Skip to content

প্রাচীন স্থাপত্যের নিদর্শন আহসান মঞ্জিল

ঢাকার প্রাচীন স্থাপত্যের মধ্যে আহসান মঞ্জিল অন্যতম। আহসান মঞ্জিল বাংলাদেশের ইতিহাসকে করেছে সমৃদ্ধ। ঢাকার ইতিহাস ঐতিহ্যের নীরব সাক্ষী এই আহসান মঞ্জিল। লিখেছেন শওকত আলী রতন

Ahsan Monjil

আহসান মঞ্জিল হলো ঢাকার নওয়াবদের আবাসিক প্রাসাদ এবং জমিদারির সদর কাচারি। ঢাকা মহানগরীর দক্ষিণাংশে বুড়িগঙ্গা নদীর উত্তর তীরে অবস্থিত আহসান মঞ্জিল। প্রাসাদটি নওয়াববাড়ি নামে পরিচিত। স্থানটি বর্তমানে ইসলামপুরের কুমারটুলী মহল্লা নামে অভিহিত।

মোগল আমলে এখানে খ্যাতনামা জমিদার শেখ ইনায়েতউল্লাহর বাগানবাড়ি ছিল। তার ছেলে মতিউল্লাহর কাছ থেকে ১৭৪০ সালের দিকে বাগানবাড়িটি কিনে নিয়ে ফরাসি বণিকেরা এখানে বাণিজ্যকুঠি নির্মাণ করেন। ১৭৫৭ সালে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতনের পর ইংরেজরা কুঠিবাড়িটি দখল করে নেয়। দীর্ঘ দিন পর ফরাসিরা কুঠিবাড়িটি বিক্রি করে দেয় এবং ১৮৩০ সালে ঢাকার খ্যাতনামা জমিদার খাজা আলীমুল্লাহ এটি কিনে নেন।
খাজা আলীমুল্লাহ কুঠিবাড়িটি ভালোভাবে সংস্কার করেন এবং বেগমবাজারের পৈতৃক নিবাস থেকে উঠে এসে এখানে বসবাস শুরু করেন। ১৮৩০-এর দশকে এক অজানা ইউরোপীয় চিত্রশিল্পী ও তার সহযোগীরা বুড়িগঙ্গা নদীর তীর ধরে ঢাকা নগরীর অনেক দৃশ্য এঁকেছিলেন। জলরঙে আঁকা সেই চমৎকার চিত্রগুলো প্যানোরমা অব ঢাকা নামে ১৮৪০ সালে লন্ডন থেকে প্রকাশিত হয়।
১৮৫৪ সালে খাজা আলীমুল্লাহ ইন্তেকাল করলে তার ছেলে খাজা আবদুল গনি পরিবারের কর্তৃত্ব গ্রহণ করেন। খাজা আবদুল গনি খুবই বুদ্ধিমান ও কর্মঠ ছিলেন। তিনি পারিবারিক সহায়-সম্পত্তি চার-পাঁচ গুণ বৃদ্ধি করেন। তার সময় ঢাকার খাজা পরিবার উন্নতির চরম শিখরে ওঠে। জনকল্যাণমূলক কাজ এবং রাজানুগত্যের দরুন ইংরেজ সরকার খাজা আবদুল গনিকে নওয়াব বাহাদুর উপাধি দেয় এবং উপাধিটি বংশানুক্রমে ব্যবহারের অনুমতি দেয়। নওয়াব খাজা আবদুল গনি তার আবাসিক প্রাসাদটি বৃহদাকারে এবং জমকালোভাবে নির্মাণের পরিকল্পনা করেন। কলকাতার বিখ্যাত নির্মাণপ্রতিষ্ঠান মার্টিন অ্যান্ড কোম্পানিকে এ কাজে নিযুক্ত করা হয়। ফরাসি কুঠির পূর্ব পাশে বৃহৎ কলেবরে দ্বিতল আকারে নতুন বৈশিষ্ট্যে নতুন প্রাসাদ ভবনটি তৈরি করা হয়। ১৮৫৯ সালে এর নির্মাণকাজ শুরু হয়। নওয়াব খাজা আবদুল গনি তার প্রিয় ছেলে খাজা আহসানুল্লাহর নামে প্রাসাদটির নামকরণ করেন আহসান মঞ্জিল। নতুন ভবনটি নির্মাণের ফলে এর পশ্চিম দিকে থাকা ফরাসি আমলের গৌণ রূপ পায়। প্রাসাদের দক্ষিণে বুড়িগঙ্গার দিকে নির্মিত বারান্দা দিয়ে দোতলা থেকে যে বৃহদাকার খোলা সিঁড়ি সামনের ফুল বাগানে নামানো হয় সেটা খুবই চমৎকার। তবে বর্তমানে দৃশ্যমান সুদৃশ্য গম্বুজটি তখন এর ওপর ছিল না। ১৮৮৮ সালের ৭ এপ্রিল সন্ধ্যায় ঢাকা শহরের ওপর দিয়ে এক প্রবল ঘূর্ণিঝড় বয়ে যায়। ঝড়ে বুড়িগঙ্গার পানি বড় বড় নৌকাসহ শহরের ওপর উঠে এসেছিল, এতে ঢাকা শহর ও আহসান মঞ্জিলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল। ঝড়ের সময় বজ্রপাতের বিদ্যুতে প্রাসাদটি বিদ্যুতায়িত হয়ে যায় এবং এর লোহার গ্রিলগুলো গলে যায় এবং ছাদ উড়ে যায়। ফরাসি বণিকদের আমলে তৈরি কুঠিবাড়িটি ভেঙে একেবারে গুঁড়িয়ে পড়ে। ঝড়ে নওয়াববাড়িতে চারজন মারা যান এবং সারা শহরে মৃতের সংখ্যা ছিল উল্লেখযোগ্য।
ঘূর্ণিঝড়ের পর নবাব খাজা আহসানুল্লাহ (১৮৪৬-১৯০১) প্রাসাদটি নতুন আঙ্গিকে সংস্কার ও পুনর্নির্মাণ করেন। নওয়াব বাহাদুর তখন ইংরেজ সাহেবদের বদলে দেশীয় ইঞ্জিনিয়ার বাবু গোবিন্দ চন্দ্র রায়কে এ কাজে নিযুক্ত করেন। এ পুনর্নির্মাণকালেই সুদৃশ্য গম্বুজটি প্রাসাদের ওপর স্থাপন করা হয়। ফরাসিদের তৈরি কুঠিবাড়ি ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে সেখানে নতুন করে বর্তমানে অন্দরমহল নির্মাণ করা হয়।
আহসান মঞ্জিলের অন্দরমহলটিও দ্বিতলাকারে নির্মিত। দক্ষিণ দিকে উন্মুক্ত খিলান সহযোগে নির্মিত খোলা বারান্দা এবং ছাদের ওপরে সুদৃশ্য প্যারাপেট দিয়ে অন্দরমহলটিকে প্রাসাদ ভবনের পাশে মানানসই রূপ দেয়া হয়।
অন্দরমহলটি উত্তর কোঠা এবং দক্ষিণ কোঠা নামে দু’টি অংশে বিভক্ত।
বাংলাদেশের ইতিহাসের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সাথে আহসান মঞ্জিল প্রাসাদ বিশেষভাবে জড়িত। উনিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে পরবর্তী এক শ’ বছর ধরে পূর্ব বাংলার মুসলমানদেরকে এ প্রাসাদ থেকেই নেতৃত্ব দেয়া হতো। রাজনৈতিক ছাড়াও সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় কার্যকলাপেও তারা নওয়াববাড়ি থেকে নির্দেশনা ও সহায়তা পেত।
জমিদারি উচ্ছেদ আইন অনুযায়ী সরকার ১৯৫২ সালে ঢাকা নবার এস্টেট অধিগ্রহণ করলে আহসান মঞ্জিলে দুর্দিন শুরু হয়। অর্থাভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করতে না পেরে নওয়াব পরিবারের লোকেরা এই প্রাসাদ ছেড়ে অন্যত্র চলে যান। পরে আহসান মঞ্জিলের ঐতিহাসিক গুরুত্ব এবং স্থাপত্যিক সৌন্দর্যের কথা বিবেচনা করে পাকিস্তান আমল থেকেই সরকার আহসান মঞ্জিল রক্ষণাবেক্ষণের পরিকল্পনা করে। ৯০-এর দশকে আহসান মঞ্জিলকে জাদুঘরে রূপান্তর করা হয়। এর পর থেকেই আহসান মঞ্জিল জাদুঘর হিসেবে সাধারণ দর্শনার্থীদের জন্য খুলে দেয়া হয়। আহসান মঞ্জিলে ৩১টি কক্ষের মধ্যে ২৫টি কক্ষে নওয়াবদের ব্যবহৃত মূল্যবান তৈজসপত্র দিয়ে সাজানো হয়েছে। জাদুঘরে রক্ষিত রয়েছে নওয়াবদের আমলে ব্যবহৃত আসবাবপত্রসহ মূল্যবান অন্য সব জিনিস। আহসান মঞ্জিলে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রতিদিন শত শত দর্শনার্থী আসেন এখানে। একজন দর্শনার্থী প্রবেশ ফি ধরা হয়েছে মাত্র ১০ টাকা। আহসান মঞ্জিল প্রতিদিন খোলা থাকে সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত। বৃহস্পতিবার পূর্ণ দিবস বন্ধ থাকে আহসান মঞ্জিল।
পিকনিক স্পটের জন্য ভাড়া দেয়া হয় ঐতিহাসিক এ স্থানটি। তাই ভ্রমণপিপাসু অসংখ্য মানুষ আহসান মঞ্জিল সম্পর্কে জানতে ছুটে আসেন দূর-দূরান্ত থেকে।
সূত্র : নয়া দিগন্ত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *