Skip to content

বনের ঐতিহ্য শতবর্ষী মা গাছ

পুষ্পেন চৌধুরী লোহাগাড়া (চট্টগ্রাম)
সুস্থ সন্তানের জন্ম দিতে হলে মায়ের সুস্থতা জরুরি। কথাটা মানুষের ক্ষেত্রে যেমন সত্য, তেমনি গাছের ক্ষেত্রেও। সবল চারা উৎপাদনের জন্য প্রয়োজন সুস্থ বীজের জোগান, যার ভান্ডার হলো মা গাছ বা ‘মাদার ট্রি’।

চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার চুনতি অভয়ারণ্যে শতবর্ষী গর্জনগাছ l

চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার চুনতি অভয়ারণ্যে শতবর্ষী গর্জনগাছ l

চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার চুনতি অভয়ারণ্যে একসময় শতবর্ষী গর্জনগাছ ছিল অনেক। তবে ২০০৬-০৭ সালের জরিপ অনুযায়ী, সেখানে অবশিষ্ট শতবর্ষী গর্জনের সংখ্যা মাত্র ৮১৪টি। বিশেষজ্ঞদের ভাষ্য, এ রকম একেকটি গর্জন ‘মাদার ট্রি’ আশপাশের ২০ হেক্টর বনভূমিতে বীজ ছড়িয়ে দিতে পারে। অঙ্কুরোদ্গমের অনুকূল পরিবেশ বজায় থাকলে প্রতিটি গর্জন থেকে বছরে ১০-১৫ হাজার চারা পাওয়া যায়। প্রাকৃতিক উপায়ে বন সৃষ্টির স্বার্থে চুনতি অভয়ারণ্যে শতবর্ষী গর্জন ‘মাদার ট্রি’ সংরক্ষণ করা জরুরি হয়ে পড়েছে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশ বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের শিক্ষক মো. কামাল হোসাইন ও মো. আখতার হোসাইন বলেন, চুনতির মাটি গর্জনগাছের জন্য উপযুক্ত। এখানে একসময় গর্জনের ঘন প্রাকৃতিক বন ছিল। ১৯ হাজার ১৭৭ একরের এই প্রাণী অভয়ারণ্যে ৬৯১ প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে। তার মধ্যে গর্জনের প্রজাতি তিনটি: তেলিয়া গর্জন (Dipterocarpus turbinatus), ধলিয়া গর্জন (Dipterocarpus alatus) ও বাইট্যা গর্জন (Dipterocarpus costatus)। এক জরিপে অভয়ারণ্য এলাকায় গড়ে প্রতি হেক্টরে গর্জনের ওই তিন প্রজাতির ৩২২টি চারা পাওয়া গেছে। শতবর্ষী গর্জন বৃক্ষের কাছাকাছি জায়গায় প্রাকৃতিকভাবে চারা গজাতে দেখা যায়।

শতবর্ষী গর্জন সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে ওই দুই বিশেষজ্ঞ বলেন, বন বিভাগের প্রতি হেক্টর বাগান তৈরি করতে যেখানে ৩০-৪০ হাজার টাকা খরচ হয়, সেখানে এই শতবর্ষী গর্জনগাছ ও তার আশপাশ সুরক্ষিত করা গেলে লাখ লাখ চারা (সিস্ট) গজাবে। দেশীয় প্রজাতির চারাগুলো রেখে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে (Assisting Natural Regeneration) চারা রোপণ করলে বন বিভাগের চারা উত্তোলন ও বনায়নের জায়গা পরিষ্কার করা এবং চারা রোপণের সব খরচ বেঁচে যাবে। ফলে প্রাকৃতিকভাবে বন সৃষ্টি হবে এবং জীববৈচিত্র্যও বাড়বে। শতবর্ষী গর্জনগাছের আশপাশের জায়গা দেশীয় প্রজাতির অন্যান্য গাছের জন্য অনুকূল। এসব ‘মাদার ট্রি’ পাখি, বানরসহ বিভিন্ন প্রজাতির বন্য প্রাণীর নিরাপদ আবাস। এসব গাছ কমে যাওয়ায় অভয়ারণ্যের পশুপাখির সংখ্যাও কমেছে।

গবেষকেরা আরও বলেন, বন্য প্রাণীরা বাসস্থান ও খাবারের জন্য দেশীয় উদ্ভিদের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু চুনতি অভয়ারণ্যে আকাশমণি, মেনজিয়াম, সেগুন ইত্যাদি বিদেশি প্রজাতির উদ্ভিদ বেশি বেশি রোপণের ফলে এশিয়ান হাতি, বানর, হরিণসহ বিভিন্ন পশুপাখির আবাস সংকুচিত হয়েছে এবং এসব প্রাণীর খাদ্যসংকটও হচ্ছে। বিদেশি প্রজাতির উদ্ভিদ চুনতি অভয়ারণ্যের মাটির উর্বরতা শক্তি কমিয়ে দিতে পারে। পানের বরজের কারণেও ক্ষতি হচ্ছে বনের। বনে আগুন দেওয়া, গাছ কাটা ও রোহিঙ্গা বসতি স্থাপন এবং প্রভাবশালী ব্যক্তিদের দখল বন্ধ না করলে চুনতি অভয়ারণ্য একসময় হারিয়ে যাবে। শতবর্ষী গাছগুলো এখানকার বৃক্ষ প্রজাতির জীবন্ত ইতিহাসের চিহ্ন। এই বন রক্ষার জন্য বন বিভাগ, সহব্যবস্থাপনা কমিটি (সিএমসি) এবং বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার (এনজিও) আরও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।

২০১৩ সালে জামায়াত-শিবিরের সহিংসতার সময় কেটে ফেলা হয় একটি শতবর্ষী গর্জনগাছ। এ ছাড়া চোরাচালানিরা চুনতি রেঞ্জ এলাকা থেকে কেটে নিয়েছে এ রকম আরও দুটি গাছ। বন বিভাগ সূত্র জানায়, সহিংসতার শিকার ৫৫ ফুট উচ্চতার একটি শতবর্ষী গর্জনের গোড়ার দিকে কাণ্ডের বেড় ছিল ১০ ফুট ৮ ইঞ্চি। স্থানীয় অনেক শতবর্ষী গর্জনের বেড় ২০-২৫ ফুট পর্যন্ত হয়ে থাকে।

উদ্ভিদ বিশেষজ্ঞ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. আবদুল গফুর প্রথম আলোকে বলেন, শতবর্ষী গর্জনগাছের সংখ্যা কমে যাওয়ায় বনের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। গর্জন বৃক্ষের ওপরের স্তরে পাখিরা আশ্রয় নেয়। আর কাণ্ডসহ বিভিন্ন অংশে পোকামাকড় বসবাস করে, যা পাখিদের খাবার। মাটিতে পড়া গর্জনের অনেক ফল বিভিন্ন প্রজাতির পোকামাকড় ও আণুবীক্ষণিক জীবের খাবার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। শতবর্ষী গর্জন যেহেতু বনের ঐতিহ্য, এদের সংরক্ষণের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।

দুই গবেষক কামাল হোসাইন এবং মো. আখতার হোসাইনের অভিমত, চুনতি অভয়ারণ্যের সব শতবর্ষী গাছের একটি ডিজিটাল মানচিত্র তৈরি করে তাদের বাস্তুতান্ত্রিক সহাবস্থান নিয়ে গবেষণা করা প্রয়োজন। এটা প্রাকৃতিক বন সৃজনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। শতবর্ষী গর্জন বৃক্ষের প্রাকৃতিক জন্মের মাধ্যমে চুনতি অভয়ারণ্যে গর্জনের সংখ্যা বাড়ানোর বিশেষ প্রকল্প নেওয়া যেতে পারে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশবিজ্ঞান অনুষদের স্নাতক (সম্মান) শেষ বর্ষের ছাত্র কাজী সাইদুল হক বলেন, ‘শতবর্ষী গর্জনগাছগুলো আমাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অংশ। ইউরোপ-আমেরিকায় এ ধরনের গাছগুলোকে সংরক্ষণের বিশেষ ব্যবস্থা থাকে। ফলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এ ধরনের গাছের জিনগত বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে ধারণা পেতে পারে।’

চুনতি অভয়ারণ্যের সহব্যবস্থাপনা কমিটির (সিএমসি) সভাপতি মো. ইসমাইল মানিক বলেন, ২০০৬-০৭ সালে সিএমসি এবং বন বিভাগ যৌথভাবে চুনতি অভয়ারণ্যে শতবর্ষী মা গর্জনগাছের ওপর জরিপ চালিয়ে ৮১৪টি গাছ শনাক্ত করে। চুনতি, বাঁশখালী, হারবাং ও আজিজনগরের সংঘবদ্ধ কাঠচোরেরা বনের ভেতর প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট গাছ প্রতিনিয়ত কেটে নিচ্ছে। স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের দখল, রোহিঙ্গা বসতি ও অবৈধ অনুপ্রবেশ রোধ করা গেলেই চুনতি অভয়ারণ্য রক্ষা করা সম্ভব হবে।

চুনতি অভয়ারণ্যের সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) আবদুর রহমান প্রথম আলোকে জানান, তিনি সম্প্রতি চুনতি অভয়ারণ্যের দায়িত্ব নিয়েছেন। অবশিষ্ট শতবর্ষী গর্জনগাছগুলো রক্ষণাবেক্ষণে যথাযথ ব্যবস্থা নেবেন। সৌজন্যে : প্রথম আলো

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *