Skip to content

বলেশ্বর পারে আজও কাঁদেন হানিফ খাঁ

শিরিনা আফরোজ
ভয়াল ১৫ নভেম্বর আজ। সাগর উপকূলবর্তী জেলা পিরোজপুরের লাখো মানুষের কাছে এটি একটি আতঙ্কের দিন। ২০০৭ সালের এই দিনে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় সিডরে জীবন, জনপদ আর জীবিকা সম্পূর্ণ তছনছ হয়ে গিয়েছিল। ওই রাতে ঘণ্টায় ২৫০ কিলোমিটার বেগে বয়ে যাওয়া ঘূর্ণিঝড়ের সঙ্গে পাঁচ মিটার উঁচু জলোচ্ছ্বাসে পুরো জেলা বিরাণ ভূমিতে পরিণত হয়। মৃত্যুকূপে পরিণত হয় জেলার মঠবাড়িয়ার খেতাচিড়া, ভাণ্ডারিয়ার হরিণপালা ও জিয়ানগরের কলরন চণ্ডীপুর এলাকা।

আর যেন ভয়াল না হয়ে ওঠে বলেশ্বর। সেই আশায় সিডরের পর থেকে নদীর পারে বসে নিয়মিত ধর্মীয় বই পাঠ করেন পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ার খেতাচিরা গ্রামের বৃদ্ধ হানিফ খাঁ।

আর যেন ভয়াল না হয়ে ওঠে বলেশ্বর। সেই আশায় সিডরের পর থেকে নদীর পারে বসে নিয়মিত ধর্মীয় বই পাঠ করেন পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ার খেতাচিরা গ্রামের বৃদ্ধ হানিফ খাঁ।

সেদিনের রুদ্রমূর্তি প্রকৃতি কেড়ে নেয় প্রায় সাড়ে পাঁচ শ মানুষ। উপড়ে পড়ে গাছপালা, ভাসিয়ে নিয়ে যায় হাঁস-মুরগি, গবাদি পশু। সেই কাল রাতের কথা পিরোজপুরের বিভিন্ন জনপদের মানুষ এখনো মনে করে শিউরে ওঠে। আজও সেদিনের ভয়াবহতা মনে করে আঁতকে ওঠে উপকূলবাসী। কেউ কেউ সব হারিয়ে বসতি গড়েছে বেড়িবাঁধের ওপর। মঠবাড়িয়ার খেতাচিড়া গ্রামের অশীতিপর হানিফ খাঁ সৃষ্টিকর্তার করুণা চেয়ে এখনো প্রমত্তা বলেশ্বরের পারে বসে কোরআন শরিফ তেলাওয়াত করেন। হানিফ খাঁ বলেন, ‘আমি প্রতিদিন নদীর কিনারে বসে কোরআন পড়ে নদীকে সাক্ষী রেখে মৃত স্বজনদের জন্য দোয়া করি। আমি চাই না, এমন একটি ভয়াবহ দিন আবার ফিরে আসুক।’

পিরোজপুরের সর্ব দক্ষিণে সাগর উপকূলবর্তী ১১টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত উপজেলা মঠবাড়িয়া। প্রায় তিন লাখ মানুষ অধ্যুষিত এ উপজেলার আয়তন ৩৫৬ বর্গকিলোমিটার। ঘূর্ণিঝড় সিডরে মঠবাড়িয়ার ১১টি ইউনিয়নই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সিডর-পরবর্তী সেখানে আজও কোনো টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মিত না হওয়ায় আতঙ্কিত ওই জনপদের অধিকাংশ জেলে, কৃষক ও প্রান্তিক মানুষ। বলেশ্বর নদের কূল ও বাঁধের ওপরই তাদের বসবাস। নভেম্বর এলেই আতঙ্ক ও অজানা শঙ্কা ঘিরে ধরে তাদের। এখানে নেই পর্যাপ্ত সাইক্লোন শেল্টার, নেই উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থাও। সারা বছরই প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকতে হয় এখানকার মানুষকে।

সিডরে উপজেলার সাপলেজা ইউনিয়নের ক্ষতিগ্রস্ত খেতাছিড়া, কচুবুনিয়া, ভাইজোড়া ও তাফালবাড়িয়া গ্রাম একেবারে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় সে রাতে। এ ছাড়া, ঝড়, বন্যাসহ প্রাকৃতিক যেকোনো দুর্যোগে এ এলাকার মানুষ ঝুঁকিতে থাকে। প্রমত্তা বলেশ্বর নদের হাত থেকে এখানকার প্রান্তিক মানুষকে রক্ষার জন্য টেকসই বেড়িবাঁধ না থাকায় মানুষজন এখনো সে ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে পারেনি।

সেদিনের দুঃসহ স্মৃতি মনে করে কেঁদে ওঠেন নদীর কিনারে বসবাসরত পূর্ব চণ্ডীপুর গ্রামের জেলে ইব্রাহীম শেখ। তিনি বলেন, তিন সন্তান হারানোর বেদনাময় স্মৃতি আজও ভুলতে পারেননি তিনি। সেদিন ভাগ্যক্রমে তিনি ও তাঁর স্ত্রী বেঁচে গেলেও দুই দিন পর এক কিলোমিটার দূরে মালবাড়ি ব্রিজের কাছে ধানক্ষেতে তাঁর তিন সন্তানের লাশ পাওয়া যায়। চার বছরের মেয়ে চাঁদনিকে হারিয়ে এখনো মূর্ছা যান খাদিজা বেগম। সন্তানকে হারানোর কথা বর্ণনা করতে গিয়ে তার ছবি বুকে জড়িয়ে অঝোর ধারায় কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।

পূর্ব চরবলেশ্বর গ্রামের দিনমজুর মতিউরের স্ত্রী লাল বানু সেদিন তিন সন্তান নিয়ে পাশের একটি এনজিও অফিসে আশ্রয় নিতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু রাস্তায় বের হতেই পানি ভাসিয়ে নিয়ে যায় তাদের। তিন দিন পর লাল বানুকে চার বছরের মেয়ে কুলছুম ও দুই বছরের ছেলে সাকিবকে বুকে জড়ানো অবস্থায় বাড়ি থেকে আধা কিলোমিটার দূরে ধানক্ষেত থেকে লাশ উদ্ধার করে এলাকাবাসী। ভাগ্যক্রমে সেদিন বেঁচে গেলেও স্ত্রী ও দুই সন্তানকে হারিয়ে আজও নির্বাক মতিউর।

পূর্ব চণ্ডীপুর গ্রামের জেলে মনির বলেন, সেদিন বড় পাতিলে করে ভাসিয়ে নিয়ে তাঁর দুই শিশুকে বাঁচিয়েছেন। ওই গ্রামের সোহাগ বলে, সিডরের সময় তার বয়স ছিল পাঁচ বছর। সেদিন তারা আটজন শিশু তিন ঘণ্টা চেষ্টায় একটি আম গাছের ডাল ধরে জীবন বাঁচায়।

সিডর আক্রান্ত ফাতেমা বেগম বলেন, ‘সেদিন অনেককে পানির তোড়ে ভেসে যেতে দেখেছি। সন্তান বেঁচে থাকলেও সব হারিয়ে এখন বেড়িবাঁধে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাস করছি।’ সিডর আক্রান্ত সবহারা প্রায় এক হাজার পরিবার এ বেড়িবাঁধে মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নিয়েছে। সিডরে মা-হারা সাইদুল জানান, সেদিন বাবা-মা একে অন্যের হাত ধরা থাকলেও পানির তোড়ে দুজন দুই দিকে চলে যান। বাবা বেঁচে থাকলেও তিন দিন পর মায়ের লাশ একটি পুকুরের মধ্যে গাছে চাপা পড়া অবস্থায় পাওয়া যায়। ভাঙা বেড়িবাঁধ না সারলে বড় ধরনের বিপদ হতে পারে বলে জানান তিনি।

এ ব্যাপারে মঠবাড়িয়া পৌরসভার মেয়র রফিউদ্দিন আহমেদ জানান, বিশ্বব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় ১৪ কিলোমিটারের বেশি বেড়িবাঁধ নির্মাণের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। এ জন্য ব্যয় হবে প্রায় ৭৫ কোটি টাকা। টেকসই এসব বাঁধ নির্মিত হলে এ ইউনিয়নের জানমাল, ঘরবাড়ি ও ফসল ঝড়-জলোচ্ছ্বাস ও নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে রক্ষা পাবে।

মঠবাড়িয়ার সাপলেজা ইউপি চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিম জমাদ্দার জানান, প্রতি বছর সৃষ্ট প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের হাত থেকে উপকূলের মানুষের জানমাল রক্ষায় সরকার ও দাতা সংস্থার নেওয়া প্রকল্পগুলো দীর্ঘমেয়াদি, টেকসই ও মানসম্পন্নভাবে নির্মিত হলে উপকূলের অসংখ্য জীবন রক্ষা পাবে। সৌজন্যে : কালের কণ্ঠ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *