Skip to content

বিমানভ্রমণ সমাচার

শফিক ইসলাম জুরং (সিঙ্গাপুর) থেকে
আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন ছিল না কোনো দিনই, বাতাসে ভাসার অলীক কল্পনাও না। অগত্যা জীবিকার তাগিদে বিদেশ বিভুঁইয়ে পাড়ি জমাতে নিয়মিতই বাতাসে ভাসতে হচ্ছে। ছোটবেলায় উড়োজাহাজের শব্দ নাকি ভীষণ ভয় পেতাম। আর তাই আমি উঠোনে থাকাকালে উড়োজাহাজের শব্দ ভেসে আসলে মা-চাচিরা ছুটতেন শব্দের ভয় পাওয়া থেকে আমাকে বাঁচাতে। এখন বিমানে চড়লে প্রায়শই এটা মনে পড়ে। এখন বিমানভ্রমণের বিচিত্র কিছু অভিজ্ঞতা তুলে ধরব।

Shafiq

লেখক শফিক ইসলাম

প্রথমবার ভ্রমণ করি সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনসে। স্বভাবতই অনেক কিছুই খেলে যাচ্ছিল মনের ভেতরে। একই কোম্পানির আমরা ৩০ জন, অধিকাংশই নব্যযাত্রী। লাউঞ্জে পাশে বসা আমার মতোই নব্য যাত্রীকে পুরোনো একজন ভেতরে কী হবে তা বলে দিচ্ছিল। যা হোক, তিন সিট পাশাপাশি। মাঝখানের বসা যাত্রী জানালার পাশে বসা যাত্রীকে সিট বদলাতে অনুরোধের ঢেঁকি গেলাতে পারল না। একটু পর বিমানবালা নিয়ে এলেন সাদা রোল। আশপাশে তাকাচ্ছিলাম বোঝার জন্য আসলে জিনিসটা কী। কিছু বুঝে ওঠার আগেই জানালার পাশের যাত্রী মুখে দিয়ে কামড় দিতেই কেউ যেন হেসে দিল। ততক্ষণে বুঝতে বাকি রইল না এটা তোয়ালে।

প্লেনের টয়লেটে ঢোকার পরও ওপরে ভ্যাকেণ্ট লেখাটা জ্বলজ্বল করছিল। বুঝতেই পারছিলাম ছিটকিনি আটকায়নি। আমি লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলাম টয়লেটে যাওয়ার জন্য। হঠাৎ​ এক আপু আমাকে টপকিয়ে চলে গেলেন। বিপত্তি ঘটল তখনই। আপু দরজা ধাক্কা দিয়েই চোখ ছানাবড়া। লজ্জার হাসি ঢেকে গেল দুহাতের আড়ালে। আমি তখনো লাইনে দাঁড়ানো (হাসি চাপানোর বৃথা চেষ্টারত)। ভাবছিলাম ভেতরে থাকা লোকটার কথা, সে আসলে কোন অবস্থায় ছিল।

আমাদের বাংলাদেশ বিমানে চড়ার সৌভাগ্য হয়েছে একবার। সিট নিয়ে রীতিমতো ঝগড়া, একজন আরেক জনের সিটে বসছে। বিমানবালাদের অসহায় আত্মসমর্পণের মতোই অবস্থা। বিমান উড়তে শুরু করার পর বুঝতে পারছিলাম না ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ যাচ্ছি নাকি প্লেনেই আছি। মালপত্রে বোঝাই, একেক জনের দু-তিনটা বাক্স পোটরা। যাত্রী সেবার মান এতটাই বিশ্বমানের (!) ছিল যে উল্লেখ না করাই ভালো। পাশে বসা যাত্রী বলতে শুরু করলেন, এটা বাংলাদেশ রেলওয়ের ফ্লাইং ভার্সন, ঠিকমতো স্টেশন পৌঁছতে পারলেই বাঁচি।

একবার সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনসে খাবার অর্ডার নিতে আসা বিমানবালা বিপত্তিতে পড়েছিলেন। দুটো মেন্যু থেকে একটা পছন্দ করতে হবে। কিন্তু আমি ইচ্ছে করেই বলেছিলাম আমি দুটোই নেব। বিমানবালা কয়েকবার চেষ্টা করলেন আমাকে বোঝাতে যে, একটার জন্য অর্ডার করা যাবে। যতবারই বোঝাচ্ছেন একবারও মুখে বিরক্তির রেশ পর্যন্তও পরিলক্ষিত হলো না। শেষে বললাম যে মজা করছিলাম। মজার ভেতর একটা জিনিস ঠিকই উপলব্ধি করলাম, আর তা হলো, সম্মান ধরে রাখা সহজ সাধ্য নয়। সিঙ্গাপুরে এয়ারলাইনস এ জন্যই হয়তো বিশ্বসেরা।

প্লেনের টয়লেটের ফ্লাশে চাপ দিলে এত শব্দ হবে তা ভাবতে পারিনি। এ নিয়ে একদিন কথা উঠতেই এক ভাই বললেন, উনি নাকি রীতিমতো ভয়েই অস্থির যে ভুল কিছু করে বসলেন নাকি।

Biman

আর একবার একযাত্রী পেলাম যিনি সকল নিয়ম মেনে চলেন। ইলেকট্রনিক ডিভাইস বন্ধ করার ঘোষণার পরও একজন যখন ফোনে ভিডিও করা চালিয়ে যাচ্ছিলেন, ওই যাত্রী তো রীতিমতো তার ওপর চড়াও হতে উদ্যত হলেন। বাংলাদেশি যাত্রীদের অনেককেই দেখা যায় সিট বেল্ট বাঁধতে ও ইলেকট্রনিক ডিভাইস বন্ধ করতে চান না। বিমান মাটিতে নামতে না নামতেই বের হতে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেন। হরতালে পুলিশের ধাওয়া খাওয়ার মতো।

থাই এয়ারে দেশে ফিরছিলাম। নাটকপাড়ার কিছু সেলিব্রিটি পেয়েছিলাম একই ফ্লাইটে। হয়তো শুটিং শেষে ব্যাংকক থেকে ঢাকার পথে। বন্ধুসম একজন বললেন, একটু মজা করে আসি। ফিরে এসে হতাশ হয়ে বললেন, মজা করার কোনো উপায় নাই, আশপাশে যাত্রীদের কাছ থেকে পরিচালকের মতো উপদেশ ও পরামর্শে সেলিব্রিটিদের কাছে বিমান যেন ছিপি আটকানো পাইপলাইন। ছিপির মুখ (প্লেনের দরজা) না খোলা না পর্যন্ত এ থেকে নিস্তার নাই। দিন বদলেছে এখন ছিপি আটকানো পাইপলাইনে অনেক অভিনয় শিল্পীই দেখা যায়, কিন্তু মানুষের আগ্রহ কম। শিল্পী বেশি বলে, নাকি অভিনয়ের মান নিম্নমুখী বলে অথবা সবাই নিজেকে সেলিব্রেটি ভাবে সে জন্য তা ভাবনারই বিষয়।

এক এয়ারলাইনসে খাবার খেতে টাকা গুনতে হয়েছে বলে (কোম্পানি শুধু টিকিট কিনেছে) পরের বার অন্য এক এয়ারলাইনসে চড়ার সময় এক অধস্তন বিমানবালার খাবারের অনুরোধ পায়ে ঠেলে দেয় (যদি অর্ডার নেবার পর টাকা চায়!)। অন্য আরেক সহকর্মী এ কথা অফিসে বলার পর হাসির রোল।

বিজনেস আর ইকোনমি ক্লাসের বাইরেও যে আরও একটা ক্লাস আছে তা উপলব্ধি করি দেশীয় ও প্রতিবেশী এয়ারগুলোতে। ইকোনমির ভেতরে যাত্রীদের পোশাক-পরিচ্ছদে বৈমানিক ও তাদের সহকারীদের ব্যবহারের পার্থক্য চোখে পড়ে। যেমনটি পড়ে একই ক্লাসের যাত্রী হয়েও জাতিভেদের কারণে।

Shafiq2

বিমানে পরিবেশিত খাবার

প্লেনে বিমর্ষ মুখ দেখলেই নানা প্রশ্ন দোল খেয়ে যায়। প্রবাসের পথে পাড়ি জমানোর ক্ষেত্রে ধরে নেওয়া যায় হয়তো পরিজন ছেড়ে দূর দেশের পথে তাই বিমর্ষ। কিন্তু দেশের পথে বিমর্ষ বদন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আত্মীয় বিয়োগে শেষ দেখার জন্য, অনেক ক্ষেত্রে সঙ্গে হয়তো লাশ বহন করছে। আবার অনেক সময় দালালের প্রতারণার শিকার, কিছু বোঝার আগেই ফিরতি ফ্লাইটে দেশে পাঠিয়ে দিয়েছে। সঙ্গে দিয়েছে অনিশ্চয়তা ও ঋণের বোঝা। চারপাশের বাড়িফেরার যাত্রীদের হাস্যোজ্জ্বল আলো ঝলমলে মুখগুলো বিমর্ষ বদনে আকাশ পাড়ির বেদনাগ্রস্ত মুখগুলোর বিষণ্নতা বাড়িয়ে দেয়, তার খোঁজ অবশ্য কেউ রাখে না।

বিমান ভ্রমণে কারওও প্রেম হয়েছে বা তার সূত্রপাত হয়েছে কিনা জানি না তবে ঝগড়া হতে দেখেছি। বাস্তবের আর গল্পের ভ্রমণ অনেক ক্ষেত্রেই অমিল।

স্কুলে পড়া জার্নি বাই প্লেন আর বাস্তবের পাইপলাইনের বিমানভ্রমণের মাঝে তফাৎ অনেক। সবচেয়ে বড় তফাৎ হলো সেই জার্নির প্লেন কখনোই দুর্ঘটনায় পতিত হয়নি, উধাও–ও হয়ে যায়নি। সে জার্নিতে নাই পরিবার পরিজনদের উদ্বিগ্নতার লেশমাত্র। সবার বিমানভ্রমণ হোক স্কুলের জার্নি বাই প্লেনের মতো সুখময়। সৌজন্যে : প্রথম আলো

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *