আশরাফ উল্লাহ ও আহমেদ মুনির
পড়াশোনার জন্য দেশ ছেড়ে বাংলাদেশে এসেছেন তাঁরা। পড়ছেন চট্টগ্রামের এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনে। ১৬টি দেশের শিক্ষার্থীরা পড়েন এখানে। একেকজনের সংস্কৃতি একেক রকম। বাংলাদেশে এসে পরিচিত হয়েছেন এ দেশের প্রকৃতি, সংস্কৃতি, খাবার, উৎসব ও মানুষের সঙ্গে। বাংলাদেশের কোন কোন বিষয় সবচেয়ে ভালো লাগে তাঁদের? আর তাঁদের দেশের উৎসবের সঙ্গে আমাদের উৎসবের মিল-অমিলই-বা কেমন? প্রশ্ন দুটি আমরা করেছিলাম ভিয়েতনাম, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা, সিরিয়া, মালয়েশিয়া, চীন ও ভুটানের সাত শিক্ষার্থীর কাছে।

হ্লেইং মো
মানুষের অতিথিপরায়ণতা মুগ্ধ করার মতো
হ্লেইং মো
মিয়ানমার, রাজনীতি, দর্শন ও অর্থনীতি বিভাগ
বাংলাদেশের মানুষ খুবই বন্ধুবত্সল ও অতিথিপরায়ণ। এটা আমার খুব ভালো লাগে। এ দেশের দর্শনীয় স্থানগুলো বেশ সুন্দর। আমি ঘুরতে ভালোবাসি। ফলে, বাংলাদেশের যেসব দর্শনীয় স্থানে গেছি; মুগ্ধ হয়েছি। আমাদের মতোই বাংলাদেশের উত্সবে বেশ মিল পাই। তেমন কোনো ভিন্নতা নেই। উৎসবের সময় আমরা সবাই একত্র হই। গল্পগুজব করে সময় কাটাই; বছরের অন্যান্য সময়ে যেটা প্রায় অসম্ভব। আর এখানে আসার পর আমাদের অন্যতম প্রধান উৎসবের সময়গুলো কাটে নাচ, গান আর রান্না করে। বিশেষ করে রান্না করে সহপাঠীদের সঙ্গে ভাগ করে খেতে খুব ভালো লাগে।

জি এ রুমেশি পেরারা
বর্ণিল উৎসব মন ছুঁয়ে যায়
জি এ রুমেশি পেরারা
শ্রীলঙ্কা, অর্থনীতি বিভাগ
বাংলাদেশের উৎসবের মধ্যে ঈদ ছাড়াও পয়লা বৈশাখ ও পয়লা ফাল্গুনের বর্ণিল উৎসব মন ছুঁয়ে যায়। এ ছাড়া বিভিন্ন জেলার, যেমন: রাজশাহী, খাগড়াছড়ি ও চট্টগ্রামের ভিন্ন স্বাদের খাবার ভালো লাগে। আমার প্রিয় জায়গা রাজশাহী। যাওয়ার ইচ্ছা আছে সুন্দরবন, বান্দরবান ও সিলেটে।
বাংলাদেশি মানুষের অতিথিপরায়ণতা আমি খুব পছন্দ করি। বন্ধুসুলভ আচরণে মানুষকে সহজে আপন করে নেয় তারা। আমরা বাংলা নববর্ষের একই দিন, অর্থাৎ ১৪ এপ্রিল সিংহলি ও তামিল নববর্ষ উদ্যাপন করি। সে কারণে নববর্ষ আমাদের কাছে একদম নিজেদের উৎসব বলেই মনে হয়। এদিন আমরা সবাই মিলে নানা পদের খাবার রান্না করি, একে অন্যের খাবার ভাগ করে নিই। শ্রীলঙ্কায় আমাদের প্রধান উত্সবগুলো হলো সিংহলি ও তামিল নববর্ষ এবং বড়দিন। একেকটা উৎসব তিন থেকে চার দিন পর্যন্ত চলে।

মে আলহেরেক
বাংলাদেশের প্রকৃতি অসাধারণ
মে আলহেরেক
সিরিয়া, পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগ
বাংলাদেশের প্রকৃতি অসাধারণ! আর বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতির লোকজন আমার খুব পছন্দের। তাদের অতিথিপরায়ণতার প্রশংসা না করলেই নয়। তারা যেকোনো প্রয়োজনে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। এখানে অনেক ধর্মের লোক বসবাস করে। প্রত্যেকেরই নিজস্ব উৎসব আছে। আর উত্সবে বৈচিত্র্যও আছে। সিরিয়ায় এমন বৈচিত্র্য নেই। তবে এখানকার ঈদের সঙ্গে আমাদের দেশের ঈদ উদ্যাপনের মিল আছে। সাধারণত আমাদের উৎসবের সময় লোকজন রাস্তায় নেমে আসে এবং গোল হয়ে নাচতে শুরু করে। সারা দিন ধরেই নাচ চলে। উৎসব শুরুর কয়েক দিন আগে থেকে সিরিয়ার লোকজন তাদের বাড়িঘর সাজাতে শুরু করে। তৈরি করে বিশেষ ধরনের খাবার ও মিষ্টি। উৎসবের দিন পরিবারের সদস্যরা নানা-দাদা কিংবা পরিবারের বড় ছেলের বাসায় জড়ো হয়।

তেনডিন পেম
কক্সবাজার ও সেন্ট মার্টিনস দ্বীপ অনন্য
তেনডিন পেম
ভুটান, পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগ
বাংলাদেশের বেশির ভাগ জায়গাই আমার ভালো লাগে। বিশেষ করে বিনোদন ও পর্যটন স্থানগুলো অনন্য। কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত ও সেন্ট মার্টিনস দ্বীপ খুব ভালো লাগার জায়গা। ভুটানে এ রকম কোনো জায়গা নেই। আর এ দেশের মানুষের অতিথি আপ্যায়নের রেওয়াজ এককথায় অসাধারণ! নববর্ষের মতো আমাদের প্রধান উত্সবগুলোয় আমরা বিভিন্ন পদের খাবার রান্না করি, পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে বাড়িতে বসে আড্ডা দিই বা কোথাও বনভোজনে যাই। ভুটানের প্রতিটি জেলায় প্রতিবছর ধর্মীয় উৎসব শেচু উদ্যাপিত হয়। ওই উৎসবের সময় তো বটেই, বছরের আরও অনেক দিনেই আমরা জাতীয় পোশাক পরে মন্দিরে যাই। সেখানে আমরা নিয়ে যাই দুধ, ফলমূলসহ বিভিন্ন অর্ঘ্য। এ ছাড়া মুখোশনাচেরও আয়োজন করা হয় তখন। আমাদের বিশ্বাস, ওই নাচ দেখলে পুণ্য অর্জন করা যায়। বাংলাদেশের পয়লা বৈশাখও আমাদের উৎসবের মতোই বর্ণিল। খুব ভালো লাগে দিনটি।

ইয়ং ঝং চিউ
রোদ ঝলমলে দিন খুব উপভোগ্য
ইয়ং ঝং চিউ
চীন, অর্থনীতি বিভাগ
আমার বিশেষ পছন্দ বাংলাদেশের সবুজ পাহাড় আর সমুদ্র। আমি ছুটিতে বন্ধুদের সঙ্গে বান্দরবান, কক্সবাজার, সেন্ট মার্টিন ও রাঙামাটিতে বেড়াতে গিয়ে আনন্দময় সময় কাটিয়েছি। আমার আরও ভালো লাগে এখানকার গাছপালা; সারা বছর এসব গাছগুলো সবুজ থাকে। প্রথমবার এখানে এসে তো আমি চোখ ফেরাতে পারিনি! দেশে গিয়ে পরিবারের সদস্যদের যখন বললাম, সবাই বলল, ‘তুমি খুব ভাগ্যবান যে সারা বছর রোদ ঝলমলে আলোয় থাকো!’
নববর্ষ চীনে সবচেয়ে বড় উৎসব। ২০১২ সাল থেকে অবশ্য দেশে গিয়ে নববর্ষ উদ্যাপন করা হচ্ছে না। উৎসবের সময় সবাই আমরা ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরি। এ সময় রান্না করা হয় ঐতিহ্যবাহী সব খাবার। পাশাপাশি থাকে প্রচুর ফল ও পানীয়। উৎসব উপলক্ষে আমরা উপহার নিয়ে গ্রামের বয়সী আত্মীয়স্বজনের বাসায় যাই। উৎসবের দ্বিতীয় বা তৃতীয় দিনের মাথায় গ্রামে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। আশপাশের গ্রাম থেকেও লোকজন অনুষ্ঠান দেখতে আসে। পাঁচ দিন ধরে চলা উৎসবের একটা বড় অংশ কাটে রান্না ও উপহার জোগাড় করার কাজে। তবে আমি এখনো কোনো বাংলাদেশি পরিবারের বাড়িতে যাইনি। এখানে অবশ্য কিছু অনুষ্ঠানে বাংলা গান ও কবিতা শুনেছি। মনে হয়েছে অনেক কিছুই আছে, যা আমাদের মতো।

অশ্বিনী তামিল চেলভান
মানুষ ভালো লাগে
অশ্বিনী তামিল চেলভান
মালয়েশিয়া, জীববিদ্যা বিভাগ
চট্টগ্রাম ও এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনে আমার অনেক সুখস্মৃতি। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে গিয়ে খাওয়া বেশ কিছু খাবার ভালো লেগেছে। বাংলাদেশ আর ভারতের খাবার প্রায় এক। এটা আমার খুব পছন্দের। এ ছাড়া এখানকার বর্ণিল উত্সবগুলো দারুণ উপভোগ্য। এখানকার মানুষ সব ভেদাভেদ ভুলে একাত্ম হয়ে উৎসব উদ্যাপন করে, সেটা দেখে আমি সত্যিই মুগ্ধ হই। সবচেয়ে বড় ব্যাপার, একজন ভিনদেশিকেও তারা নিজ থেকে সহযোগিতা করে। মোট কথা, এ দেশের মানুষকে আমার খুব ভালো লাগে।
নিজেদের দেশে আমরা বিভিন্নভাবে উৎসব উদ্যাপন করি। কখনো একক পরিবারের ছোট পরিসরে, কখনো-বা যৌথ পরিবারের সব সদস্যের সঙ্গে আনন্দ ভাগ করে নিই। এখানে আমরা ১৪টি দেশের মেয়েরা একসঙ্গে চীনা নববর্ষ উদ্যাপন করি। আসলে একই উৎসব একেক দেশে ভিন্ন চেহারা নেয়। আমার দেশ মালয়েশিয়ায় অনেক জাতির মানুষের বসবাস। ভারতীয়, চীনা, মালয়—সব জাতির মানুষ আমরা একসঙ্গে ঈদ উদ্যাপন করি।

থিম থি লি
ফুটপাতের চটপটি আর ফুচকা দারুণ মজা
থিম থি লি
ভিয়েতনাম, অর্থনীতি বিভাগ
বাংলাদেশি খাবার আমার খুব প্রিয়। বিশেষ করে নানরুটি ও ফুটপাতের খাবার—চটপটি ও ফুচকা—দারুণ মজার। এ ছাড়া বাংলাদেশের উত্সবগুলো খুব আনন্দময়। উৎসব উদ্যাপনে আমাদের সঙ্গে বেশি পার্থক্য নেই বাংলাদেশের। অনেক ক্ষেত্রে সাজসজ্জা আর উৎসব উদ্যাপনের রীতিতে কিছুটা ভিন্নতা আছে। তবে আমরা এখানকার উৎসবের সময় ঘুরে বেড়াই। বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে লোকজনের সঙ্গে মেশারও একটা সুযোগ পাই তখন।
আমাদের উৎসবের মধ্যে চীনা চান্দ্র নববর্ষ প্রধান। একে আমরা টিইটির ছুটিও বলি। এ সময় ১০ দিনের ছুটি থাকে। এখানে আমরা ভিয়েতনামের ছাত্রীরা একসঙ্গে মিলে নববর্ষ উদ্যাপন করি। তবে খাবারদাবার বা ঘোরাঘুরির জন্য অত সময় তো নেই। কারণ, ভিয়েতনামের মতো এখানে অত ছুটি মেলে না। সৌজন্যে : প্রথম আলো