন্য। এ ধ্যানঘর বান্দরবানের লামার সরইয়ের বোধিছড়ায়। আর জায়গাটি কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের।

বন্ধু সাইফের আমন্ত্রণে তার সঙ্গে শীতের এক সকালে উপস্থিত হই বোধিছড়া। পাহাড়ের চূড়ার এক ভাঁজে তৈরি রুমে আমাদের থাকার ব্যবস্থা হল। রুমে ঢুকে ব্যাগ রেখে আসি নাশতা খেতে। বিশাল খাবার ঘর। এত বড় খাবার ঘর কমই দেখেছি এর আগে। নাশতা সবজি দিয়ে খিচুড়ি, সঙ্গে ডিম। বেশ স্বাদের খাবার।

নাশতা শেষে বের হই সাইফের সঙ্গে। পাহাড়ের চূড়া দিয়ে হাঁটি। পথে দেখি কোয়ান্টাম ব্যাম্বোরিয়াম। আসলে এটি বাঁশের বাগান। এ বাগানে অনেক প্রজাতির বাঁশঝাড় আছে। এ ছাড়া চূড়ার এ রাস্তার দুই পাশে আছে নানা প্রজাতির গাছগাছালি। বেশ কিছুক্ষণ হাঁটার পর আসি কসমো স্কুল অ্যান্ড কলেজের মাঠে। এখানে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।

দুর্গম এ পাহাড়ি চূড়ায় অনাথ, এতিম ও সুবিধাবঞ্চিতদের জন্য কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন গড়ে তুলেছে এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে এখানে বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটিসহ দেশের নানা সম্প্রদায়ের নৃগোষ্ঠী ও বাঙালি মিলে বিভিন্ন ধর্মের ১৬টি জাতিগোষ্ঠীর ৯৫৪ জন শিক্ষার্থী বিনা বেতনে থাকাসহ লেখাপড়া করছে।

তিন দিনের এ পুনর্মিলনীতে আলোচনা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, কৃতী শিক্ষার্থী সংবর্ধনা, কৃতি শিক্ষার্থীর মায়েদের রত্নাগর্ভা পুরস্কার, অভিভাবকদের সংবর্ধনা, মেডিটেশনবিষয়ক আলোকচিত্র প্রদর্শনী, শিক্ষার্থীদের আঁকা ছবির প্রদর্শনী, প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শনী, খেলাধুলাসহ নানা আয়োজন আছে।

পরের দিন সকালে বের হই চিচিংফাক নামক ঝরনা দেখার উদ্দেশে। সঙ্গে আছেন কামরুল। এখানকার পথঘাট তার চেনা। এখানে আসা অতিথিদের তিনিই আশপাশ ঘুরিয়ে দেখান।

ডলুছড়ির লামা রাবার বাগানের ভেতর দিয়ে আমরা হাঁটি। পাহাড়ের ঢালে এ রাবার বাগান বেশ বড়। দেখি শ্রমিকরা বাগানের গাছ থেকে রাবার সংগ্রহ করছেন। প্রতিটি রাবার গাছের গোড়া থেকে দুই-তিন ফুট উঁচুতে প্লাস্টিকের পাত্র বাঁধা আছে। আর চিকন করে গাছের বাকল কাটা। সেই কাটা স্থান থেকেই তরল রাবার বেয়ে পড়ছে প্লাস্টিকের পাত্রে। অনেকটা খেজুরের রস সংগ্রহের মতো।

বাগান পার হয়ে নামি পাহাড়ি ছড়ায়। শীতের সময় হওয়াতে ছড়ার পানি বেশ ঠাণ্ডা। দুই পাহাড়ের মাঝ দিয়ে নির্ঝন বনের এ পথে ঠাণ্ডা পানি দিয়ে দু’জন গল্প করতে করতে হাঁটছি।

আশপাশের গাছে বেশ কিছু প্রজাতির পাখি দেখি। দূর থেকে কিছু পাখির ডাকও শুনি। তবে নানা রঙের নানা প্রজাতির ছোট বড় অসংখ্য প্রজাপতির ওড়াউড়িও বেশ চোখে পড়ছে। মনে হচ্ছে এ পাহাড়, বন সব তাদের দখলে। সত্যিই নির্ঝন বনের এ প্রকৃতির সৌন্দর্য আর সঙ্গে পাখি-প্রজাপতির সঙ্গে অন্যরকম উপভোগ্য।

চিচিংফাক ঝরনার কাছাকাছি পথটুকু দুই পাহাড়ের মাঝ দিয়ে খুবই সরু। আবার কোমর সমান পানি। অনেকটা গুহার মতো। এ গুহার মতো পথে কোমর সমান পানি পাড়ি দিয়ে অবশেষে পৌঁছি চিচিংফাক ঝরনায়। কিছুক্ষণ থেকে আবার ফিরতে শুরু করি। বিকালে আবার আসি পুনর্মিলন অনুষ্ঠানে। সেখান থেকে রাতে ফিরি রুমে।

পরের দিনের গন্তব্য আবে শেফা ঝরনা। যথারীতি গাইড কামরুল। বের হই সকালে। পাহাড়ের চূড়া দিয়ে হাঁটি। কিছুটা হাঁটার পর কোয়ান্টামের খেলার মাঠ দেখি। মাঠের এক কোণে সাইনবোর্ডে লেখা ‘গ্রাউন্ড অলিম্পিয়ান, অলিম্পিকে সোনা আমরা জিতবোই’। ভালো লাগলো এমন স্বপ্নের লেখা দেখে। চূড়ার ঢালে আনারসসহ নানা প্রজাতির ফলের বাগান আছে।

এ বাগানও কোয়ান্টামের। বাগানের ভেতর দিয়েই হাঁটছি। কিছুক্ষণ হাঁটার পর বিশ্রাম নিই বাঁশের মাচা আর ছাউনি দেয়া ছোট্ট বৈঠকখানায়। চূড়ার ওপর এ বৈঠকখানা মূলত ধ্যানের জন্য। আমরাও কিছুক্ষণ বসে ধ্যান করি। তারপর আবার হাঁটা শুরু করি।

পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে আদিবাসীদের ঘরবাড়ি আছে। বাঁশের মাচার ওপর তৈরি এসব ঘর বাঁশ, পাতাসহ নানা উপকরণ দিয়ে তৈরি। আমরা একটি ঘরে উঠি। দেখি আদিবাসী পরিবারটি দুপুরের খাবার খাচ্ছেন। বেশ কিছুক্ষণ হাঁটার পর চোখে পড়ে পাহাড়ি লেক। এক সময় পাহাড় ছেড়ে নামি আবে শেফা ঝরনার ছড়ায়।

নির্ঝন বনে ঠাণ্ডা পানির ছড়া দিয়ে হাঁটি আমরা। পাখির কিচিরমিচির আর বনের নির্জনতা সঙ্গী করে সামনে এগোই। গহিন বনের আঁকাবাঁকা এ ছড়ায় অনেকক্ষণ হাঁটার পর কামরুল জানায় ঝরনা খুঁজে পাওয়া কষ্টকর হবে, সুতরাং ফেরা যাক।

তার কথামতো ফিরতে শুরু করি। ফেরার পথে ছোট বড় অনেক প্রজাতির অসংখ্য প্রজাপতির ওড়াউড়ি দেখি। প্রতিটা প্রজাপতির পাখাই নানা রঙের, দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যায়। ওদের ওড়াউড়ি দেখে মনে হয় সত্যিই এ পাহাড় ওদের। সৌজন্যে : যুগান্তর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *