:: জাভেদ হাসান ::
সবুজের টুঁটি চেপে ধরা শহরে উত্তরখানের ফায়দাবাদের আমিনুল ইসলামের বাড়িটি ব্যতিক্রম। প্রকৃতি যেন জড়িয়ে আছে পুরো বাড়িটিকে। বাড়ির জানালা থেকে শুরু। আর তা বিস্তৃত হয়েছে ছাদে। এরপর আকাশ ছোঁয়ার ইচ্ছায় গাছেরা মগ্ন হয়েছে প্রার্থনায়। এক হেমন্ত রোদের সকালে আমিনুল ইসলামের মুখোমুখি হওয়া। তিনি বললেন, তার সবুজ সাধনার গল্প।
২০০৫ সালে থাইল্যান্ডে বেড়াতে গিয়ে তিনি বাড়ির কার্নিশে বাগান করার অনুপ্রেরণা পান। ফিরে এসে তার উত্তরখানের বাড়ির কাঠামোর পরিবর্তন আনেন। শুরু করেন সবুজ বপন। এখন আমিনুল ইসলামের ছয়তলা সবুজে ঘেরা বাড়ির দুই, তিন ও চার তলার কার্নিশ ভরে আছে নানা প্রজাতির গাছে। বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই, এ বাড়ির সামনের অংশের প্রায় অর্ধেক ছেয়ে আছে ফুলে ভরা বাগান বিলাসে। এখানে সবান্ধব পাখিরা এসে বসে। গান করে নিজের মনে। আমিনুল তৃপ্তি পান তা শুনে। এ তো গেল কার্নিশ আর সামনের কথা। এবার ছাদের কথা। এখানে রয়েছে প্রায় ১২০০ বর্গফুট বাগান। দুটি তালার বিন্যস্ত এই ছাদ। ছয়তলা বাড়ির ছাদে ছায়াময় পরিবেশ চারদিকে, সাজানো হয়েছে সবুজের সমাহার, ঝোপালো একটি সফেদা গাছ। তাতে কাক বাসা বেঁধেছে। ফুটে আছে নয়নতারা, জুঁই, টগর, গন্ধরাজ, ল্যান্টানা, অ্যালামন্তা, কাঠ গোলাপ, ভোলভেট, শাপলা আর বাগান বিলাস। পেঁপে, ডালিম, সফেদা ও আমড়া গাছে থোকা থোকা ফল ঝুলছে। তার এই ছাদবাগান সাজানো হয়েছে তিন ভাগে। কিনার দিয়ে কংক্রিটের দেয়াল কয়েকটি ধাপে মাটি ভরাট করা। সেখানে গাছ লাগানো। চৌবাচ্চা ও টবের পানিতে ভাসছে ওয়াটার লিলি। লোহার মাচা বেড়ে উঠছে লতানো গাছ, আধুনিক স্থাপত্য বাগানে দিয়েছে পরিপাটি সৌন্দর্য। আছে ফলদ, বনজ, সবজি ও ফুলগাছ। এর মধ্যে জলপাই, সফেদা, তেঁতুল, কামরাঙ্গা, বাতাবিলেবু, পেয়ারা, জামরুল, আমড়া, ডালিম, কতবেল, কুল, ড্রাগন, পেঁপে, টকফল, লবঙ্গ, লেবু, লিচু, তুলসী, মেটে আলু, চালকুমড়া, বেগুন, পুঁইশাক, তেলাকচু শাক, বরবটি, ভেটকোম, মিষ্টিকুমড়া, মাসকচু, ওল, মরিচ, ক্যাপসিকাম, শজনে, কাঞ্চন ফুল, কয়েক প্রজাতির পাতাবাহার। আছে রঙিন মধু সঞ্জরি, পাকুড, সন্ধ্যামালতী, অপরাজিতা, নয়নতারা, পাম, মল্লিকা, ছাতিমসহ অনেক প্রজাতির ফুল গাছ। অ্যাডোনিয়াম, বট, নিস ও বকুলের বনসাই। এ ছাড়া আছে চেরি ভেলভেট ও কালিনী।
নিজের তৃপ্তি আড়াল করেন না আমিনুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘নিজ হাতে সবজি ও ফল তুলে খাওয়ার আনন্দটা আলাদা। বৃষ্টির দিনে গাছের গা বেয়ে টুপটুপ পানি পড়া আমাকে মুগ্ধ করে। শাখা-প্রশাখার ফাঁক গলে চাঁদের আলো ঘরে ঢুকে মেঝে ও দেয়ালে আলো-ছায়া সৃষ্টি করে- ওই দৃশ্যও আমাকে খুব টানে।’
পেশাগত জীবনে আমিনুল ইসলাম দেশের প্রসিদ্ধতম সুচি শিল্পীদের মধ্যে অন্যতম। নিজ ক্ষেত্রে অবদানের জন্য এ বছর ভূষিত হয়েছেন এসএম সুলতান স্মৃতি সম্মাননা পদকে। নিজের বাড়িটিকে তাই সাজিয়েছেন শৈল্পিক ক্যানভাসের আদলে।
গাছের প্রতি ভালোলাগা তার ছোটবেলা থেকে। আমিনুল জানান, বাড়ির আঙিনায় নানা ফুলের গাছ লাগাতাম। টবে করে ফুলের গাছ লাগাতাম। গাছ, ফুল ও প্রকৃতির সৌন্দর্য আমাকে ছেলেবেলা থেকে টানত। এরপর ঢাকা আসার পর ঢাকার বাসায় টবে নানা ফুলের গাছ লাগাতাম। পর্যায়ক্রমে এর পরিধি বাড়াতে থাকি। বর্তমানে আমার বাড়ির ছাদে-কার্নিশে বাগান করেছি। ঝিনাইদহে গ্রামের বাড়িতে ৮ বিঘার ওপর নানা ফুল, ফল, ওষুধি, দেশি ও বিদেশি প্রজাতির গাছ লাগিয়েছি। আমার গ্রামের কলেজে, স্কুলে, বাজারে, রাস্তার দুই ধারে প্রায় ৫০০ কৃষষ্ণচূড়া গাছ লাগিয়েছি। তার মধ্যে ২৫০-এর বেশি গাছে ফুল আসতে শুরু করেছে। আমার রোপিত গাছের মধ্যে আছে- আমাজন লিলি, হলুদ পলাশ, হলুদ শিমুল, কুটরাজ, নাগলিঙ্গম। হারিয়ে যাওয়া ফুলের গাছগুলো আমি ফিরিয়ে আনতে চাই।
ভবিষ্যতে আমি এভাবে আরও গাছ লাগাব। আমার স্বপ্ন, যখন কৃষষ্ণচূড়া ফুল ফুটবে তখন ফুলে ফুলে লাল হয়ে থাকবে আমার গ্রাম। আমার কলেজ, রাস্তার দুই ধার, লোকে দেখবে চারদিকে ফুল আর ফুল। আমার এই স্বপ্ন এগিয়ে নিতে আমি কারও অনুদান চাই না। ব্যক্তিগতভাবে আমি করতে চাই, এটাই আমার স্বপ্ন।
আমিনুল ইসলাম জানান, তার ঢাকার বাড়িটি দেখতেও অনেকে আসছেন ইদানীং। এতে তার ভালো লাগে। তবে এ ভালো লাগা শুধু নিজের মধ্যে রাখার মতো না। প্রকৃতির শিক্ষা নিয়ে ভালো লাগা তিনি ছড়িয়ে দেন চারপাশের মানুষগুলোর মধ্যে। সৌজন্যে : সমকাল