বাবর আলী
ছিয় দিনের এক অভিযানে গিয়েছিলাম বান্দরবান। সেটি শেষ করে রুমাবাজারে মোবাইল নেটওয়ার্কের রাজ্যে আসতে না আসতেই চট্টগ্রাম থেকে জীবন ভাইয়ের ফোন। কথায় কথায় জানালেন, পরের দিন বান্দরবান আসছেন তাঁরা। বান্দরবান শহর থেকে অল্প দূরেই একটি লেকের পাড়ে ক্যাম্পিং করার প্ল্যান। যদিও ক্যাম্পিং করা যাবে কি না তা নিয়ে সন্দিহান খোদ জীবন ভাই-ই। আগেও একবার নাকি ওই লেকে ক্যাম্পিং করার চেষ্টা করে বিফল হয়েছিলেন তিনি। ‘অনিশ্চিত ক্যাম্পিং’ বিষয়টা মাথায় রেখেই এবারও আমরা থাকব কি না সেটি জিজ্ঞেস করলেন। দলের অন্য সবার সঙ্গে আলাপ করে জানিয়ে দিলাম, ‘আছি আমরাও।’
পরদিন রুমাবাজার থেকে দিনের দ্বিতীয় বাস ধরে বান্দরবান শহরে পৌঁছতে না পৌঁছতেই প্রায় দুপুর। তাজিনডং রেস্তোরাঁয় ভরপেট সাঁটিয়ে সিএনজি ভাড়া করে ফেললাম। গন্তব্য প্রান্তিক লেক। বান্দরবান আর চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলার সীমানা ঘেঁষে ওটার অবস্থান। বান্দরবান-চট্টগ্রাম হাইওয়ের হলুদিয়া বাজার থেকে পূর্ব দিকে সিএনজির চাকা গড়াতেই দেখা মিলল কাঁচা রাস্তার। ঝাঁকুনি খেতে খেতে একসময় হাজিরও হয়ে গেলাম লেকের গেটে। বিসমিল্লাহতেই গলদ! লেকের ভেতরে ঢুকতে যেতেই বাধা। লেক ও এর আশপাশে জেলা পরিষদের অর্থায়নে চলছে সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ। অতএব, প্রবেশ নিষেধ! আগে থেকেই অপেক্ষমাণ তানভীর ভাই ও তারিক ভাইয়ের কল্যাণে সে যাত্রা রক্ষে হলো। তাঁরাই ব্যবস্থা করলেন ভেতরে ঢোকার। গেট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতেই দেখা মিলল ইট বিছানো উঁচু-নিচু রাস্তার। ওটা আবার গিয়ে মিশেছে ছোট্ট একটি ওয়াচ টাওয়ারে। কিছুক্ষণ ওয়াচ টাওয়ারে কাটিয়ে লেকের অপর পাশে যাওয়ার রাস্তাটা ধরলাম। ওয়াচ টাওয়ারের ঠিক বিপরীত প্রান্তে উঁকি দিচ্ছে ছোট্ট কিন্তু সুদৃশ্য এক কাঠের জেটি। লেকের তলদেশ থেকে মোটা গাছের গুঁড়ি উঠে এসে ধরে রেখেছে বাঁকানো জেটিটাকে। ওটার সঙ্গেই গা ঘেঁষে থাকা কাঠের নৌকাটাও ছোট্ট।
ব্যাক-প্যাক আর তাঁবুগুলো কোনোরকমে পিঠ থেকে নামিয়েই নৌকায় চড়ে বসলেন মানসদা-বিপ্লবরা। আর বাকিরা বসে পড়লাম জেটিতে, পা ঝুলিয়ে। লেকটিকে চারপাশ থেকে ঘিরে রেখেছে উঁচু টিলা। লেকের পাড়ের সৌন্দর্য বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে টিলার ওপর সার বেঁধে লাগানো জানা-অজানা গাছের সারি। দূর থেকে দেখলে মনে হবে যেন গাছগুলো মিছিল করতে করতে এগিয়ে আসছে। লেকটা বেশ শান্তস্নিগ্ধ আর টলটলে পানির। শেষ বিকেলে পরিবারসমেত লেকে বেড়াতে এলেন বান্দরবানের জেলা প্রশাসক। বেশ কিছুক্ষণ এদিক-সেদিক ঘুরে, নৌবিহার করে তিনি ধরলেন ফেরার পথ।
সন্ধ্যার আগে আগে আমাদের কয়েকজন বেরোল শুকনো গাছের ডাল-পালা আর পাতা কুড়াতে। ক্যাম্পফায়ার করতে হবে যে! যদিও ক্যাম্পিংয়ের বিষয়টি তখনো পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া যায়নি। লেকের কেয়ারটেকার চাচাকে ডেকে বলা হলো আমাদের মহান (!) উদ্দেশ্যের কথা। তিনি প্রশাসনিক বিধিনিষেধগুলোর কথা তুলে ধরলেন। স্থানীয় সংসদ সদস্যের ভাগ্নে জুয়েল ভাই আমাদের সঙ্গী হওয়ায় সেসব আর কল্কে পেল না।
সন্ধ্যা নামতেই আরিফ ভাই আর রাশিক মিলে জেটি থেকে একটু অল্প দূরে ধরিয়ে ফেলল ক্যাম্পফায়ারটা। আর ফারাবীকে সঙ্গে নিয়ে জেটির এক কোণে তাঁবুগুলো খাটিয়ে ফেললাম। খাবারের দায়িত্ব বর্তাল লেকের কেয়ারটেকার চাচার ওপর। তাঁর হাতে বাজার করার টাকাটা বুঝিয়ে দিয়ে যে যার মতো জেটিতে শুয়ে-বসে তারা দেখায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল। পায়ের তলায় ঠাণ্ডা জলের নীলাভ লেক আর মাথার ওপর মিটিমিটি তারাভর্তি সুবিশাল আকাশ। আর কী লাগে এই জীবনে!
একটু পরে জুয়েল ভাই আর লিটন ভাইয়ের নেতৃত্বে শুরু হলো ‘ওপেন এয়ার কনসার্ট’। বাদ পড়লেন না নামি-বেনামি কোনো গায়ক-গায়িকাই। এর মধ্যেই অবশ্য একদল এই অন্ধকারেও নৌবিহারে ব্যস্ত। লেকের ওপার থেকে কেয়ারটেকার চাচার টর্চলাইটের সিগন্যাল দেখে বুঝলাম, ডিনারের ডাক পড়েছে। চাচার কুঁড়েটার অবস্থান প্রান্তিক লেকের একেবারে শেষ প্রান্তে। হেঁটে গেলে বেশ একটু ঘুরপথে যাওয়া লাগবে। সবাই হেঁটে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও বিপ্লব নাকি নৌকায়ই যাবে। সঙ্গী হওয়ার জন্য অনুরোধ করল আমাকে। সে আমন্ত্রণ অবশ্য আমার হেডল্যাম্পের জন্য। এই শীতের রাতে পানিতে পড়লে নির্ঘাত কেলেঙ্কারি হবে—বিষয়টা মাথায় আসায় নৌকায় ওঠার চিন্তা মাথা থেকে পুরোপুরি ঝেড়ে ফেললাম। প্রত্যাখ্যাত (!) হয়ে বিপ্লব ‘একলা বৈঠা বাও রে’ নীতি গ্রহণ করলেও শেষ মুহূর্তে ফারাবীর মুখে কপিলা স্টাইলে ‘আমারে লগে নিবা মাঝি’ ডায়ালগ শুনে তাঁকেও সঙ্গী করল।
ঘুরপথে হেঁটে চাচার কুঁড়েতে যাওয়ার সময় একবার পথ হারালাম। শেষমেশ উদ্ধারে এগিয়ে এলো চাচার সেই টর্চলাইটই। রাতের খাবারের মেন্যু ‘খিচুড়ি উইথ ডিম’। খাবার মুখে দিতেই মনে হলো কে যেন মুখে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। ভয়াবহ রকমের ঝালে চোখের পানি-নাকের পানি এক হওয়ার জোগাড়। ডানে-বাঁয়ে তাকিয়ে দেখি, সবার একই অবস্থা। ফলাফল মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই ঘরের সব পানি শেষ। অত রাতে পাশের ঝিরি থেকে খাওয়ার পানি আনতে চাচাকেই ছুটতে হলো।
জেটিতে ফিরে এসে আবার শুরু হলো আড্ডা। দেশ, জাতি, সংস্কৃতি, রাজনীতি, ভার্চুয়াল লাইফ—বাঙালি আড্ডার জন্য তো বিষয়বস্তুর অভাব নেই! রাত আর ঠাণ্ডা একটু বাড়তেই সেঁধিয়ে পড়লাম তাঁবুর ভেতর। পাশের তাঁবুতে বিপ্লব আর রাশিকের নাসিকা গর্জনের সিম্ফনি শুনতে শুনতেই হাজির হলাম ঘুমের দেশে!
সকালে অনেকেরই অফিস আছে, তাই বেশ সকাল সকাল বেরিয়ে পড়ার প্ল্যান। তানভীর ভাইয়ের ধাক্কাধাক্কিতে ঘুম ভাঙলেও স্লিপিং ব্যাগের মায়া ছাড়তে ইচ্ছা হলো না। ট্রিপে এসেও যদি একটু খেয়ালখুশিমতো ঘুমোতে না পারি, তাহলে কেমনটা লাগে বলুন! তাঁবু থেকে দুই পা ফেলে ছোট্ট জেটিটার শেষ মাথায় গিয়ে দাঁড়াতেই মনটা ভালো হয়ে গেল। সুনসান লেকের মোহময় এক পরিবেশ। সকালে হাজারো পাখির কলতান। আহা! এর জন্যই বোধ হয় ‘লাইফ ইজ বিউটিফুল’। তবে এই ‘বিউটিফুল’ভাবটা আর বেশিক্ষণ সহ্য হলো না। সঙ্গীদের তাড়ায় অল্প সময়ের মধ্যেই তাঁবু গুটিয়ে ধরতে হলো বাড়ি ফেরার পথ।
কিভাবে যাবেন
বান্দরবান-চট্টগ্রাম সড়কের বাজালিয়া বাসস্ট্যান্ডের পরের স্টপেজ হলুদিয়া বাজার। এখানে নেমে লোকাল বা রিজার্ভ সিএনজিযোগে যেতে পারেন প্রান্তিক লেকে। রিজার্ভ সিএনজিতে ভাড়া পড়বে ১০০-১২০ টাকা। অথবা বান্দরবান শহর থেকেও রিজার্ভ সিএনজিযোগে প্রান্তিক লেকে আসতে পারেন। সে ক্ষেত্রে ভাড়া ২৫০-৩০০ টাকা। আর এখানে ক্যাম্পিং করতে চাইলে ডিসি অফিস থেকে আগেই অনুমতি নিতে হবে। সৌজন্যে : কালের কণ্ঠ