Skip to content

বিপজ্জনক ট্রেইল ধরে কংদুকত্লাং বিজয়

Kangduktlangফেরদৌস জামান
দেশের ঋতুবৈশিষ্ট্য অনুযায়ী পর্বতারোহণের জন্য উপযুক্ত সময় নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকে জানুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহের মধ্যে। অপরদিকে ঝরনা অথবা প্রকৃতির সবুজ সতেজতা উপভোগের সর্বোত্তম সময় জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহ থেকে অক্টোবরের মাঝামাঝি পর্যন্ত। সুতরাং অভিযাত্রীদের প্রায় সকলেই উল্লেখিত সময় দুটির জন্য অধির আগ্রহে থাকে। দেশের চতুর্থ সর্বোচ্চ শৃঙ্গ কংদুকত্লাং বা জগিহাফং সম্বন্ধে অবহিত হই দ্বিতীয় সর্বোচ্চ শৃঙ্গ জওত্লাং অভিযানের সময়।

ইচ্ছা এবং সময় উভয়ই ছিল কিন্তু বিশেষ করে আমার শারীরিক অবস্থা উপযুক্ত না থাকায় তখন নতুন গন্তব্যের চিন্তা মাথা থেকে ঝেরে ফেলতে হয়েছিল। জওত্লাং অভিযানের সময় স্যাঁতসেতে ঢালু পাথুরে পথে পিছলে গিয়ে আমার দুই হাটু ও কনুইয়ে আঘাত লেগেছিল। বেজক্যাম্পে দুই দিন বিশ্রাম করে ফিরে আসতে সক্ষম হয়েছিলাম। মৌসুম তো আর কারও জন্য অপেক্ষা করে না। সুতরাং দুই সপ্তাহ পর আবারও রওনা হই পাহাড় ও প্রকৃতির আহ্বানে।

বরাবরের মত অভিযানের ভিন্নতা ছিল তার ধরনে। যেমন লক্ষ্যে পৌঁছা বা জয় করার তাড়নায় ডানে-বামে না তাকিয়ে প্রকৃতির সৌন্দর্য মনের মত করে না দেখে দুরন্ত গতিতে কেবল নিষ্প্রাণ ট্রেকিং করা নয়, আমি বরং যাত্রাপথের চারপাশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলাম। উল্লেখিত উদ্দেশ্য থেকে অভিযানের পরিকল্পনায় সড়ল ও প্রচলিত পথে নয় বরং বিকল্প অথচ দীর্ঘ পথ বেছে নিলাম।

কংদুকত্লাং এর পরিচয় হলো, কংদুক মারমা শব্দ, যার অর্থ ন্যাড়া, সাথে যুক্ত হয়েছে বম শব্দ ত্লাং, অর্থ পাহাড়। দুয়ের যোগফল ন্যাড়া পাহাড়। শৃঙ্গটির অপর নাম জগিহাফং। ত্রিপুরা এই শব্দের অর্থও ন্যাড়া পাহাড়। জগি বলতে তারা ঠাকুরও বুঝায়। অতএব, সম্মানার্থে ত্রিপুরাগণ ‘ঠাকুর পাহাড়’ বলেও সম্বোধন করে। অবস্থান বান্দরবান জেলাধীন বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে। শেরকোড় পাড়া হয়ে ট্রেইল ধরতে হলো ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর ডটংপাড়া অভিমুখে। পরিচিত বসতি, গত একাধিক অভিযানে পাড়াটির মাঝ দিয়ে অনেকবার গিয়েছি। ঝিরিপথে ওঠা-নামা যে একেবারেই নেই তা নয়, পাহাড় শীর্ষে পাড়ার অবস্থান, ওঠার জন্য তৈরি হয়েছে বিকল্প পথ। পূর্বের পথ (তুলনামূলক সহজ) পরিত্যাক্ত হয়েছে কুসংস্কারজনিত একটি কারণে-বছর দুই আগে অজানা রোগে পাড়ার এক কিশোরীর মৃত্যু হলে তাকে কবর দেয়া হয় পথের পাশে। তারপর থেকেই পাড়ার লোকজন নাকি ভূতপ্রেত দেখা শুরু করে।

Kangduktlang2

যাই হোক, খাঁড়া ট্রেইল বেয়ে ওপরে উঠে আশ্রয় মিলল তাদের মাঝে সবচেয়ে বেশি বাংলা জানা এক বৃদ্ধের ঘরে। ব্যাগ থেকে স্যুপ ও নুডলস্ বের করে রান্না করা হলো। অচেনা অদেখা খাবার রান্না করা দেখতে পাড়ার লোকেদের ঢল নামলো। খাওয়া শেষে সামান্য বিশ্রাম, তারপর যে যার মত বেরিয়ে পড়লাম পাড়া ও পাড়ার আশপাশ দেখতে। সন্ধ্যার পরেই খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়লাম। কিসের ঘুম, একেকজনের মুখে অভিজ্ঞতার বিচিত্র সব গল্প শুনতে শুনতে রাত প্রায় দশটা বেজে গেল। এখানে বলে রাখা ভালো, পাহাড়ি এলাকা দশটা মানে কিন্তু গভীর রাত। পরের দিনের পথ একেবারে মে মং পাড়া পর্যন্ত। অসাধারণ পথ, জুম ঘর, জুম ক্ষেত আর মূহুর্তে মূহুর্তে সাদা মেঘের কোমল পরশ। এমনি করে খাল ও ঝরনা ধরে একাধিক পাহাড় চূড়া মাড়িয়ে সন্ধ্যার আগ দিয়ে কাঙ্খিত পাড়ায় উপস্থিত হতে সক্ষম হলাম।

পাড়া থেকে কংদুকত্লাং এর দূরত্ব এ্যারোপ্লেন মুডে আট কি.মি.। মাঝে রাত্রিযাপনের জন্য কোনো পাড়া নেই। সুতরাং একদিনেই ফিরে আসতে হবে। ঝিরি ধরে ট্রেকিং এর পর ওপরে বেশ কয়েকটি জুম ক্ষেত রয়েছে, সেগুলোকে কেন্দ্র করে সিঁড়ি কেটে বানানো পথ, চলতি পথে বিশ্রামের জন্য পরিত্যাক্ত জুমঘরগুলো ছিল বেশ উপযোগী। পরিত্যাক্ত হলেও চারপাশে দেখলাম রয়েছে মরিচ, বেগুনসহ নানা রকম সবজি। ইতিমধ্যেই অনেক উপরে ওঠা হয়েছে, সমস্ত পাহাড় যেন পায়ের নিচে। পেছনে ফিরে তাকালে দেখা যায় তাজিনডং, খানিক ফাঁকে ধনেশ পাহাড়। অনেক ধনেশ পাখির বসবাস বলে স্থানীয়রা পাহাড়টির এমন নাম দিয়েছে। দূর্গম হওয়ায় কেউ সেখানে যেতে পারে না। আরও দুই ঘণ্টা আরোহণের পর পেছনে চোখে পড়ে সবুজ পাহাড় সারির শীর্ষ ধরে লাল মাটির উজ্জল রেখা। অল্প পড়াশোনা জানা গাইড লালতন বম অনেক খবর রাখে। সে জানাল, রেখাটি আসলে নির্মানাধীন পথ, যা টেনে নিয়ে যাওয়া হবে থানচী থেকে মদক পর্যন্ত। পথটি মূলত দীর্ঘ দিন পর সংস্কার করা হচ্ছে। অর্থাৎ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মিত্রবাহিনী তাদের রণকৌশলের অংশ হিসেবে পথটি তৈরি করেছিল।

Kangduktlang3

সচেতন লালতন কেবল একটি ক্ষেত্রেই অসচেতনতার জোরালো স্বাক্ষর রেখেছে ৩১ বছর বয়সে ছয়-ছয়টি সন্তানের জনক হওয়ার গৌরব অর্জনের মধ্য দিয়ে। সে একজন দক্ষ শিকারীও। পশুপাখি সব শিকার করে খেয়ে ফেললে প্রকৃতির ভারসাম্য বজায় থাকবে কী করে? এমন উদ্বেগের প্রতিক্রিয়ায় সে জানাল, শিকারের ক্ষেত্রে তারা একেবারে অবিবেচক নয়। যেমন মে-জুন মাসে তারা ধনেশ শিকার করে না, কারণ এটি বাচ্চ ফোটার মৌসুম। সে সময় প্রাকৃতিকভাবেই মা-ধনেশের শরীরের সমস্ত পালক ঝরে পড়ে। ফলে তাকে বাচ্চার সাথে গাছের ফোকড়ে আবদ্ধ থাকতে হয়। তাই খাবার জোগাড়ের দায়িত্ব পড়ে বাবা ধনেশের ওপর। স্বাভাবিকভাবেই বাবাকে তখন বাইরে থাকতে হয়। সুতরাং উল্লেখিত সময়ে বাবা ধনেশ শিকার করলে খাদ্যের সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ফোকড়ে আবদ্ধ মা ও বাচ্চাসহ পুরো পরিবার মৃত্যুর সম্মুখীন হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

তাদের এমন সচেতনতায় অভিভূত না হয়ে পারলাম না। পাশাপাশি ভাবলাম, কিসের জাটকা, কিসের ডিমওয়ালা মা-মাছ অথবা রানি মাছ, যা পাই নির্বিচারে সবই আমরা সাবাড় করে দেই। অবিবেচকের মত বনের পশুপাখি হত্যার বিষয় তো রয়েছেই, যা থেকে সুদূর সাইবেরিয়া ও অন্যান্য জায়গা থেকে উড়ে আসা অতিথি পাখিরাও রেহাই পায় না। অথচ এই পাহাড়ে এরা কত সচেতন।

Kangduktlang4

বেলা ১২.৪৫ মিনিটের মধ্যে একে একে সকলেই কংদুকত্লাং-এ আরোহণ করতে সক্ষম হই। শেষের প্রায় পঁচিশ মিটার ট্রেইল ভীষণ বিপজ্জনক। টিনের চালার শীর্ষদেশ আকৃতির কোণ, তা-ও আবার হেলানো। বাম পশে হালকা গাছপালা থাকলেও ডান পাশটা হাজার ফুট খাড়া খাঁদ। হাত বাড়িয়ে ধরলেই ভিন্ন একটি দেশের পরশ- এ যেনো স্বপ্ন! কোনোমতে চার হাত-পায়ে হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে শেষাংশে অপেক্ষাকৃত উঁচু প্রস্তর খণ্ডটিই কংদুকত্লাং। একজন দাঁড়ানোর মতো শৃঙ্গ। ছবি তোলার ইচ্ছা বাস্তবায়নে গাইডের সহায়তায় চূড়ায় একজনকে বসিয়ে সামনে ও বামে বাকি তিনজন বসতে হলো। নামবার পথে এক বন্ধুর মাথা চক্কর দিয়ে উঠল। সুতরাং তার জন্য অপেক্ষা করতেই হলো। অপেক্ষার পর এবারও গাইডের সহায়তায় তাকে বিশেষ কায়দায় নিচে নামিয়ে আনলাম। এ দিন থে খাবার হিসেবে ছিল পর্যাপ্ত পানি এবং আগের দিন রাতে পাড়া থেকে ত্রিশ টাকায় কেনা আধছড়ি পাকা কলা। সৌজন্যে : রাইজিংবিডি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *