
বীরশ্রেষ্ঠ ল্যান্স নায়েক মুন্সী আব্দুর রউফের সমাধিস্থল।
:: পলাশ বড়ুয়া, দীঘিনালা (খাগড়াছড়ি) ::
হ্রদের মাঝে বাঁশের মাথায় বসে আছে পাখি। পানিতে পানকৌড়ির দল। জেলেরা ছোট্ট নৌকা নিয়ে মাছ ধরায় ব্যস্ত। শিশুরা নৌকা নিয়ে বাড়ির পথে। পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙামাটি জেলার নানিয়ারচর বুড়িঘাট ইউনিয়নের ভাঙ্গামুড়া এলাকা। চারদিকে কাপ্তাই লেকের পানিবেষ্টিত। এখানেই ছোট একটি টিলায় বীরশ্রেষ্ঠ ল্যান্স নায়েক মুন্সী আব্দুর রউফ সমাধি।
সম্প্রতি সেই সমাধিস্থলে যাওয়ার সুযোগ হয়। সকাল আটটায় দীঘিনালা থেকে পিকআপ নিয়ে শুরু হলো যাত্রা। খাগড়াছড়ি শহরে গিয়ে বীরশ্রেষ্ঠের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি জানানোর জন্য কেনা হলো ফুল। ফুল কিনে খাগড়াছড়ি থেকে কয়েকজনকে নিয়ে চূড়ান্ত যাত্রা নানিয়ারচরের পথে। নানিয়ারচর যেতে সড়কের পাশে চোখে পড়ে আনারসবাগান। যেন পাহাড়ের বুকে কেউ কারুকাজ করে রেখেছে। বেলা সাড়ে ১১টায় আমরা পৌঁছে যাই নানিয়ারচর ডাকবাংলা ঘাটে। ঘাটে ইঞ্জিনচালিত নৌকা নিয়ে অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিলেন শিবুনাথ। সেখান থেকে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় জিনিসপত্র নিয়ে চেঙ্গী নদী ও কাপ্তাই লেক ধরে বীরশ্রেষ্ঠর সমাধিস্থলে রওনা হলাম। বিশাল জলরাশির মধ্যে দল বেঁধে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় চলছে। পানকৌড়ির দল ইঞ্জিনের আওয়াজ পেয়ে দেয় ছুট। সাদা পালকের বক মাছ ধরার আশায় নিশ্চুপ। এরই মধ্যে চলে আসে সমাধিস্থল। সবাই সমাধিস্থলে ওঠার আগে জুতা-স্যান্ডেল খুলে রাখি। তারপর সমাধিস্থলে গিয়ে শ্রদ্ধা জানান, পালন করেন এক মিনিট নীরবতা।

কাপ্তাই হ্রদে দেখা মিলবে এমন উড়ন্ত পানকৌড়ির।
১৯৭১ সালের ২০ এপ্রিল অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি অংশ, তৎকালীন ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের (ইপিআর) কিছু সদস্য পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙামাটি ও তৎকালীন মহালছড়ি থানার বুড়িঘাট চিংড়ি খাল এলাকায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধরত ছিল। ওই দিন ভারী অস্ত্রশস্ত্রসহ তিনটি লঞ্চ ও দুটি স্পিডবোট বোঝাই করে মুক্তিযোদ্ধাদের চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে আকস্মিক আক্রমণ শুরু করে। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরক্ষাবলয় সম্পূর্ণ ভেস্তে পড়ে। হানাদার বাহিনীর প্রবল আক্রমণের মুখে মুন্সী আব্দুর রউফ মেশিনগান নিয়ে শত্রুদের সঙ্গে লড়ে অন্য সহযোদ্ধাদের নিরাপদে সরে যেতে সাহায্য করেন। যুদ্ধে হানাদার বাহিনীর দুটি লঞ্চ ও একটি স্পিডবোট পানিতে ডুবে যায় এবং দুই প্লাটুন সৈন্য মারা যায়। হানাদার বাহিনীর ছোড়া একটি মর্টারের আঘাতে মুন্সী আব্দুর রউফ শহীদ হন। ১৯৯৬ সালের ২৫ এপ্রিল মুন্সী আব্দুর রউফের সহযোদ্ধা ও এলাকাবাসীর সহযোগিতায় সমাধিস্থল চিহ্নিত করা সম্ভব হয়। ২০০৬ সালের ২৫ মার্চ রাইফেলের ভাস্কর্যসংবলিত স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়। বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফকে সমাহিত করেছিলেন বুড়িঘাট ভাঙ্গামুড়া এলাকার দয়াল কৃষ্ণ চাকমা।
কীভাবে যাবেন: বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফের সমাধিস্থলে ঢাকা ও চট্টগ্রাম থেকে খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি হয়ে যাওয়া যায়। ঢাকার কমলাপুর, ফকিরাপুল, গাবতলী ও কলাবাগান থেকে খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটির বিভিন্ন পরিবহনের চেয়ারকোচ ছাড়ে। এ ছাড়া চট্টগ্রামের অক্সিজেন থেকেও এ দুই জেলার গাড়ি ছাড়ে। ঢাকা থেকে নৈশকোচে এসে সকালে নেমে খাগড়াছড়ি থেকে নানিয়ারচর অথবা রাঙামাটি শহরে নেমে রিজার্ভ বাজার জেটিঘাট থেকে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় সমাধিস্থল যাওয়া যায়। ভাড়া তেমন বেশি নয়, নানিয়ারচর থেকে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় রিজার্ভ যাতায়াত পড়বে ৮৫০ টাকা। এক নৌকায় ৩০-৩৫ জন যাওয়া যায়। সৌজন্যে: প্রথম আলো