Skip to content

বিজয় দিবস ২০১৫ উপলক্ষে বিশেষ রচনা ‘কাশফুলের বিজয়’

রানা টাইগেরিনা
আকাশের বাবার দেশ বীজ ভান্ডার নামে ছোট একটি বীজ বিক্রির দোকান ছিল। কুষ্টিয়া শহরে বড় বাজারের রক্সি হল রোডের শেষ মাথায়। মেইন বাজার থেকে একটু বাইরে একেবারে গড়াই নদীর কোল ঘেঁষে। দোকানটার পাশেই ছিল ছোটখাট দেশ নার্সারি নামে ফুল, ফলজ গাছ ও সবজির চারা বিক্রয়ের একটা স্বল্প পরিসরের স্থান। শস্য বীজসহ বিভিন্ন ধরনের ফল ও দেশি বিদেশি বাহারি সব ফুলের বীজও বিক্রি করত এই দেশ বীজ ভান্ডার।

বড় ছেলে হিসেবে পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে বাবাকে ব্যবসায় সাহায্য করে আকাশ। আইএ পাস করে ভাবছিল এবারেই কুষ্টিয়া ইসলামিয়া কলেজে ডিগ্রি ভর্তি হবে সে। কিন্তু ৭ মার্চের বড় ভাষণের পর দেশের অবস্থা বেশি ভালো মনে না হওয়ায় আকাশের বাবা ছেলেকে ডেকে বললেন, বাবা কাশ, একবার ঢাকা ঘুরে আয়, দোকানের কিছু মালামাল নিয়ে আয় গিয়ে।

১৯৭১ সালের মার্চ মাসের ২২ তারিখে ঢাকার পথে রওনা হলো আকাশ, অন্যান্য বারের মতোই। নিজেদের দোকানের জন্য বীজ কিনতে। দুই দিন ধরে ঢাকার নবাবপুর রোডের ইন্টারন্যাশনাল সিড সেন্টার লি. নামের স্টোর থেকে বীজ কিনে মাঝারি দুটি কার্টুনে ভরে কুষ্টিয়ার পথে ট্রান্সপোর্টে বুক করে দিল।

কয়েক প্যাকেট হরেক রকম বাহারি বিদেশি ফুলের বীজ ও ভালো ফলনশীল কিছু রবিশস্য বীজ পরে স্যাম্পল হিসেবে দোকানির কাছ হতে কিনেছিল। সেগুলো তাঁর সঙ্গে করে আনা ট্রাভেল ব্যাগে পুরে রাখল সঙ্গে করে নেবে বলে।

সারা দিনের কেনাকাটিতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল আকাশ। কেনাকাটার হিসাব একটু ঠান্ডা মাথায় মিলাবে তাই সন্ধ্যার আগেই হোটেলে ফিরল।

Victory-Day7

দিনটি ছিল অন্যান্য দিনের মতোই আলো ঝলমলে স্বাভাবিক একটা দিন। তারিখ ২৫ মার্চ ১৯৭১।

পরের দিন খুব ভোরে আকাশের রওনা হওয়ার কথা কুষ্টিয়ার পথে। হঠাৎ​ মধ্যরাতে হোটেলে শুয়ে শুয়ে শুনতে পেল দূরে কোথাও গোলাগুলির আওয়াজ আর মানুষজনের আর্ত চিৎকারে ছোটাছুটির শব্দ। ভয়ে সারা রাতই ঘুমাতে পারল না আকাশ।

সকালে জানল পাকিস্তানের সেনাবাহিনীরা ক্যান্টনমেন্ট থেকে রাতে ট্যাংক নিয়ে বের হয়ে ঢাকার বহু মানুষজনকে গুলি করে হত্যা করেছে। মেরে ফেলেছে নিরীহ সাধারণ পাবলিকদের। তেমন কোনো প্রতিরোধ ছাড়াই ঢাকা শহর এখন তাদের কবজায়। রাস্তার মোড়ে মোড়ে হেলমেট পরে রাইফেল নিয়ে ঘাঁটি গেড়ে বসে আছে মিলিটারিরা।

আকাশের ভীষণ ভয় করতে লাগল। কী করে বাড়ি ফিরবে সেই চিন্তায় অস্থির হয়ে উঠল। ২৭ মার্চ কারফিউ ওঠার পর হোটেল থেকে একটা রিকশা নিয়ে গুলিস্থান হয়ে নিউমার্কেট বা নীলক্ষেতের দিকে যেতে চাইল যদি আরিচাঘাটের দিকে যাওয়ার কোনো যানবাহন পাওয়া যায়। কিন্তু রিকশাওয়ালারা কেউ রাজি হচ্ছিল না ওদিকটায় যেতে। কারণ ২৫ মার্চ রাতে ইউনিভার্সিটির ভেতর বাছবিচার না করে নির্দয় ভাবে দলে দলে ছাত্র শিক্ষককে হত্যা করেছে মিলিটারিরা। তবুও একটা রিকশাওয়ালা ওদিকটায় যেতে রাজি হলো।

অবশেষে নীলক্ষেত থেকে সাভার বাজার পর্যন্ত যাওয়ার একটা বাহনও মিলল ভাগ্যক্রমে। সেখান থেকে নয়ারহাটে গিয়ে ধলেশ্বরী নদী পার হলো। তারপর তরা ঘাটের কালিগঙ্গা নদী পার হয়ে অতি কষ্টে আরিচা পৌঁছাল বিকেলবেলায়।

সেখানে লঞ্চ পেয়ে পদ্মা পাড়ি দিয়ে গোয়ালন্দ ঘাটে গিয়ে পৌঁছালেও রেল চলাচল বন্ধ থাকায় ট্রেনে চেপে আকাশের কুষ্টিয়া যাওয়ার পথ রুদ্ধ হলো। সারা দিনের যাত্রার ক্লান্তিতে মলিন মুখে বিকল্প কিছু ভাবতে থাকল। কী করবে কোথায় যাবে কিছুই ভেবে পাচ্ছিল না।

গোয়ালন্দ ঘাটে আরও কয়েকজন যাত্রীর সঙ্গে মিলে তিন চাকার যান বেবিট্যাক্সি করে চলে এল ছোট্ট মহকুমা শহর রাজবাড়িতে। ভাবল সেখান থেকে একটা ব্যবস্থা হয়তো হবে।

কিন্তু রেলপথের লাইন আগে থেকেই উপড়ে ফেলা ছিল। কোনদিকেই ট্রেন চলছিল না। মহাবিপদে পড়ল আকাশ। বেবিট্যাক্সিতে থাকা এক সহযাত্রীর সঙ্গে আলাপ হলে সে রাজবাড়িতে তাঁর ফুফুর বাড়িতে তার সঙ্গে থাকার আমন্ত্রণ জানাল। আকাশের রাজি হওয়া ছাড়া বিকল্প পথ রইল না।

সেখানকার শহরতলির বেড়াডাঙা নামে এলাকায় সেই সহযাত্রীর ফুফুর বাড়িতে আশ্রয় নিল। কুষ্টিয়া যাওয়ার পথ বন্ধ থাকায় রাতটুকু কোনো রকমে পার হলে রাজবাড়ির অনতিদূরে সেই সহযাত্রীর নিজ গ্রামের বাড়ি বালিয়াকান্দির দিকে দুজনে রওনা হলো।

পথিমধ্যে লোকমুখে বিবিসির নিউজে ২৫ মার্চ রাতের কথা জানতে পারল। ঢাকা শহরে মিলিটারিদের মানুষ হত্যার কথা। আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেওয়ার কথা। আরও জানল পাকিস্তানি বাহিনীরা ঢাকার বাইরের শহরগুলো অভিমুখে যাত্রা শুরু করেছে পাকিস্তান বিরোধী বাঙালিদের শায়েস্তা করার জন্য। সারা পূর্ব পাকিস্তানকে নিজেদের দখলে রাখার জন্য।

বালিয়াকান্দির স্থানীয় গ্রাম্য রাজনীতিবিদরা ছাত্র-শিক্ষক-কৃষক-জনতাকে একত্র করার চেষ্টা করছিলেন হানাদার পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে ঠ্যাকানোর উদ্দেশ্যে। রাজবাড়ির যোগাযোগ সড়কের সন্নিহিত এলাকার পাড়ায় পাড়ায় পাহারার ব্যবস্থা করা হলো জানমালের নিরাপত্তার জন্য। রাতে গোপনে লাঠি সড়কি চালনার মহড়া শুরু হলো যুবকদের নিয়ে।

আকাশ কুষ্টিয়া যেতে পারল না। তাই সে-ও নাম লেখাল ওই দলে। পাকিস্তানি বাহিনীরা যেন কোনো ভাবেই বালিয়াকান্দি এলাকায় ঢুকতে না পারে তার জন্য গ্রামের যুবকেরা রাস্তাঘাটে ব্যারিকেড দিল।

আকাশ ও তাঁর সমবয়সী কয়েকজন মিলে যে বাড়িতে রাত্রিযাপন করত সেখানকার পাশের বাড়িতে অল্প বয়স্কা সুন্দরী একটা মিষ্টি মেয়ে থাকত।

মেয়েটি তাদের পাড়ায় থাকা মুক্তিকামী যুবক দলের জন্য প্রতিদিন চা নাশতা বানিয়ে দিত। পরে পরে রান্না-বান্নাও করে দিত লাগল। সপ্তাহান্তে সকলের কাপড়চোপর কেচে দিত। মাঝে মাঝে সে এলাকার নানান অদ্ভুত সব সংবাদও সংগ্রহ করে আনত এই যুবকদের জন্য।

Victory-Day3

একদিন মেয়েটির সঙ্গে আকাশের পরিচয় হলে কথা হলো আলাপ হলো। তারপর ভাব জমল। ধীরে ধীরে মেয়েটির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ল।

মাতৃহীন এই মেয়েটির নাম ফুলপরি। সে দূরসম্পর্কের এক খালার বাড়ি থেকে মানুষ হচ্ছে এখানে। খালা খালু ওকে আদর করে ফুল বলে ডাকে। এবারে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেওয়ার কথা তার। দেশের এই অবস্থাতে সেও বেশ বিচলিত ও চিন্তিত।

ফুলপরির অদ্ভুত মায়াময় চেহারা, সুন্দর গুণাবলি মধ্যে, মানুষের সাহায্যে এগিয়ে আসা ও মমতাময় হৃদয় দেখে আকাশের মনে কেমন এক অনুভূতি জন্মাল। মেয়েটির প্রতি অজানা কৃতজ্ঞতা বোধ জাগল। মনে হতে লাগল মেয়েটি তাঁর আজন্ম কালের চেনা। অনেক কাছের। অনেক আপনজনের একজন সে। আকাশ মনে মনে এই সব ভেবে ফুলপরিকে ভালোবেসে ফেলল।

ফুলের মনের মধ্যেও কেমন যেন উদাস উদাস ভাব পরিলক্ষিত হতে লাগল। কাশের প্রতি তার মনেও অনুরাগের জন্ম নিল। সে-ও মনের অজান্তে ভালোবেসে ফেলল কাশকে।

একদিকে দেশজুড়ে যুদ্ধের আতঙ্ক ভয়ভীতি। অন্যদিকে দুটি প্রাণের ভালোবাসা। দেশের এই অবস্থার জন্য কাশের মন খুব দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। সেই সঙ্গে পরিবারের জন্য কষ্ট আর প্রাণে ভালোবাসার ব্যথা।

কিন্তু ভালোবাসা—সে কী স্থান কাল পাত্র বোঝে? বোঝে না। লাভ নোজ নো ফ্রন্ট। ভালোবাসা না মানে কোনো ব্যত্যয়।
দুটি প্রাণের অবুঝ এক ভালোবাসার অকৃত্রিম প্রেম গভীর থেকে গভীরতর হয়ে উঠল। মুক্তিকামী দলের সাথিরাও বুঝতে পারল দুজনের লুকোচুরি প্রেমের কথা।

বিনা বাক্যে সকলেই এই দুজনকে সমর্থন করল।

কেউ কেউ বলে উঠল রব নিজে হাতেই এই জুড়ি বানিয়েছেন। তাই আমাদের কাজ হচ্ছে এখন তাঁদের মিলিয়ে দেওয়া। সকলে মিলে এ রকম উৎসাহ দিতে থাকায় এবং ফুলপরির খালা খালুর আপত্তি না থাকায় শেষে তাদের দুজনের বিয়ে হোক—অবস্থাটা এই পর্যায়ে গেল। তার ব্যবস্থাও শুরু হলো।

কিন্তু ফুল এক্ষুনি এই বিয়ে হওয়ার প্রস্তাবে বাঁধ সাধল। তার কথা, বাংলা মায়ের মুক্তি যত দিন পর্যন্ত না হবে, যত দিন না এই দেশ স্বাধীন হবে তত দিন আমরা বিয়ের জন্য অপেক্ষা করব। এই প্রতিজ্ঞায় অটল থাকার ব্যাপারে সকলের দোয়া প্রার্থনা করল।
ইতিমধ্যে ছোটখাটো প্রতিরোধ ও সব ধরনের বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করে অচিরেই পাকিস্তানি মিলিটারিরা প্রথমে গোয়ালন্দ ঘাট তারপর সেখান থেকে এক গ্রুপ রাজবাড়ি আর অন্য গ্রুপ ফরিদপুর পর্যন্ত পৌঁছে গেল। অত্যাচার হত্যাযজ্ঞ আর ব্যভিচারে ভরে উঠল এলাকার প্রতিটি জনপদ।

বালিয়াকান্দির নেতৃস্থানীয় লোকজন সাময়িক আত্মগোপন করল। কীভাবে হানাদারদের মোকাবিলা করা যায় সে বিষয়ে পরিকল্পনা করতে লাগল পর্দার আড়াল থেকে।

কাশ আর ফুলের মন্ত্রমুগ্ধ প্রেম-ভালোবাসার মাহেন্দ্রক্ষণ কয়েক দিন মাত্র কাটল। তারপর দেশমাতৃকাকে হানাদার মুক্ত করার লক্ষ্যে এক বজ্র শপথ নিয়ে বৃহৎ কর্তব্যের ডাকে দুজনের ছাড়াছাড়ির সময় হলো।

Victory-Day2

মুক্তিকামী দলের সঙ্গে প্রাণপ্রিয় কাশকে তাই এগিয়ে দিতে তাঁর প্রিয়তমা ফুল রাতের অন্ধকারে বালিয়াকান্দির পাশে বয়ে চলা ক্ষীণকায় চন্দনা নদীর ধার দিয়ে হেঁটে চলল মাইলের পর মাইল। জ্যোৎস্না রাতে শুধু একটা অর্ধ-গোলাকৃতি চাঁদই তাদের সঙ্গে সাথি হয়ে চলতে লাগল।

সে পথ যেন আর শেষ হয় না।

পরিশেষে তারা পশ্চিম বাঘাট গ্রাম অতিক্রম করে মধুখালীর সন্নিকটে কামারখালী ঘাটের কাছে মধুমতি নদীর বালুর পাড়ে গিয়ে থামল।

এ যেন সেই ‘চিকচিক করে বালু কোথা নেই কাদা’ নদীতট। এখন নদী পাড়ি দিতে হবে। ওপারে গিয়ে মাগুরার পথ ধরতে হবে। কাশ তার প্রিয়তমা ভাবি জীবনসঙ্গীকে আর সামনে নিয়ে যেতে চাইল না।

এবার সে গম্ভীর স্বরে ফুলকে বলল, ব্যস-অনেক তো হলো, এবার তুমি চলে যাও ফুল।

আমাকে বিদায় দিতে এসে অনেক কষ্ট করলে তুমি। অনেক পথ পাড়ি দিলে অনেক হাঁটলে। এবার তোমার বাড়ি ফিরে যাওয়ার পালা।

এ দেশটাকে পাকিস্তানি বাহিনীর হাত থেকে যথার্থভাবে উদ্ধার করার যে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা আমি করেছি, আমৃত্যু তা পালন করার চেষ্টা আমায় করতে দাও। তুমি ঘরে ফিরে যাও।

খেয়াঘাটে নৌকা ছাড়ার অপেক্ষায়। ফুল অশ্রুসিক্ত নয়নে বলল, হ্যাঁ, তুমি যাও। দেশমাতৃকার জন্য যুদ্ধ কর, দেশকে হায়েনাদের কবল হতে মুক্ত কর। তারপর স্বাধীন দেশে ফিরে এসো। বিজয়ীর বেশে ফিরে এসো আমার বুকে। তবে একটা কথা জেনে রেখ প্রিয়তম, তুমি যত দিন না ফিরে আসছ, তত দিন আমি তোমার অপেক্ষায় এইখানে, এই মধুমতির তীরে প্রতীক্ষা করব। এই খানেই তুমি আমাকে বরণ করবে।

এই কথা শুনে কাশ পাগলের মতো ব্যাকুল হয়ে উঠল। কনিষ্ঠ আঙুল দিয়ে ডান চোখের কোনা মুছতে লাগল। তারপর নিজেকে কিছুটা সংবরণ করে স্মৃতি স্বরূপ হিসেবে নিজের শেষ সম্বল সেই ছোট্ট ট্রাভেল ব্যাগটা ফুলের হাতে তুলে দিল। আর বলল কখনো যদি ফিরে না আসি এটাকেই কাশ ভেবে নিও।

Victory-Day

ফুল প্রাণপ্রিয় সঙ্গীর সেই ব্যাগ কোমল হাতে মুঠ পাকিয়ে তুলে নিল বুকে। তারপর দীর্ঘ এক নিশ্বাসে গভীর ভালোবাসায় আঁকড়ে ধরে রাখল সে ব্যাগটা আর বলল ঠিক আছে, তুমি এবার যাও। তবে মনে রেখ যত দিন না এই বাংলা মা শৃঙ্খলমুক্ত হবে, যত দিন না এ দেশ পরাধীনতার জিঞ্জির থেকে বেরিয়ে আসবে, যত দিন না এ দেশের মানুষ স্বাধীনভাবে সাধারণ জীবন যাপন করতে না পারবে, তত দিন আমি এখানেই ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকব। তোমারই প্রতীক্ষার প্রহর গুনব। তুমি ফিরে এসে দেখবে বাংলার এই সবুজ শ্যামল মাঠে হাজারো ফুলের মেলায় স্বাধীন বাংলাদেশে আমি তোমারই অপেক্ষায় দুহাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছি। হাসি হাসি মুখে। এই খানে। এই মধুমতির পাড়ে।

কাশ বলে উঠল, আরে পাগলি না, তুমি ঘরে ফিরে যাও, এখানে তোমার থাকতে হবে না। আমি অবশ্যই ফিরে আসব। দেশ স্বাধীন করে বিজয়ের বেশে তোমার ভালোবাসা নিতে ফিরে আসব।

প্রিয়তমা ফুলের কাছ হতে বিদায় নিয়ে মধুমতি নদী পাড়ি দিতে সঙ্গীদের সঙ্গে খেয়া নৌকায় গিয়ে উঠল কাশ। কিছুক্ষণের মধ্যে নৌকা ভিড়ল ওপারে। সাথিদের সঙ্গে নেমে মাগুরার পথে রওনা হলো।

মাগুরা অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে নির্লোভ আপসহীন সাহসী এক যোদ্ধা আকবর হোসেন একটি গেরিলা বাহিনী গড়ে তোলেন তার অনুসারীদের নিয়ে। মুক্তিযুদ্ধকালে এই বাহিনী আকবর বাহিনী হিসেবে মাগুরা অঞ্চলে পরিচিতি লাভ করে। কাশ তার সঙ্গে আসা সাথিদের নিয়ে এই আকবর বাহিনীতে যোগ দিল। ক্রমে এই বাহিনীতে সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকল গাণিতিক হারে।

কোনো রকম নামমাত্র ট্রেনিং নিয়ে অস্ত্র হাতে টুকটাক ছোট খাটো অপারেশনে যোগ দিতে লাগল কাশ। যশোর জেলার সন্নিহিত এলাকায় এবং মাগুরার আশপাশে দফায় দফায় চোরা গুপ্তা হামলা শুরু করল। মিলিটারিরা মুক্তিবাহিনীর চোরা হামলা ঠ্যাকাতে না পেরে দিনের বেলায় বাড়িঘর জ্বালিয়ে আর জনপদগুলো থেকে মানুষ ধরে নিয়ে গিয়ে সেসব হামলার প্রতিশোধ নিতে লাগল প্রায় প্রতিদিনই।

Victory-Day4

ধীরে ধীরে মুক্তি বাহিনীর কমান্ডোরা বড় বড় আক্রমণে অংশ নিয়ে ক্রমশ সাহসী পদক্ষেপ দেখাতে লাগল। সে সব যুদ্ধে কাশও অংশ নিত।

মাগুরা থেকে একবার রাতে মধুখালী এলাকায় অপারেশন করতে এলে ফুলপরি বুঝতে পেরেছিল কাশের আগমন। এমনকি অপারেশন করতে কয়েকবার তার উপস্থিতিও অনুধাবন করেছিল সে। কিন্তু সে কাশের সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করেনি এই ভেবে যে, তার মনের ওপর ভিন্ন প্রতিক্রিয়া হতে পারে। সে ভালোবাসায় বিমুগ্ধ হয়ে উদ্ভ্রান্ত হয়ে পড়বে। শত্রু নিধনে মনোনিবেশ করতে পারবে না তখন। তাই দুর থেকেই কাশের উপস্থিতি অনুধাবন করার চেষ্টা করে মাত্র।

কাশ তো জানে না ফুল এখনো সেখানেই আছে। ওর তো বালিয়াকান্দি ফিরে যাওয়ার কথা। কিন্তু সে তো ফিরে যায়নি। এমনি করে দিন যায় রাত আসে। তারপর মাস পার হয়।

চরম বিপদের আভাস পেয়ে নভেম্বর মাস থেকেই পাক সেনারা পিছু হটতে থাকে। তাদের ছোট ঘাঁটিগুলি গুছিয়ে যানবাহন নিয়ে মূল ছাউনিগুলোতে আশ্রয় নেয়। অবশেষে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর সম্মিলিত আক্রমণের মুখে ইতিমধ্যে পর্যুদস্ত ও হতোদ্যম পাকিস্তানি সৈনিকেরা আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।

ডিসেম্বরের ১২ তারিখে ভারতীয় বিমান বাংলাদেশের আকাশে চক্কর দিতে শুরু করলে পাক বাহিনীরা ঢাকার দিকে পশ্চাদমুখী হওয়ার আদেশের অপেক্ষায় থাকে। এরই মধ্যে যশোর মাগুরা মুক্ত হয়ে যায়। মুক্তির আনন্দ সঙ্গে নিয়ে কাশ ফিরে আসে মধুমতি নদীর পাড়ে। ওপারে কামারখালী ঘাটের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে দেখে। খুঁজতে থাকে ফুলকে। তারপর নদী পার হয়। কিন্তু মধুমতির পাড়ে শুধুই সাদা সাদা কাশফুল দেখতে পায়। নদীর তীর ঘিরে এত কাশফুলের বন এবার কেন হয়েছে কাশ তা ভেবে পায় না।

কাশবনের পরেই বিস্তীর্ণ পাড়সংলগ্ন মাঠে ও খেতে অসংখ্য রং বেরঙের ফোটা ফুলও দেখতে পায় কাশ। লাল রঙের পপিফুল সাদা পাপড়ির ডেইজি বহু রঙের ডায়ান্থাস। লম্বা গাছে বৈচিত্র্যময় ঘন্টাকৃতি হলিহক।

Victory-Day5

কাশ ভেবে পায় না এসব বিদেশি ফুলের চাষ এই দুর গ্রামের মাঠে কারা করেছে, কেনই বা করেছে। বিদেশি ফুলের চারপাশের চত্বরে দেশি সরিষার খেতও আছে। সরষে ফুলগুলোকে হলুদ মখমলের গালিচা পাতা যেন মনে হচ্ছে। অন্যপাশে আছে মটর–মশুরি–মুগ–খেসারির আবাদ।

তরতাজা গাছগুলোতে লকলকে সবুজ পাতার ফাঁকে ফাঁকে নীল ফুল উঁকি মারছে। এ যেন প্রকৃতির অদ্ভুত এক সমন্বয়। কাশ মুহূর্তে বিস্ময়ে বিমোহিত হয়। অবাক চোখে তাকিয়ে দেখে প্রকৃতির এই ফুল খেলা।

সেখানে খুব কাছেই দুই খেতের মাঝ আইলে সবুজ শাড়ি পরা লাল টিপে ফুলপরিকে দেখতে পায় কাশ। আইলে দাঁড়িয়ে ফুল দুহাত বাড়িয়ে কাশকে আলিঙ্গনের আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। কাশ নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারে না। চোখ কচলে পরিষ্কার করে এগিয়ে যায় ফুলের দিকে। তারপর ভুল ভাঙে। না-এ-তো আইলে জন্মানো ছোট্ট অল্প বয়সের একটা কাঁটা বাবলার গাছ।

জংলি লতান গাছের আগাডগা গাছটিকে ঝাঁপটে ধরে আস্টেপিষ্টে বেঁধে একটা মানবী আকৃতি বানিয়ে ফেলেছে। তার ওপরে ফোটা লাল লাল বনফুল দুর থেকে কপালের টিপের মতোই দেখাচ্ছে। তাহলে আমার ফুল কই? সে না বলেছিল বিজয়ের দিনে এখানেই আমার অপেক্ষায় থাকবে। তবে সে কী বালিয়াকান্দিতেই আছে, আমার প্রতীক্ষায়?

ফুলকে খোঁজার চেষ্টা করলে পশ্চিম বাঘাটের লোকজন চিনতে পারে মুক্তিযোদ্ধা কাশকে। তখন গ্রামবাসী খুলে বলে ফুলের ঘটনা:
কাশ বিদায় নেওয়ার পর ফুল এখানকার স্থানীয় ঘোষ পাড়ার কাছে এক বাড়িতে থাকতে লাগে তার প্রিয়তমের প্রতীক্ষায়। প্রতিদিন সে মধুমতি নদীর পারে উদাস হয়ে ঘুরে ফিরে বেড়ায় আর অপেক্ষা করে কবে দেশ শত্রু মুক্ত হবে। কবে দেশ স্বাধীন হবে আর কবে তাঁর প্রাণের কাশ স্বাধীন বাংলায় ফিরে আসবে।

Victory-Day6একদিন রাতে ফুল কাশের দেওয়া ব্যাগটা খুলে দেখে ভেতরে কী আছে। দেখল কাশের ব্যবহৃত গামছা লুঙ্গি জামা আর এক জোড়া স্পঞ্জের চপ্পল। সেগুলোর নিচে থরে থরে সাজান অনেকগুলি বীজের প্যাকেট। বিদেশি ফুলের রঙিন ছবি সেসব প্যাকেটে। আরও আছে দেশি শস্যের বীজ। উন্নত ফলনশীল রাই সরিষা, মাস কলায়, মটর মুগ এইসব। ফুল কাপড় চোপরগুলো হাতে নেড়ে নেড়ে প্রিয়তম কাশের স্পর্শ পাওয়ার চেষ্টা করে আর গন্ধ শুঁকে। কাপড়ে কাশের গায়ের গন্ধ পেয়ে চোখের জল মোছে।

নভেম্বরের গোড়ার দিকে একদিন এক জ্যোৎস্না রাতে ফুল ব্যাগে থাকা সব বীজের প্যাকেট নিয়ে ছুটে যায় গ্রামের মাঠে মধুমতির তীরে। তারপর প্যাকেট ছিঁড়ে ছিঁড়ে দুহাতে বীজ ছিটায় খেতে খেতে। পপি, ডেইজি, ডায়ান্থাস, জিনিয়া আর হলিহক ফুলের বীজ। রাই সরিষা মুগ মসুর মাস কলায় মটর খেসারীর বীজও ছিটিয়ে রদয়। মাত্র কয়েক দিনেই চরের উর্বর জমিতে খুব বাড়ন্ত হয়ে ওঠে ছড়ান বীজের চারাগুলি।

এর কয়েক দিন পর একদিন সন্ধ্যায় রাজাকারদের সঙ্গে মিলিটারিরা এলাকায় অপারেশনে আসে মুক্তিবাহিনীর খোঁজে। এসে জিজ্ঞাসা করে-মুক্তি কাঁহা হায় হিন্দু কী ধার হায়? না পেয়ে জ্বালিয়ে দেয় বাঘাটের ঘোষপাড়া আর ময়রা পাড়ার জনমানবহীন ঘরগুলোর অবশিষ্ট অংশ। পুড়িয়ে দেয় জেলেপাড়া তাতিপাড়ার পরিত্যক্ত বাড়িঘর। গুলি করে মারতে থাকে আশপাশের মানুষজনকে। ভয়ে গ্রামবাসীদের সঙ্গে দৌড়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় গুলি এসে লাগে ফুলের গায়ে এবং সেখানেই সে মারা যায়।

খবরটা শুনে হতাশ হয় কাশ। সাহসী এক মুক্তিযোদ্ধা কাঁদতে কাঁদতে বসে পড়ে মাটিতে। বালিয়াকান্দি আর ফেরা হয় না তার। হাঁটতে হাঁটতে আবারও ফিরে আসে মধুমতির তীরের সেই খেতে, সেই মাঠে, কাশফুলের বনে। যেখানে তার প্রিয়তমার হাতে ছড়ান বীজে বাহারি সব রঙিন ফুল ফুটে ফুটে রয়েছে। লাল রঙের পপিফুল-হলুদ সাদার ডেইজি-বৈসাদৃশ্য রঙের কোমল ডায়ান্থাস। বড় বড় আকৃতির জিনিয়া আর লম্বা গাছে ঘন্টাকৃতি হলিহক।

কাশ চোখের জল ফেলে আর হাত বুলাতে থাকে ফুলের পাপড়িতে। রঙিন ফুলে ফুলে ছাওয়া আর কাশফুলে পাওয়া এই বিজয় তার জীবনের সবকিছুই কেড়ে নেয়। কেড়ে নেয় প্রিয়তমার সান্নিধ্য পাওয়ার স্বপ্ন, ঘর বাঁধার সাধ। ভালোবাসার আকাঙ্ক্ষা মিশে যায় মধুমতির ঘূর্ণমান শীতল স্বচ্ছ জলে। সকল আসা ভরসা উড়ে যায় শ্বেত শুভ্র কাশফুলের বাতাসে।

প্রিয়তমা ফুলকে না পাওয়ার এক অব্যক্ত কষ্টের সঙ্গে কাশের অস্ফুট ব্যথার হাহাকার ছড়িয়ে পড়ে নদী পাড়ের সাদা কাশবনের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া হালকা দখিণা হাওয়ায়।

(পাদটীকা: ২০১৫ সালের মহান এই বিজয় দিবসে মাগুরার আকবর বাহিনীর সকল সদস্যকে জানাই আন্তরিক ফুলেল শুভেচ্ছা)

(লেখক কানাডার টরন্টোপ্রবাসী। ইমেইলঃ rana.tigerina@yahoo.ca) সৌজন্যে : প্রথম আলো

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *