:: শাহ মুহাম্মদ মোশাহিদ ::
বাংলাদেশে হাসির খনি আছে। এই দেশের প্রকৃতি যেমন হাসে, মানুষগুলোও হাসি দিয়ে অভিবাদন জানায়। জানালেন ফরাসি এক পর্যটক। নাম পল বালডি। তিনি কাজ করেন ফ্রান্সের একটি বারে। বয়স ২৭। দুই বছর আগে বিশ্বভ্রমণে বেরিয়েছিলেন। টানা ৩৩ দেশ ঘুরে ফিরে গেছেন নিজের দেশে। বছর খানেকের এই ভ্রমণে বাংলাদেশে ছিলেন এক মাসের মতো সময়। ঘুরেছেন সমুদ্র সৈকতে। সাগরদ্বীপ সেন্টমার্টিন, শ্রীমঙ্গলের বর্ষাবন লাউয়াছড়ায়। এছাড়া কিশোরগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও রংপুরে গিয়েছেন। মিশেছেন সাধারণ মানুষের সঙ্গে। রাত জেগে যাত্রাপালার রিহার্সাল দেখেছেন।
বাংলাদেশের সব অভিজ্ঞতার নির্যাস থেকে তিনি আবিষ্কার করেছেন একটি শব্দ- ‘হাসি’। ফেসবুকে পল বালডির কাছে অভিজ্ঞতা জানতে চাওয়া হলে তিনি আজকালের খবরকে বলেন, “আমি গোটা বাংলাদেশকেই হাসতে দেখেছি। আমাকে যে যেখানেই দেখেছেন হাসিমুখে অভিবাদন জানিয়েছেন। থাকতে দিয়েছেন, খেতে দিয়েছেন। এই হাসিগুলো এখনো আমার সঙ্গে লেগে আছে। আবার আমি বাংলাদেশে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছি। আরো বেশি সময় থাকব।”
পল বালডি কাজের পাশাপাশি পড়ালেখাও করেন। যখন ছুটি পান, ছুটে যান বিশ্বভ্রমণে। ২০১৫ সালের মার্চের শুরুর দিকে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। থাকেন ৫ এপ্রিল পর্যন্ত। ফ্রান্স থেকে মালয়েশিয়া যান বিমানে না চড়েই। কোথাও হেঁটেছেন। কোথাও সাক্লিং করেছেন। কোথাও করেছেন হিচহাইকিং। অনেক দেশেই এই হিচহাইকিং পদ্ধতিটা প্রচলিত। হিচহাইকিংয়ের চিহ্ন বুড়ো আঙ্গুল। রাস্তার পাশে কেউ বুড়ো আঙ্গুল তুলে ইশারা করলে উন্নত দেশের ট্রাক ড্রাইভাররা বুঝে নেন ইনি একজন পর্যটক। যদি সুযোগ থাকে, তবে তাকে সহযোগিতা করেন। ট্রাকের পেটে তুলে নেন। বিনা ভাড়ায় নামিয়ে দেন যেখানে তিনি নামতে চান। পল বালডিও হিচহাইকিং করে ফ্রান্স থেকে মালয়েশিয়া পর্যন্ত আসেন। এছাড়া গাড়িতে করে পুরো অস্ট্রেলিয়া ঘুরেছেন।
বাংলাদেশে এসেও প্রথম দিকে তিনি হিচহাইকিংয়েই ঘুরতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এখানে এ পদ্ধতিটা প্রচলিত নেই জেনে হতাশ হয়েছেন। বালডি বলেন, “ইউরোপের অনেক দেশে হিচহাইকিং খুব সহজ একটা কাজ। কিন্তু কিছু দেশে এটা খুবই কঠিন এবং বিপজ্জনক। কারণ লোকজন জানে না, হিচহাইকিং কী?”
ইরানের একটি উদাহরণ দিয়ে বললেন, “আমি তখন ইরানের সিরাজ শহরে ছিলাম। পকেটে নগদ টাকা ছিল না। আশপাশে কোনো এটিএম বুথও পাইনি। একটি বেঞ্চের ওপর বসেছিলাম। চোখে ছিল ঘুম। ভাবছিলাম কোথায় কিভাবে মাথা কাত করা যায়। একজন লোক আমর দিকে এগিয়ে এলো। এটা-সেটা জিজ্ঞেস শুরু করল- আমি কে, কোথায় বাড়ি, কোন কোন দেশ ঘুরেছি ইত্যাদি। শেষে সে আমাকে ঘুমের দাওয়াত করল। আমি তার সঙ্গে তিন দিন ছিলাম। ওখানে একটি বিয়ের দাওয়াত খেতেও গিয়েছিলাম।”
‘বাংলাদেশে হাসি ও ভালোবাসার খনি আছে’
তাজিকিস্তানের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করলেন, “ওখানে আমি হিচহাইকিংয়ের চেষ্টা করছিলাম। তখন তাজিকিস্তানে ছিল প্রচণ্ড ঠাণ্ডা। বাইরে খুব একটা লোকজনও নেই। একটি ট্রাক আমাকে ছোট্ট গ্রামের জীর্ন একটা হোটেলে নামিয়ে দিল। ওখানেই দুইদিন ধরে একজন আমাকে আতিথেয়তা করেন। এই সময়গুলো আমি ভুলতে পারি না। এছাড়া মায়ানমার, জাপানের টোকিওতেও হিচহাইকিং করেছি। সবাইকে আমি ধন্যবাদ দিতে চাই। কারণ তারা আমাকে ঘুমুতে দিয়েছেন, খাবার দিয়েছেন, কাপড় দিয়েছেন এবং নিজেদের গল্প শুনিয়েছেন।”
বাংলাদেশে হিচহাইকিং করতে না পেরেও খুশি পল। ট্রেন এবং বাসে চড়ে তিনি ‘এক্সট্রিম’ ভ্রমণ করেছেন। ট্রেন ভ্রমণ ভালোই লেগেছে। তবে যখন দেরি করেছে, তখন বিরক্তি লেগেছে। লোকাল বাসে চড়া মোটামোটি একটা ‘চ্যালেঞ্জিং’ কাজ বলে জানিয়েছেন তিনি।
ঢাকা থেকে পল রওনা করেছিলেন কিশোরগঞ্জের উদ্দেশে। হাওরের প্রবেশমুখ মরিচখালী এলাকায়। ওখানকার একটি গ্রাম চুল্লী। ওই গ্রামে কাটিয়েছেন দুই দিন। পল বালডি বলেন, “ওখানে আমি একটি স্কুলে গিয়েছিলাম। অন্য সবার মতোই শিক্ষার্থীরাও আমাকে অভিবাদন জানালো হাসি দিয়ে। ওরা আমার কাছে ইংরেজি শিখতে চাইলো। আমি বোঝানোর চেষ্টা করলাম, ইংরেজি তো আমার মাতৃভাষা নয়। তোমরা যতটুকু ইংরেজি জানো, আমার জানার দৌড় ততটুকুই। তবুও ওরা নাছোড়। ব্যাপারটা আমার কাছে উপভোগ্য মনে হয়েছিল। আমি ঘণ্টাখানেক ইংরেজি শেখালাম ওদের। ওরাও অনেক কিছু শেখালো আমাকে।”
পল বলেন, “অনেক অনেক ভালো মানুষের সঙ্গে দেখা হয়েছে আমার। সবসময়ই আমি ওদের বন্ধুত্ব ও সহযোগিতা পেয়েছি। এই দেশের খাবারগুলো আমার কাছে প্রথমে একটু অদ্ভুত লাগলেও শেষ পর্যন্ত ভালোবেসে ফেলেছি। আসলে ভালোবেসে যারা খেতে দিয়েছে, তাদের উপেক্ষা করতে পারিনি। আমি অবলীলায় খেয়ে গেছি এবং পরে দেখলাম এতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। এখনো বাংলাদেশের খাবারগুলো মিস করি।”
‘বাংলাদেশে হাসি ও ভালোবাসার খনি আছে’
বাংলাদেশকে তার মনে হয়েছে প্রকৃতি এবং হাসির সমন্বয়ে একটি দেশ (স্মাইল এন্ড নেচার টুগেদার)। তিনি বলেন, “তখন ছিলো ধানের মৌসুম। আমি গিয়েছিলাম হাওরে। মনে হয়েছিলো ধানের জমিগুলোর কারণেই বাংলাদেশ সুন্দর। বাতাস ঢেউ খেলাচ্ছিল সবুজ ধানগাছগুলোকে।”
এছাড়া শ্রীমঙ্গলের লাউয়াছড়া বন এবং চা বাগানের সবুজ তাকে টেনে রেখেছিল। বেশ কয়েকটি দিন সেখানে কাটিয়েছেন আদিবাসিদের সঙ্গে। বনে ঘুরেছেন, পাখি দেখেছেন। বন মোরগের ডাক শুনতে আড়ি পেতে বসেছিলেন। শুকরের ঘোঁত ঘোঁত শুনেছেন। ‘সবকিছুই ভালো লেগেছে। তবে দুঃখজনকভাবে কিছু এলাকা দেখলাম প্রচণ্ডরকম নোংরা। আমার মনে হয়েছে এই নোংরাগুলো সরানো গেলে বাংলাদেশের ব্যাপক শক্তি রয়েছে বিশ্বে মাথা তুলে দাঁড়ানোর মতো।’
বাংলাদেশে এসে ‘নিশিদল’ নামে একটি সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন পল। এই দলের সঙ্গে রাতের অন্ধকারেও ভ্রমণ করেছেন। রংপুরের নিভৃত একটি সেতুর নিচে নদীর তীরে তাঁবু ফেলে রাত কাটিয়েছেন। আগুনে ঝলসে খাবার খেয়েছেন। শীতের সকালে কুয়াশা যখন জেঁকে বসেছে, তখন স্লিপিং ব্যাগ খুলে নিজেকে জড়িয়ে নিয়েছেন। এর পর ঘুম। শুধু তাই নয়, রংপুরের একটি স্কুলে নিশিদলের সঙ্গে গাছ লাগিয়েছেন পল বালডি। এই গাছগুলো লাগানো হয়েছে মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মরণে।
পল বালডি বলেন, “আমি বাংলাদেশে এসেছিলাম। এই দেশ যারা উপহার দিয়েছেন তাদের স্মরণে গাছ লাগিয়েছি। জানি না এই গাছগুলো এখন কেমন আছে। আমি আবার আসবো গাছগুলো দেখতে। বাংলাদেশের মানুষের আরো কিছু হাসি সঙ্গে করে নিয়ে যেতে।” সৌজন্যে: আজকালের খবর