ইকবাল খন্দকার
১৬০৮ সাল। মুঘল সুবেদার ইসলাম খানের শাসনামল। এ সময় সোনারগাঁও থেকে রাজধানী স্থানান্তর করা হয় বর্তমান ঢাকায়। এতে মহান হয়ে যায় সোনারগাঁওয়ের রাজনৈতিক গুরুত্ব। সোনারগাঁওয়ের পরিবর্তে যাবতীয় কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতে শুরু করে ঢাকাকে কেন্দ্র করে; কিন্তু সোনারগাঁওয়ে এ দেশের এমন এক সোনালি অতীত থেকে যায়, যে অতীত নক্ষত্রের মতো জ্বলজ্বল করতে থাকে মানুষের মনে। এই অতীত-স্মৃতিকে সংরক্ষণের পরিকল্পনা হাতে নেন শেখ মুজিবুর রহমান। তার পরামর্শ এবং আর্থিক সাহায্যে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের আন্তরিক প্রচেষ্টায় ১৯৭৫ সালের ১২ মার্চ সোনারগাঁওয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় গৌরবদীপ্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন। যেটির অবস্থান বর্তমান রাজধানী শহর ঢাকা থেকে ২৫ কিলোমিটার পূর্বে, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক থেকে প্রায় এক কিলোমিটার ভেতরে। ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল মূলত সোনারগাঁওয়ের ঐতিহাসিক পানাম নগরীর একটি পুরনো বাড়িতে; কিন্তু পরবর্তী সময়ে অর্থাৎ ১৯৮১ সালে শিল্পী জয়নুল আবেদিন প্রতিষ্ঠানটিকে উন্মুক্ত পরিবেশে গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন এলাকায় রয়েছে লোক ও কারুশিল্প জাদুঘরটি। ফাউন্ডেশনের প্রবেশপথের সামনেই আগত পর্যটকদের বিনোদনের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে নিরিবিলি পরিবেশে নির্মাণ করা হয়েছে ‘ঐতিহ্য’ নামে একটি বিনোদন স্পট। যেখানে রয়েছে আম, লিচু, পাম, মেহগনি ও গুবাকতরুর সারির শ্যামল ছায়া। এই বিনোদন স্পটটি স্বস্তিকর ও আনন্দদায়ক বিনোদনে ভ্রমণপ্রিয় মানুষকে উৎসাহিত ও উজ্জীবিত করে।
লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের ভেতরে রয়েছে মনোমুগ্ধকর নানা নির্মাণ। যেমন দু’জন অশ্বারোহী, গরুর গাড়ির ভাস্কর্য, লাইব্রেরি ও ডকুমেন্টেশন সেন্টার, ক্যান্টিন, লোকজ রেস্তোরাঁ, সেমিনার হল, ডাকবাংলো, জামদানিঘর, কারুমঞ্চ, কারুব্রিজ, মৃৎশিল্পের বিক্রয়কেন্দ্র, গ্রামীণ উদ্যান, আঁকাবাঁকা দৃষ্টিনন্দন লেক, কারুপল্লী, কারুগ্রাম ইত্যাদি। বৈচিত্র্যময় লোকজ স্থাপত্য গঠনে কারুশিল্প গ্রামের বিভিন্ন ঘরে রয়েছে কারুশিল্প উৎপাদন, প্রদর্শন এবং বিক্রয়ের সুব্যবস্থা। দোচালা, চৌচালা ও উপজাতীয় মোটিফে তৈরি এ ঘরগুলোয় রয়েছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের অজানা, অচেনা এবং আর্থিকভাবে অবহেলিত প্রতিভাবান শিল্পীদের সযতœ পরিশ্রমে তৈরি বিভিন্ন পণ্য। রুচিসম্মত সেসব পণ্যের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলোÑ নকশিকাঁথা, জামদানি, একতারা, খোদাই করা কাঠ, বাঁশ, বেত, শঙ্খ ও মাটির তৈরি নিত্যপ্রয়োজনীয় এবং ঘর সাজানোর শৌখিন সব জিনিসপত্র। ফাউন্ডেশনের আঙিনায় প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হয় মাসব্যাপী লোক ও কারুশিল্প মেলা। এই মেলায় আগমন ঘটে কারুপ্রেমী হাজার হাজার মানুষের। এখানে কেনাবেচা হয় আমাদের ঐতিহ্যবাহী নানা পণ্য। এসব পণ্যের টানে দেশী ক্রেতাদের পাশাপাশি বিদেশী ক্রেতারাও ছুটে আসেন মেলায়। এই মেলার জন্য আকর্ষণীয় সব পণ্য তৈরি করে সারা বছর অপেক্ষা করেন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের সৃজনশীল শিল্পীরা।
বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন দর্শনার্থীদের জন্য খোলা থাকে বুধ ও বৃহস্পতিবার ছাড়া সপ্তাহের প্রতিদিন। শনি থেকে মঙ্গলবার ফাউন্ডেশনের ফটক খোলা হয় সকাল ১০টায়। বন্ধ হয় বিকেল ৫টায়। আর শুক্রবারও ফটক সকাল ১০টায়ই খোলা হয়। তবে দুপুর ১২টা থেকে ২টা পর্যন্ত চলে মধ্যাহ্ন বিরতি। তারপর বন্ধ হয় যথারীতি ৫টায়ই। বুধ ও বৃহস্পতিবার এবং সরকারি ছুটির দিনগুলোয় ফাউন্ডেশন বন্ধ থাকে। কারুশিল্প ফাউন্ডেশনে প্রবেশ মূল্য ১০ টাকা। তবে শিশু এবং বয়োবৃদ্ধদের কোনো প্রবেশ মূল্য লাগে না। এখানে রয়েছে গাড়ি পার্কিং এবং খাবার-দাবারের বিশেষ সুবিধা। সূত্র : নয়া দিগন্ত