আবদুল মোমেন রহিত
আগের দিনই মাত্র নাফাখুম ঝরনায় ক্যাম্পিং সেরে উঠেছিলাম থানচি গেস্ট হাউসে। মেজাজটাও ফুরফুরে। সকাল সাড়ে ৬টায় উঠেই ফ্রেশ হয়ে যে যার বাইকে চড়ে বসলাম। আমরা সাতজন বাইকার, এ বছরেরই মার্চের শেষের দিকে গিয়েছিলাম বান্দরবান ঘুরতে। ভ্রমণের শেষ গন্তব্য ছিল আলীকদম। যদিও থানচি-আলীকদম সড়কের নির্মাণকাজ তখনো সম্পূর্ণ হয়নি। কিন্তু মোটরবাইকিং করার মতো মোটামুটি উপযুক্ত ছিল। নতুন রাস্তা আবিষ্কার করার উত্তেজনা নিজেদের মধ্যে বেশ অনুভব করছিলাম। থানচি উপজেলা থেকে আলীকদম হয়ে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়কে গিয়ে মিশেছে এটি।
ঠিক আধা ঘণ্টার মধ্যে আলীকদমের রাস্তায় উঠে গেলাম। এ যেন এক ভিন্ন জগতে প্রবেশ করলাম। শুরুতেই সেনাবাহিনীর এক কর্মকর্তা স্বাগত জানিয়ে বললেন, আর এক মাসের মধ্যেই নাকি রাস্তার কাজ পুরোপুরি শেষ হতে যাচ্ছে। শুনে খুব ভালো লাগল। আমাদের সেনাবাহিনীকে সাধুবাদ দিতেই হয় এই দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলকে সুগম করার জন্য।
লালচে-ধূসর মাটির ওই কাঁচা রাস্তা ধরেই পাহাড় বেয়ে উঠতে থাকলাম। প্রথম এক ঘণ্টা তো শুধু ওঠারই গল্প। রাস্তার দুই পাশের দৃশ্য এত্ত সুন্দর যে বারবার দাঁড়াতে হচ্ছিল ছবি তোলার জন্য। প্রকৃতি এখানে যেন একেবারেই নীরব-নিস্তব্ধ। এই রাস্তার সবচেয়ে উঁচু পাহাড়টির নাম ‘ডিম পাহাড়’। রাস্তার একদম পাশেই সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে পাহাড়ের হাজার বছর ধরে ক্ষয়ে যাওয়া খাঁজকাটা দেয়াল। কাজ সম্পূর্ণ হওয়ার পর সম্ভবত থানচি-আলীকদম সড়কটিই হতে যাচ্ছে বাংলাদেশের সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন ও সবচেয়ে উঁচু সড়ক। আর এখন পর্যন্ত দেশের সবচেয়ে উঁচু সড়ক হচ্ছে বান্দরবানের ‘পিক-৬৯’।
ডিম পাহাড়ের পর এক জায়গায় থেমে মোবাইলের জিপিএস দিয়ে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এই রাস্তার উচ্চতা পরীক্ষা করে পেলাম প্রায় দুই হাজার ৭৭৫ ফুট। কিন্তু ততক্ষণে আমরা এই রাস্তার উপর থেকে প্রায় ১০০-১৫০ ফুট নিচে নেমে এসেছি। তা না হলে এই সড়কের উচ্চতা হবে দুই হাজার ৮৭৫ ফুটের আশপাশে, যা কিনা ‘পিক ৬৯’ (প্রায় দুই হাজার ২৬৩ ফুট) হতেও প্রায় ৬১২ ফুট বেশি। তবে সরকারিভাবে বলা হয়, থানচি-আলীকদম সড়কের উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় আড়াই হাজার ফুট। দক্ষিণ এশিয়ার উঁচু সড়কগুলোর একটি হবে এই সড়কপথ।
আরো কিছুদূর এগিয়ে হঠাৎ করেই যেন মেঘের রাজ্যে প্রবেশ করলাম। থ্রিলের যে আর কিছু বাকি রইল না! মেঘ আর তার সঙ্গে হিমশীতল ঠাণ্ডা বাতাস মিলেমিশে একেবারে যেন সোনায় সোহাগা। চলতে চলতে আবার হঠাৎ করেই যেন মেঘ ফুঁড়ে বের হলাম। তখনই দেখতে পেলাম একটা শাখা রাস্তা ঢালু হয়ে বাঁয়ে মোড় নিয়ে ঠিক আমাদের নিচ দিয়েই নেমে গেছে। ওপর থেকে দেখতে অদ্ভুত সুন্দর লাগছিল রাস্তাটি। মূল রাস্তাটা ডানে বাঁক নিয়ে আবার আরেকটি পাহাড়ের ওপর উঠে গেছে। একটু সামনে এসেই পেয়ে গেলাম সেই শাখা রাস্তার প্রবেশমুখ। লোভ আর সামলাতে পারলাম না। বাকিদের এগোনোর কথা বলে চট করে ঢুকে পড়লাম ওই রাস্তায়। উদ্দেশ্য টপাটপ কয়েকটি ছবি নিয়েই বেরিয়ে পড়া।
ভেতরে ঢুকছি আর অবাক বিস্ময়ে চারপাশটা দেখছি। পাঁচ ফুট চওড়া রাস্তার দুই পাশই একদম খাড়া ঢাল অনেক দূর অবধি নিচে নেমে গেছে। পাশেই পুরো পাহাড় জুম চাষের জন্য পুড়িয়ে একদম ন্যাড়া বানিয়ে রেখেছে। ঝটপট কয়েকটি ছবি নিয়ে বাইক চালু করতেই দেখি নাজমুল ভাইকে। সবাই নাকি অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছে আমার জন্য। এভাবেই মাত্র দেড় ঘণ্টার রাস্তা অতিক্রম করলাম প্রায় তিন ঘণ্টায়। ৩৫ কিলোমিটার রাস্তা কিভাবে যে শেষ হয়ে গেল টেরই পেলাম না, যেন এক ঘোরের মধ্যে ছিলাম আমরা। আলীকদম বাজারে নাশতার জন্য যখন বসি, ঘড়ির কাঁটা তখন ১০টায়।
নাশতা শেষে গন্তব্য আলীর গুহা। একটি বাড়িতে বাইকগুলো রেখে গেলাম গুহা দেখতে। এখানকার দুটো গুহা দেখার পর ক্ষান্ত দিলাম। বাড়ি ফিরতে হবে যে! ঘড়ি জানাল, সময় এখন সাড়ে ১২টা। না, এবার সম্ভব হচ্ছে না। আজই ঢাকা নয়তো কুমিল্লা পর্যন্ত ফিরতে হবে। অতএব, খুব একটা সময় কিন্তু আমাদের হাতে নেই। তা ছাড়া বেশি ক্লান্ত হলে বাইক চালানোটাও বিপজ্জনক হয়ে পড়বে।
তার পরও বাইক চালানোর অনুভূতির সঙ্গে আসলে কোনো কিছুরই তুলনা হয় না। এর অনুভূতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। থ্রটল মোচড়ালেই সামনে এগিয়ে যাওয়া, এ যেন মেঘে ভেসে চলা। আর এর সঙ্গে যদি রাস্তা হয় ভালো, তাহলে তো কথাই নেই! ঠিক এই রকমই একটা রাস্তা পেয়েছিলাম আলীকদম থেকে ফাইশ্যাখালী যাওয়ার পথে। তবে মিরিঞ্জার পর থেকে রাস্তাটা জিলাপির প্যাঁচকেও হার মানায়, আর গোদের ওপর বিষফোঁড়া হিসেবে তো চড়াই-উতরাই ছিলই। তবে সান্ত্বনার বিষয় ছিল, রাস্তা একদমই কার্পেটের মতো মসৃণ ও চওড়া। যারা বাইকে করনারিং করতে মজা পান, তাদের জন্য এই একটি মাত্রই নিরাপদ সড়ক আছে আমাদের দেশে। তো আমরাও বাইকগুলোকে প্রায় কোলবালিশ বানাতে বানাতে ওই ১৫-২০ কিলোমিটার রাস্তা মুহূর্তেই অতিক্রম করে হাজির হই ফাইশ্যাখালীতে। দেখা গেল প্রত্যেকের বাইকেরই পেছনের চাকার একদম কিনার পর্যন্ত দাগ হয়ে আছে। ফাইশ্যাখালী উঠেই আমরা বাঁয়ে চট্টগ্রামের দিকে মোড় নিলাম। আর এভাবেই শেষ হলো অনেক দিন মনে রাখার মতো আরেকটি মোটরবাইক জার্নির। সৌজন্যে : কালের কণ্ঠ