ইশতিয়াক আহমেদ
যত দূর চোখ যায় সবটাই মায়াবী সবুজ। দুই ধারে দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড়গুলো ধ্যানী বুদ্ধ। কর্ণফুলীও চলেছে চুপচাপ। আমাদের ট্রলারটাই খালি ভটভট আওয়াজ ঝাড়ছে। বেলা ৩টা ছুঁইছুঁই। আকাশে মেঘ জমল। ঠাণ্ডা বাতাসে বৃষ্টির গন্ধ। পাহাড়ে বৃষ্টি বড়ই বেপরোয়া। হুট করে এসে সবকিছু ধুয়ে-মুছে দেবে। বলতে বলতে শুরু হয়ে গেল। পাহাড়ের কোনো হেলদোল নেই, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিজতে থাকল। ট্রলারটি গা বাঁচাতে ভিড়ে গেল একটা ঘাটে। এক কাপ চা হলে জোশ হয়; কিন্তু্তু পাই কই?
ধীরে ধীরে বৃষ্টি কমে এলো। পাহাড়ের মাথায় জমে থাকা মেঘগুলো ক্রমেই মিলিয়ে গেল। বেরিয়ে এলো বিকেলের ঝকঝকা লাল আকাশ। নদীর ঘাটের থমকে যাওয়া জনপদ সরব হতে শুরু করল। মনির ভাই জানালেন, আজ এখানে যাত্রাবিরতি। এটা রাঙামাটির বরকল উপজেলা সদর। আমাদের ভ্রমণ দল বিটিইএফ কাল রাতে ঢাকা থেকে রওনা দিয়ে সকালে রাঙামাটির রিজার্ভবাজার থেকে নৌকা নিয়ে ছুটেছে। দশটা নাগাদ থেমেছিলাম শুভলং। ঝরনায় ঝাপাঝাপি করেছিলাম আধা ঘণ্টা।
ট্রলার থেকে নেমে দেখলাম দলনেতা গনি ভাই স্থানীয় সাংবাদিক পুলিনবিহারী চাকমার সঙ্গে গল্প করছেন। পুলিনদা বিটিইএফ-এর পুরনো বন্ধু। ট্যুর ম্যানেজার শাহীন ভাই এসে জানালেন, ‘কাল সকালে আমরা হরিণা যাত্রা করব।’ আপাতত ব্যাগ-বোঁচকা নিয়ে বরকল বাজারে ইদ্রিস ভাইয়ের খাবারের হোটেলে গিয়ে উঠলাম। হঠাৎ একসঙ্গে এত মানুষের খাবার আয়োজন করতে গিয়ে ইদ্রিস ভাই ভড়কে গেলেন। তবে চেষ্টার কসুর করলেন না।
রাতের খাবার শেষ করে পুলিনদার বাড়িতে গিয়ে উঠলাম। গল্প করতে করতে দেখি পাখিরা আবার ডাকতে শুরু করেছে, মানে ভোর। ঘুমাতে যাওয়ার পাঁয়তারা করছি এমন সময় গনি ভাই তাড়া দিলেন, ‘ওই ল।’ ব্যস, আবার গাট্টিবোঁচকা, আবার ট্রলার। আজকে চারদিক ঝকঝকে ফিটফাট। খালি ফ্রেমিং করো আর শাটার চাপো। কম্পোজিশন ওপরওয়ালা সাজিয়েই রেখেছেন। ঘণ্টা দেড়েকের মাথায় বাংলাছড়ার কাছাকাছি পৌঁছে গেলাম। এক ঘণ্টা পাহাড় ডিঙালেই বাংলাছড়া। রোদটা একটু চড়েছে। চড়া শুরু হলো। চান্দি গরম হয়ে উঠতে থাকল। অবশ্য মেহেদী আর সাগর ভাই যেন বাড়ির লনে হাঁটছে। সাগর ভাইয়ের বিদেশেও পাহাড় চড়ার অভিজ্ঞতা আছে। মুন আর অভিজিৎ খুব ছবি তুলছে। পাহাড়ের চূড়ায় এসে দাঁড়ালাম। আমি নাদুসুনুদুস, অবস্থা টাইট। স্যালাইন পানিতে চুমুক দিতে দিতে চারদিকটা একবার দেখে নিলাম। সাদা মেঘের ভেলাগুলো সবুজ পাহাড়কে ছুঁয়ে যাচ্ছে প্রেয়সীর মতো। আমি দেখে ফেলছি বলে বুঝি লজ্জাও পাচ্ছে!
পাহাড় থেকে নেমেই পেলাম একটা ছোট্ট দোকানঘর। একটু চা-নাশতা সেরে আবার হাঁটা, বাংলাছড়া।
ছড়াটা বেশ প্রশস্ত। পাহাড়ের গা ঘেঁষে বড় বড় গাছ দাঁড়িয়ে আছে। গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো রেখাপাত করেছে ছড়ার পানিতে। ছড়ার টলটলে পানি দেখে অভি-মুন জুটি লোভ সামলাতে পারল না। তারপর দেখাদেখি সবাই ভিজল। ঘণ্টাখানেক ভেজাভেজি করে ঝরনার কথা মনে হলো গনি ভাইয়ের। যেখান থেকে ছড়াটি শুরু হয়েছে সেখানে নিশ্চয়ই একটি ঝরনা আছে। তাই আবার হাঁটা। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের কাছে চলে গেলাম। কিন্তু ঝরনার দেখা নেই। স্থানীয় সঙ্গীদের মতে. ঝরনা আরো গহিনে। তবে তারাও ঝরনার ঠিকানা সঠিক বলতে পারছে না। তাই ফিরতি পথ ধরতে হলো। পুরো দল ঝরনার ফাঁকিতে কাতর। আর এরই মধ্যে জ্বর চলে এলো অভিজিতের। গনি ভাই, মনির, জিলানি, পপ, রবিন, মনোয়ারের সঙ্গে আমিও পথ হারালাম। অন্ধকার হয়ে আসছে। জোঁকের ভয়ও আছে। একটি ছোট খাল পেলাম, তবে ঘাটে নৌকা বাঁধা নেই। গনি ভাই স্থানীয় একজনকে খাল সাঁতরে ওপারে গিয়ে ট্রলার খুঁজতে বললেন। আমরা ততক্ষণ জোঁক তাড়ালাম। কিছুক্ষণের মধ্যে ট্রলার আমাদের উদ্ধার করতে হাজির হলো। ট্রলার ছুটে চলল ছোট হরিণা। আমরা ঝিমোতে লাগলাম। গল্পও আসছিল না মুখে। ছোট হরিণায় ট্রলার ভিড়ল রাত ৯টায়। জ্ঞানজ্যোতি চাকমা চার নং ভূষণছড়া গ্রামের জনপ্রহর বিদ্যালয়ের হেডমাস্টার। অমায়িক ভদ্রলোক। ছোট হরিণা বাজারে রাতের খাবার সেরে নিলাম। জনপ্রহর বিদ্যালয়ের একটি ঘরে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করলেন জ্যোতিদা। স্কুলের সামনেই একটি খেলার মাঠ। বিছানা পাতার পর আড্ডা শুরু হলো। একজন কথা শুরু করলে অন্যদের মুখেও কথারা এসে ভিড় করে।
সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা জানালায় তাদের ছোট ছোট অবাক চোখ মেলে রেখেছে। জানতে চাইছে- এরা কারা?
কিভাবে যাবেন
ঢাকার ফকিরাপুল থেকে ডলফিন, ইউনিক, এস আলমসহ আরো কিছু পরিবহনের রাঙামাটি যাওয়ার বাস আছে। ভাড়া ৫৫০ থেকে ৬০০ টাকা। রাঙামাটি থেকে ছোট হরিণা পর্যন্ত রিজার্ভ ট্রলার ভাড়া সাড়ে চার থেকে ছয় হাজার টাকা। সৌজন্যে : কালের কণ্ঠ