তৌফিক মারুফ
ইউরোপজুড়ে দূরপাল্লার বাস সার্ভিসে ইউরো লাইনের খ্যাতি বিশ্বজোড়া। প্যালেস ডি ক্লিসির কাউন্টারের সামনে বিভিন্ন গন্তব্যের তালিকা, ছবি ও ভাড়ায় চোখ বুলাতে বুলাতে পাশেই লাল কালিতে মার্ক করা স্পেশাল ডে অফারে স্থির। প্যারিস থেকে পাশের দেশ বেলজিয়ামে সাধারণ ভাড়া ওয়ানওয়ে ৩২ ইউরো। আর রিটার্ন ৬৪। মাসে এক বা দুই দিন বিশেষ ছাড় থাকে। আর ভাগ্যগুণে ঠিক এক দিনের মাথায় জুটে গেল স্পেশাল ডে অফার, মাত্র ২৪ ইউরোতে প্যারিস টু ব্রাসেলস যাওয়া-আসা। দেরি না করেই টিকিট কেটে পকেটের নিরাপদ জায়গায় যত্ন করে রেখে দিলাম।
সোমবার ভোরে মাত্র ১ ডিগ্রির তাপমাত্রায় ঠাণ্ডা আর বাতাসে মোটামুটি জমে যাওয়ার মতো অবস্থায় মেট্রো ধরে সোজা ছুটলাম বাস স্ট্যান্ডে।
চেকইন কাউন্টারে রীতিমতো এয়ারপোর্টের ইমিগ্রেশনের লাইনের চেহারা। আমরা চারজন। টিকিট-পাসপোর্ট দেখিয়ে আলাদা টোকেন নিয়ে বাসে ঢুকে তবেই স্বস্তি। সময় মতো চালু হলো ইঞ্জিন। ভারী গোঁফের চালক পেছনে তাকিয়ে ইশারায় সবাইকে শুভেচ্ছা জানিয়ে চালু করলেন হেলপারবিহীন বাসের চাকা। চার ঘণ্টার পথ। সড়কের দুই পাশে গ্রামীণ দৃশ্য। কেবলই সবুজ আর সবুজ। যেখানটা ‘ছবির মতো সুন্দর’ কেবলই কথার কথা নয়, নিরেট বাস্তব। মাঠজুড়ে সবুজ ফসল, মাঝে মাঝে ছোট বাড়ি। কোথাও আঙুর, কোথাও ভুট্টা, ধানও চোখে পড়ে। আছে নানা সবজিও। পুরোটা সড়কে চেষ্টা করেও ধরা যায়নি এক চিলতে ভাঙাচোরা বা এবড়োখেবড়ো অবস্থা। বরং মাঝেমধ্যেই ভুলে যেতে হয় বাস চলছে নাকি থেমে আছে। মাঝে ১০ মিনিটের কফি ব্রেক।
ব্রাসেলস গিয়ে আকাশচুম্বী ভবনগুলোকে দুই পাশে রেখে বাস থামে সেন্ট্রাল স্টেশন ভবনে। রেলস্টেশনের এক পাশেই ইউরোলাইন বাসের স্ট্যান্ড। সামনে সব ভবনের গায়েই বড় বড় করে লেখা ডাব্লিউটিসি। কোনো কোনোটির নিচে দাঁড়িয়ে ওপর দিকে তাকাতেই মনে হলো যেন আকাশ ফুঁড়ে আরো ওপরে উঠে গেছে ভবন। আশপাশে বেশ কয়েকটি শিল্পকর্ম। কাছের ছোট্ট পার্কে এখানে-সেখানে জড়ো হয়ে আছে বিভিন্ন দেশ থেকে আগত অভিবাসন প্রত্যাশী উদ্বাস্তু পরিবার। কেউ কেউ মাঝেমধ্যেই হাত বাড়িয়ে সাহায্য চাইছে।
বেলাশেষে আবার ফিরতে হবে প্যারিস। সময় মাত্র আড়াই ঘণ্টা। এর মধ্যে কী দেখা যায়! পরিচিত যাকেই ফোন করা হলো, সবাই বলল তারা কর্মস্থলে। কেউ ২০০ কিলোমিটার দূরে, কেউ বা ৫০ কিলোমিটার। তাদের পেতে হলে অপেক্ষা করতে হবে রাত পর্যন্ত। কিন্তু তা তো পারা যাবে না। তবে তারা জানাল মাত্র দুই-তিন ঘণ্টার মধ্যে তেমন কিছুই দেখা বা বেড়ানো যাবে না। এ ক্ষেত্রে একমাত্র ভরসা কাছেই সেন্ট্রাল টাউন বা গ্র্যান্ড প্যালেস। শেষ পর্যন্ত পথচারীদের থামিয়ে ওই গ্র্যান্ড প্যালেসে যাওয়ার পথ বের করা হলো। কেউ বলল হেঁটেই যাওয়া যাবে। কেউ বলল মেট্রোতে গেলে সহজ হবে; মাত্র দুই স্টপেজ পরেই সেন্ট্রাল টাউন। সে অনুসারে টিকিট কেটে তিন মিনিটের মাথায় পৌঁছে গেলাম গন্তব্যে।
পাতাল থেকে উঠেই বড় রাস্তার দুই পাশে চোখে পড়ে পুরনো স্টাইলের একেকটি ভবন। কোনোটা হোটেল, কোনোটা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। আর নানা নামের রেস্তোরাঁ। বড় রাস্তায় গাড়ি চলাচল নেই। কেবলই হাঁটার পথ। মানুষ হাঁটছে আর দেখছে। সবাই পর্যটক। হঠাৎ বাঙালি এক পরিবারের দেখা মিলল। দুই সন্তান আর দম্পতি। প্রবাসী বাংলাদেশি। কিন্তু খুবই ব্যস্ততা নিয়ে দৌড়াচ্ছেন মেট্রোর দিকে। এর ফাঁকেই জানতে চাইলাম, এখানে বিশেষ কী দেখার আছে। জানালেন, একটু সামনে গিয়ে বামের গলিতে গেলেই ঐতিহাসিক কিছু ভবন দেখতে পারেন। বলার ধরনে তেমন একটা উৎসাহ পেলাম না। তবু এসে যখন পড়েছি ওইটুকুই না হয় এক পলক দেখে ফিরে যাই প্যারিস; এমন ভাবনা নিয়ে যথারীতি ভিড় ঠেলে অনেকটা অন্ধকার ধরনের গলির পথ ধরে কয়েক গজ সামনে যেতেই রীতিমতো চোখ ঝলসে যেন। এ যে স্বর্গরাজ্য। মাঝখানে বড়সড় উঠোন আর চারদিকে ঘিরে ভবন। শুধুই কি ভবন! সত্যিই যেন সোনা-রূপায় মোড়ানো বাড়ি। নানা নকশা-কারুকাজ। কোনোটা আকাশছোঁয়া মিনার, কোনোটা বেশি উঁচু না হলেও কম নয়। কোনো দিকে একটার গায়ে একটা লাগানো, কোনোটি বা আলাদা-স্বতন্ত্র। সব ঝকঝকে তকতকে। কোনো কোনো ভবনের গায়ে দূর থেকে উঁকি দেওয়া বিকেলের রোদ পড়ে ঝিলিক দিয়ে ওঠে। শিল্পশৈলীতে কারুকাজগুলো যেন একটির চেয়ে আরেকটি ছাড়িয়ে গেছে। আর সব ভবন মনে হচ্ছে একেবারেই নতুন। মনে হয় এই তো মাত্র কয়েক দিন আগে তৈরি হলো।
এত কিছু রেখে এসব ভবনের ইতিবৃত্ত-ইতিহাস জানার সময় কই! আগে তো মন জুড়িয়ে দেখা, তারপর ইতিহাস। কিন্তু তাতে কি হয়! এটাই যে বেলজিয়ামের বিখ্যাত গ্র্যান্ড প্লেস বা সেন্ট্রাল স্কয়ার, সেটুকু জানা হয়ে গেছে কয়েক পর্যটকের সঙ্গে আলাপে। জানা হয়ে গেছে পায়ের নিচের পাকা চত্বরটি দুই বছর পরপর সাজানো হয় নানা ফুল দিয়ে। তৈরি হয় ফুলেল কার্পেট। যা দেখতে ভিড় করে লাখ লাখ পর্যটক। এ ছাড়া ভবনগুলোই তো নিজ থেকে জানান দেয় নিজ নিজ ইতিহাসের সূত্র। কোনো ভবনের গায়ে লেখা ১৬৯৫, কোনোটির গায়ে ১৪২০, কোনেটি ১৭৩০ ইত্যাদি। আর ওই সংখ্যার নিচে ছোট করে কোথাও না কোথাও লেখা ওই সংখ্যাগুলোই হচ্ছে ওই ভবনটির নির্মাণ সাল।
ব্রাসেলস শহরে ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের তালিকাভুক্ত সেন্ট্রাল স্কয়ার বা গ্র্যান্ড প্লেস ঘিরে থাকা প্রাচীন ভবনগুলোর মধ্যে সিটি টাউন হল, ব্রেড হাউস, গিল্ড হাউস বেশি বিখ্যাত। বিশেষ করে সিটি টাউন হলটির মাঝখানে বিশাল খালি জায়গায় ঘিরে থাকা একেকটি হলের ভেতরে বাইরের দৃষ্টিনন্দন কারুকাজ মনে ধরে রাখার মতো। ১৬৯৫ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত টাউন হলটির বাইরের শিল্পকর্ম থেকেও চোখ সরানো দায়।
এ ছাড়া ১১ থেকে ১২ শতকে তৈরি ব্রাসেলসের রয়্যাল প্যালেসের মূল ভবনে এখনো সংরক্ষিত আছে ওই সময়ের নানা নিদর্শন। ইতিহাস খুঁজে জানা যায়, ১৭৩১ সালে একবার ওই ভবনটি আগুনে পুড়ে অনেকটা ধ্বংস হওয়ার পর ঊনবিংশ শতাব্দীতে সেটি আবার নির্মাণ করা হয় অবিকল।
কিন্তু এত বছর আগের এই ভবনগুলো কী করে এমন নতুন রাখা সম্ভব! তা ভাবতে গিয়ে মাথা তো ঘুরতেই পারে। সঙ্গে পেটেও ক্ষুধা ধরে। এ জন্য চিন্তা নেই। কারণ সব ভবনের নিচেই আছে বিভিন্ন খাবারের ব্যবস্থা। আছে ফুলের দোকান, বিখ্যাত চকোলেটের দোকান; গয়না, পোশাক-পরিচ্ছদ সবই পাওয়া যায়। আর আশপাশেই স্থানীয় ঐতিহ্যবাহী খাবারের স্টল আছে। শূকরের মাংসের নানা খাবার। এমনকি শূকরের মাংসের তৈরি কেক ও বিস্কুটের কমতি নেই। শুঁটকিও আছে। ভেজিটেরিয়ানদের জন্য আছে আস্ত একেকটি আলুর মধ্যে বিশেষ কায়দায় টমেটো ক্যাপসিকাম আর সস ঢুকিয়ে খাবার ব্যবস্থা। আলুগুলোর কোনোটির ওজন ৫০০ গ্রাম, কোনোটি এক কেজি। মুরগি-মাছের অনেক আইটেমও আছে। আছে গরম রেড ওয়াইন, চা-কফির বদলে অনেকেই গরম রেড ওয়াইনেই ঠাণ্ডা দূর করে। সৌজন্যে : কালের কণ্ঠ