প্রথম পর্তুগিজরা বসিয়েছিল আড়ত। কালে কালে বাজারও হয়েছে। জেটি হয়েছে চারটি। চট্টগ্রামের ফিরিঙ্গীবাজারের কাছে সামুদ্রিক মাছের বিরাট বাজার এই ফিশারি ঘাট। বেড়াতে গিয়েছিলেন ড. রিয়াজুল হক
সূর্য ওঠার আগেই উঠে গিয়েছিলাম। হাঁটা দিয়েছিলাম ফিশারি ঘাট। নিউ মার্কেটের মোড় থেকে পুব দিকে অল্প এগিয়ে ইকবাল রোডের মাঝামাঝি যেতেই আওয়াজ পাচ্ছিলাম। অনেক মানুষ কথা বললে যেমন শোরগোল হয়। মাছের আঁশটে গন্ধও এসে নাকে লাগল অল্প পরে। যারা পাহাড়তলী বা আরো কোনো স্থানীয় বাজারের খুচরা বিক্রেতা, তারা এরই মধ্যে কেনাকাটা সেরে ফেলেছে। হাঁটাও দিয়েছে জোর। আগেভাগে না পৌঁছলে মাছ শুকাবে, ক্রেতাও মিলবে না।
সরেজমিন সবিস্তার
মাছ বিক্রেতারা আক্ষরিক অর্থেই শোর মাচিয়েছে। কাঠের শক্ত টুকরা দিয়ে ভাঙছে বরফের চাঁই। ভোর ৫টায় শহরের আর কোনো জায়গা এত সরগরম থাকে বলে আমার জানা নেই। এখানকার প্রধান চরিত্র মাছ। সামুদ্রিক মাছ বললে বুঝি বেশি ভালো। মাছ ঘিরে জড়ো হয় ক্রেতা, বিক্রেতা, শ্রমিক, মুটে, চা ওয়ালা, পান ওয়ালা এবং আরো অনেক রকমের মানুষ। কিছু আড়ত আছে বড় রাস্তার ধারে, তবে বড় আড়তগুলো বাজারের ভেতরে। আড়তগুলোর মাঝের খোলা চত্বরে অধিকাংশ মাছ কেনাবেচা হয়। ফিশারি ঘাট কর্ণফুলী নদীর পশ্চিম তীরে। কয়েক শ ট্রলার নোঙর করে থাকতে দেখলাম। ট্রলারবাসী এখন আরাম করছে, কারণ তারা মাছ বুঝিয়ে দিয়েছে আড়তগুলোয়। তাই তারা কেউ শুয়ে, কেউ বা বসে আছে।
বাজারে যারা ব্যস্ত তাদের একদলের কর্মকাণ্ড এরকম—দরদাম হাঁকা, পাইকার (যাঁরা পাইকারি মাছ কেনেন) সামলানো, পান চিবানো। আরেক দল ডিজিটাল মাপার মেশিন নিয়ে বসেছে। আরেকটি দল মুটেদের। তারা ঠেলাগাড়িতে করে মাছ এদিক থেকে ওদিক নিয়ে যায়। যারা টুকরি মাথায় মাছ এক ঘর থেকে আরেক ঘরে পৌঁছায়, তাদের মাথায় পরা বিশেষ ধরনের টুপি। গুঁড়ো দুধ রাখার অ্যালুমিনিয়াম প্যাকেট কেটে বিশেষভাবে এ টুপি তৈরি হয়। চট্টগ্রামের বাজারগুলোতে যত মাছ মেলে, তার ৯০ ভাগ এ ঘাটে এসে ভেড়ে প্রথমে। এমনকি এ ঘাট থেকে মাছ সরবরাহ করা হয় দেশের উত্তরাঞ্চলেও। চারটি জেটি আছে ঘাটের। একটি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন পরিচালনা করে, বাকি তিনটি চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (চউক) লিজ দিয়েছে। ট্রলারগুলোকে প্রতি ট্রিপে ২০০ টাকা এবং বিক্রি হওয়া মাছের ২ শতাংশ দিতে হয় চউককে। এই বাজার কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বরফকল ও কোল্ড স্টোরেজ। খাবারের হোটেলও আছে কয়েকটি। প্রায় অর্ধলাখ মানুষের জীবিকা জড়িয়ে আছে এই বাজারের সঙ্গে। চট্টগ্রামের প্রায় ১০ হাজার ফিশিং বোট ও কয়েক শ ট্রলারের আহরিত মাছ বিক্রি হয় এই বাজারে। এখানে পাবেন লইট্যা, ফাইস্যা, কোরাল, বাটা, লাক্ষ্যা, সুরমা, তাইল্লা, মাইট্টা, চেউয়া, চিড়িং, শাপলাপাতা, ছুরি, পোয়া, চান্দা, চিংড়ি, আইল (বুলেট), বড় বড় গাঙ কই, মোছ কেডা, কেচকি, বোম, বাইন, বাইলা, হোন্দরা বাইলা, যাত্রিক, চাপিলা, ইলিশ, হাঙর, কাপিলাসহ আরো অনেক মাছ। কোনো মাছের ওজন ৫০ গ্রাম, কোনোটির বা ২০ কেজি। সব মাছ সব সময় পাওয়া না গেলেও লইট্যা, চিংড়ি, বাটা এবং কোরাল সব সময়ই পাওয়া যায়। মিঠা পানির মাছও ওঠে প্রচুর। এগুলোর বেশির ভাগ রুই, কার্ফ, মৃগেল, কাতল, পাঙ্গাশ, বিগহেড, শোল, টাকি, তেলাপিয়া, চিংড়ি ইত্যাদি।
বয়স্ক বাজার
প্রায় ২০০ বছর বয়স এই বাজারের। চট্টগ্রামে বাণিজ্য কুঠি স্থাপন এবং বন্দরের শুল্ক আদায়ের অধিকার পেয়ে পর্তুগিজরা এখানে আড়ত স্থাপন করে। ফিরিঙ্গীবাজার নামও হয়েছে তাদের কারণেই। ফিরিঙ্গীবাজার থেকে বেশি দূরে না এই মত্স্য অবতরণ কেন্দ্র, যা ফিশারি ঘাট নামে পরিচিত। সারা দেশ থেকেই পাইকারি ব্যবসায়ীরা এই বাজারে আসেন, তবে চাঁদপুরের ব্যবসায়ী বেশি। এখানে মিয়ানমার ও ভারত থেকেও মাছ আসে।
মাছ চক্কর
ব্যবসায়ী খোকন (৪৮) কয়েকটি শাপলাপাতা মাছ নিয়ে বসেছিলেন সড়কের পূর্ব পাশে। একটি ছোট আকারের হাঙরও ছিল তাঁর কাছে। জানান, পৈতৃকভাবে তাঁরা মাছের ব্যবসা করেন। তাঁর নিজেরই ৩০ বছর হয়ে গেল। চাঁদপুরের হাজীগঞ্জের বাবুল মিয়ার কাছে ছিল প্যাকেটকৃত কিছু রূপচাঁদা, ট্যাকচাঁদা এবং বড় আকারের লাল পোয়া মাছ।
একটি কম বয়সী ছেলে একটি বড় আকারের কোরাল মাছ নিয়ে যাচ্ছিল মাথায় করে। নাম বলল সুজন। জানাল, মাছটির ওজন ১৫-১৬ কেজি হবে, দাম ১৫ হাজার টাকা।
বালা সওদাগরের আরতের কর্মচারী পটিয়ার বাচ্চু একটি প্লাস্টিকের কেইসে বড় বড় চিংড়ি মাছ নিয়ে বসেছিলেন। একজন খুচরা বিক্রেতা ২৪ হাজার টাকায় কিনে নিলেন প্রায় দশ কেজি ওজনের মাছগুলো।
রাঙ্গা চোক্কা বিক্রি করছিলেন ফজল করিম। একেকটির ওজন প্রায় সাত কেজি। কেজিপ্রতি দাম ৩৫০ টাকা। চট্টগ্রাম শহরের ডবলমুরিং থানার মো. হোসেনের কাছে ছিল বোল পোয়া। কেজিপ্রতি দাম ৬৫০ টাকা। হারাধন সরকার লাল কোরাল এবং লম্বু কোরাল নিয়ে বসেছিলেন। লাল কোরালগুলোর প্রতিটির ওজন প্রায় পাঁচ কেজি। এগুলো বিক্রি করছিলেন ৪২০ টাকা কেজি দরে। লম্বু কোরালের প্রতিটির ওজন ১৪-১৫ কেজি। মণপ্রতি দাম ৪০ হাজার টাকা। কুমিল্লার ব্যবসায়ী সবুজের কাছে ছিল বড় বড় তাইল্লা, মোছ কেডা এবং দাঁতিনা কোরাল। আমি তাঁর কাছ থেকে পাঁচ কেজি ১০০ গ্রাম ওজনের একটি তাইল্লা ২৫৫০ টাকায় কিনে নিলাম। গলির মুখে মাছ কাটতে বসা সোহরাব মিয়াকে দিয়ে মাছটি কাটিয়ে নিয়ে বাসার উদ্দেশে রওনা হলাম। ছবি : লেখক, সৌজন্যে : কালের কণ্ঠ