১৯২০-এর দশকে বানানো হয়েছিল হলিউডের ইতিহাসের অন্যতম বিশাল সিনেমার সেট। সমুদ্রপাড়ের বালিয়াড়িতে বানানো সেই সেটটি ছিল ফারাওদের সময়ের আস্ত এক মিসরীয় শহরের নকল। শুটিং শেষেই সে শহর নাকি কর্পূরের মতো উবেও গিয়েছিল। হারানো সেই নকল শহর আর তা খুঁজে পাওয়ার কাহিনী শোনাচ্ছেন নাবীল অনুসূর্য
হলিউডের মহাকাব্যিক সেই সিনেমাটির নাম ‘দ্য টেন কমান্ডমেন্টস’। বাইবেলে বর্ণিত বিখ্যাত টেন কমান্ডমেন্টস-এর কাহিনী নিয়ে বানানো প্রথম সিনেমা এটি। ১৯২৩ সালে সিনেমাটি বানিয়েছিলেন তারকা পরিচালক সিসিল বি ডেমিল। (এটি নির্বাক ছবি। সবাক যুগে পদার্পণের পর ডেমিল একই নামে আরেকটি ছাব বানিয়েছিলেন ১৯৫৬ সালে)। এই তারকা পরিচালকের তখন সময়টা ভালো যাচ্ছিল না। সে খারাপ সময়ের অবসান ঘটান ১৯২২ সালের ‘জোয়ান দ্য ওম্যান’ ও ‘মেল অ্যান্ড ফিমেল’ সিনেমা দুটি দিয়ে।
‘দ্য টেন কমান্ডমেন্টস’ বানানোটা ছিল তাঁর তারকা-খ্যাতিতে ফিরে আসার লড়াই। তার জন্য চাই দর্শক-সমালোচকদের চমকে দেওয়ার মতো উপকরণ। তা তিনি ভালোই রেখেছিলেন। মিসরের রহস্যময় ফারাও রাজাদের সময়ের প্রেক্ষাপট, তাতে আবার মোজেস-এর বিখ্যাত ধর্মীয় কাহিনী। এর সঙ্গে খানিকটা ভিজুয়াল জাদু জুড়ে দিলেই হলো। তখন তো শুটিংয়ের পর স্পেশাল ইফেক্ট ব্যবহারের সুযোগ ছিল না। যা কারিকুরি করতে হতো সেট বানানোতেই। ডেমিল প্রথমে ভাবলেন, শুটিং করবেন মিসরেই। কিন্তু এত বড় দল নিয়ে মিসরে যাওয়ার কষ্ট না করে বরং আমেরিকায়ই একটা প্রাচীন মিসরীয় নগর বানিয়ে বসলেন।
সেট বানাতে ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের সান্তা বারবারা কাউন্টির গদালোপের বালিয়াড়িতে নিয়ে যাওয়া হলো দেড় হাজার শ্রমিক। শুধু পেরেকই লাগল ১২ হাজার কেজিরও বেশি। প্লাস্টার অব প্যারিস দিয়ে বানানো হলো আস্ত একটা শহর। তৈরি হলো ১২০ ফুট লম্বা আর ৮০০ ফুট চওড়া মন্দির। শহরের দেয়াল বানানো হলো ৭৫০ ফুট। তৈরি হয়েছিল ডজনখানেক স্ফিংক্সে মূর্তি, আটটি বিশালকায় সিংহ, তৃতীয় ফারাও রাজা রামিসেস দ্বিতীয়ের ৩৫ ফুট উঁচু ও ৪০ টন ওজনের চারটি মূর্তি, আরো কত কী!
অভিনেতা-অভিনেত্রী-এক্সট্রা আর অন্য কলাকুশলী মিলিয়ে প্রায় পাঁচ হাজার মানুষের দল। তাদের থাকার বন্দোবস্ত করতে গিয়ে ২৪ বর্গমাইলের একটা তাঁবুর শহরই দাঁড়িয়ে গেল। লোকমুখে তার নাম হয়ে গেল ‘ডেমিলের শহর’। সবাইকে প্রতিদিন খাওয়াতেই প্রযোজকদের নাভিশ্বাস উঠে গেল। তার ওপর ডেমিল দুই হাতে খরচ করছিলেন। একদল ঘোড়াই কিনলেন তিন হাজার ডলার দিয়ে। তাতে রেগেমেগে শেষে প্রযোজনা সংস্থা প্যারামাউন্ট পিকচার্স টাকা দেওয়াই বন্ধ করে দিল। তখন ডেমিল ধার করে এনে কাজ চালাতে শুরু করলেন।
সেট বানানো শেষ হলে দ্রুতই শুটিং শেষ করলেন ডেমিল। আর তা করলেন তিন সপ্তাহর মধ্যে। এরপর আরেকটি সমস্যা দেখা দিল। চুক্তি অনুযায়ী শুটিং শেষে ওখানে কোনো স্থাপনা থাকার কথা নয়। তার চেয়ে বড় কথা, এগুলো থাকলে সেগুলো ব্যবহার করতে পারেন তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী পরিচালকরাও। তাই ডিনামাইট দিয়ে গুঁড়িয়ে দিলেন পুরো সেট। পরে নাকি বুলডোজারও চালিয়েছিলেন। একসময় মানুষ ভুলে গেল এই নকল শহরের কথা। কেটে গেল ৫৯টি বছর। নকলের শহরের উদ্ধারের বাকি গল্পটা শুরু পিটার ব্রসনান থেকে। সে ১৯৮২ সালের কথা। ব্রসনানের এক বন্ধু তাঁকে শোনাল ডেমিলের সেই শহরের ধ্বংসাবশেষেরই গল্প। তখন তিনি মাত্র ফিল্ম স্কুল থেকে পাস করেছেন। পরিচালনার স্বপ্নে বিভোর। ভাবলেন, ডকুমেন্টারির জন্য এর চেয়ে ভালো প্লট আর কী হতে পারে! নেমে পড়লেন কাজে। স্থানীয় এয়ার ফোর্স বেজের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। ওখানকার লাইব্রেরিগুলোতে হন্যে হয়ে ঘুরলেন। স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে কথা বললেন। কিন্তু কিছুতেই কোনো খোঁজ পাওয়া গেল না।
যখন আশা ছেড়েই দিচ্ছিলেন, তখন এক শুঁড়িখানায় পরিচয় এক র্যাঞ্চারের সঙ্গে। সে তাঁর সঙ্গে বালিয়াড়ি ঘুরে ঘুরে ধ্বংসাবশেষ খুঁজতে রাজি হলো। এবার ভাগ্যও সহায় হলো। এক ভীষণ ঝড়ে বালিয়াড়ির বালিও ওলটপালট হলো। আর তাঁরাও ঘুরতে ঘুরতে এক জায়গায় দেখতে পেলেন, প্যারিস প্লাস্টারের কী যেন উঁকি মারছে। ব্রসনানের এই আবিষ্কার, যাকে বলে পুরো দেশকেই শিহরিত করল। তার ডকুমেন্টারির ভাবনার পালেও জোর হাওয়া লাগল। অনেকেই ডেমিলের হারানো শহরটি উদ্ধারে টাকা-পয়সা নিয়ে এগিয়ে এলো। টাকা দেওয়ার কথা জানাল প্যারামাউন্ট পিকচার্স আর ব্যাংক অব আমেরিকাও। স্থানীয় পুরাতাত্ত্বিক, স্মিথসোনিয়ান জাদুঘরের কিউরেটর খননকাজে সাহায্যের আগ্রহ দেখাল। কিন্তু বাদ সাধল অন্য একটি আইন। বালিয়াড়িটি পরিবেশগত কারণে সংরক্ষিত এলাকা। কাজেই সেখানে খননের অনুমতি সহজে মিলল না। সাত বছর পর যখন তিনি খননের অনুমতি পেলেন, তত দিনে ফান্ডিং চলে গেছে। ১৯৯০ সালে স্মিথসোনিয়ান জাদুঘর, ডেমিল ফ্যামিলি ট্রাস্টের মতো বেশ কয়েকটি সংগঠন এগিয়ে এলেও, তাতে খনন করার মতো টাকা উঠল না।
শেষ পর্যন্ত হাল ছাড়লেন পিটার ব্রসনান। আরো ১৫ বছর বালির নিচে শুয়ে রইল ডেমিলের নকল শহর। ২০১০ সালে এক রহস্যময় নারী ব্রসনানের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। জানান, যা টাকা লাগে তিনি দেবেন। হতাশ ব্রসনান অবশ্য না করে দিয়েছিলেন। কিন্তু গত শীতে ঠিকই কাজে নামেন তিনি। দলবল নিয়ে চলে যান ক্যালিফোর্নিয়ায়। প্রত্নতাত্ত্বিকদের লাগিয়ে দেন খননকাজে। পুরো কাজ অবশ্য করা হয়নি এ দফায়ও। কেবল স্ফিংঙ্গুলোই উদ্ধার করা হয়েছে।
ব্রসনান অবশ্য তাতেই বেশ খুশি। কারণ তাঁর ইচ্ছা ছিল, স্ফিংক্স উদ্ধারের দৃশ্য দেখিয়ে ডকুমেন্টারিটি শেষ করবেন। এবার অন্তত সেটুকু তো হয়েছে। এখন সেই ডকুমেন্টারিটির পোস্ট প্রোডাকশনের কাজই করছেন তিনি। ‘দ্য লস্ট সিটি অব সিসিল বি ডেমিল’ নামের প্রামাণ্যচিত্রটি সামনের বছরই মুক্তি পাওয়ার কথা। সৌজন্যে : কালের কণ্ঠ