Skip to content

ব্রিটিশ ভিসা পেতে সীমাহীন ভোগান্তি

রাশেদ মেহেদী
ঢাকায় যুক্তরাজ্য হাইকমিশন সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে আশ্বস্ত করেছিল ভিসা সেন্টার দিল্লিতে স্থানান্তর হলেও ঢাকা থেকে ভিসা পেতে কোনো সমস্যাই হবে না। বরং আরও যত্নের সঙ্গে ভিসা আবেদনগুলো দেখা হবে। তবে ২০১৪ সালের ১ অক্টোবর থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের ভিসাপ্রার্থীদের অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। অনেক ক্ষেত্রেই ঘটছে সীমাহীন ভোগান্তি। ভিসা চেয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন কিংবা সময়মতো ভিসা পাননি এ তালিকায় যুক্ত হয়েছেন দেশের একাধিক মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, সচিব, ব্যবসায়ী এবং খ্যাতিমান সাংবাদিকরাও।

ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, ভিসা প্রত্যাখ্যানের চেয়েও বেড়েছে সময়মতো ভিসা না দেওয়ার ঘটনা। ফলে লন্ডনসহ যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন শহরে গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে যোগদান, ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা সবকিছুই ব্যাহত হচ্ছে।

British Visa

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ঢাকায় ভিসাকেন্দ্র থাকার সময়ে মোট আবেদনের ৬৯ শতাংশ আবেদনই গ্রহণ করা হতো। দিল্লিতে যাওয়ার পর ভিসা পাওয়ার সংখ্যা প্রায় ৫০ শতাংশে নেমে এসেছে। ভিসার আবেদনের পর সাধারণ ক্ষেত্রে ১৫ দিনের মধ্যে এবং বিশেষ ক্ষেত্রে (প্রিমিয়াম ভিসা) ৭ দিনের মধ্যে ভিসা ইস্যুর জন্য যুক্তরাজ্য সরকারের ঘোষিত নীতি হলেও দিল্লিতে ভিসাকেন্দ্র স্থাপনের পর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভিসাসহ পাসপোর্ট ফেরত দিতে এক মাস কিংবা তার বেশি সময় নেওয়া হচ্ছে। এসব বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে সদ্য ঢাকা সফর করে যাওয়া যুক্তরাজ্যের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী ডেসমন্ড সোয়াইন জানিয়েছেন, শুধু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এককভাবে ভিসাকেন্দ্র সরিয়ে নেওয়ার ঘটনা ঘটেনি। ব্যয় সংকোচনের কেন্দ্রীয় নীতি হিসেবে আরও অনেক দেশ থেকেই ভিসাকেন্দ্র সরিয়ে একটি কেন্দ্রে নিয়ে আসা হয়েছে। ভিসার আবেদন নিষ্পত্তিতে যেন দীর্ঘ সময় না লাগে সে জন্য ভিসাকেন্দ্রগুলোতে জনবল বাড়ানো হবে বলেও তিনি জানিয়েছেন। এখন ভিসাকেন্দ্র পুনরায় ঢাকায় নিয়ে আসা সম্ভব নয় বলেও স্পষ্টই জানিয়ে দেন তিনি।

এ দিকে দিল্লিতে ভিসাকেন্দ্র স্থানান্তরের পর জটিলতা দিন দিন বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে প্রবাসীদের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছে। এ ব্যাপারে ব্যাপকভিত্তিক কর্মসূচি পালনের জন্য প্রবাসী এবং দেশে থাকা তাদের স্বজনরা মিলে একটি সমন্বয় কমিটিও গঠন করেছেন। কমিটির আহ্বায়ক ফয়জুর রহমান সমকালকে জানিয়েছেন, তারা এ পর্যন্ত ভিসার আবেদন করে প্রত্যাখ্যাত হওয়া এবং সময়মতো ভিসা না পাওয়ার ৫০১টি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ সংগ্রহ করেছেন। এগুলো সমন্বিত করে যুক্তরাজ্য কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হবে।

সম্প্রতি লন্ডনে একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের এমপি ও বঙ্গবন্ধুর নাতনি টিউলিপ সিদ্দিক জানিয়েছেন, বিষয়টি তারা পার্লামেন্টেও তুলবেন। পার্লামেন্টের তিন বাঙালি এমপি যৌথভাবে উদ্যোগ নিয়েছেন ভিসাকেন্দ্র পুনরায় ঢাকায় ফিরিয়ে আনার জন্য।

তিক্ত অভিজ্ঞতার খণ্ডচিত্র

মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি গত মে মাসে লন্ডনে একটি মেলা উদ্বোধনের জন্য নিমন্ত্রিত হয়েছিলেন। তিনি জানান, প্রায় দীর্ঘ সময় পার হওয়ার পরও ভিসা না পাওয়ার কারণে তিনি নিজেই পাসপোর্ট ফেরত নেন। কারণ তার অন্য দেশে অনুষ্ঠান ছিল। সময়মতো ভিসা না পাওয়ার কারণে তিনি লন্ডনে ওই মেলা উদ্বোধনে যেতে পারেননি।

বরিশাল-২ আসনের সংসদ সদস্য তালুকদার মো. ইউনুস জানান, তিনিসহ চারজন চলতি বছরের শুরুর দিকে ব্রিটিশ ভিসার আবেদন করেছিলেন। আবেদনকারীদের মধ্যে সরকারের একজন সচিবও ছিলেন। দলের কাউকেই ভিসা দেওয়া হয়নি। ফলে লন্ডনে একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে তিনি অংশ নিতে পারেননি। সরকারের সেই সচিবের সঙ্গে আলাপ করলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, সরকারের পূর্ণ মন্ত্রীসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ভিসার আবেদন করে সময়মতো ভিসা পাননি, অনেকে প্রত্যাখ্যাতও হয়েছেন। এ কারণে তার একার ভিসা না পাওয়ার বিষয়টি তিনি ততটা গুরুত্বপূর্ণ মনে করছেন না।

গুরুত্বপূর্ণ একটি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা সরকারের একজন পূর্ণ মন্ত্রী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, কয়েক মাস আগে তিনিসহ আরও পাঁচ-ছয়জন একসঙ্গে যুক্তরাজ্যের ভিসার আবেদন করেছিলেন। যাদের লাল পাসপোর্ট ছিল তাদের ভিসা দেওয়া হয় এক মাস পর, আর যাদের সবুজ পাসপোর্ট ছিল তাদের দেওয়া হয় ১০ থেকে ১২ দিনের মধ্যে। তিনি বলেন, মনে হচ্ছে বর্তমানে লাল পাসপোর্টের ক্ষেত্রেই জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রতা হচ্ছে বেশি। এটা কেন, তার কারণ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না।

সমকালের নির্বাহী সম্পাদক মুস্তাফিজ শফি গত জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহে লন্ডনে সংহতি সাহিত্য পরিষদের রজতজয়ন্তী অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার জন্য গত ২৮ জুন ভিসার আবেদন করেন। তিনি জানান, তার বায়োমেট্রিক আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয় গত ৯ জুলাই। তাকে ভিসাসহ পাসপোর্ট ফেরত নেওয়ার জন্য যুক্তরাজ্য হাইকমিশনের চুক্তিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান থেকে জানানো হয় গত ১২ আগস্ট। তিনি পাসপোর্ট পাওয়ার পর দেখেন তার ভিসা ইস্যুর তারিখ ১৩ জুলাই। অথচ তিনি অগ্রগতি জানতে চেয়ে ই-মেইল করলে গত ২৮ জুলাই তার আবেদনের স্ট্যাটাস দেখানো হয় ‘ইন প্রগ্রেস’। তার অনুষ্ঠান হয়ে যায় ১ আগস্ট। ফলে তার যাওয়া হয়নি। এ ঘটনায় দিল্লি থেকে ভিসার আবেদন বিবেচনার ক্ষেত্রে প্রক্রিয়াগত জটিলতা স্পষ্ট হয়ে যায়।

যুক্তরাজ্যের ভিসা জটিলতা নিরসনে গঠিত সমন্বয় কমিটির সদস্য সচিব শামস উদ্দিন জানান, তাদের কাছে অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে। যেখানে সঠিকভাবে কাগজপত্র দেওয়ার পরও ভিসা দিতে অহেতুক বিলম্ব করা হয়েছে। তিনি বলেন, এটি কৌশল হতে পারে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নির্ধারিত সময়ে আবেদনের পরও অনুষ্ঠান এবং ভ্রমণের নির্দিষ্ট তারিখের পর ভিসা দেওয়া হচ্ছে, যা কোনো কাজে আসছে না। তিনি জানান, এরই মধ্যে লন্ডনে এ বিষয়টি নিয়ে মানববন্ধন হয়েছে। সবার অভিজ্ঞতা ও অভিযোগ সমন্বিত করে বৃহত্তর পরিসরে কর্মসূচি পালনের প্রস্তুতি চলছে কমিটির পক্ষ থেকে।

লন্ডনে গত ফেব্রুয়ারি মাসে ব্রিটিশ কারি অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠানের আয়োজক ও প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী এনাম আলী এক সংবাদ সম্মেলনে একই ধরনের অভিযোগ করে বলেন, ২০১৪ সালের অক্টোবর মাসের পর থেকে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সময়মতো ব্রিটিশ ভিসা দেওয়া হচ্ছে না। ফলে অসংখ্য ব্যবসায়ী ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি লন্ডনে বিভিন্ন আয়োজনে অংশ নিতে পারছেন না।

গত তিন বছরের তুলনামূলক চিত্র

যুক্তরাজ্য প্রবাসী ও সংশ্লিষ্ট কূটনৈতিক সূত্রে জানা যায়, ২০১৩ সালে ঢাকায় বৃটিশ হাইকমিশনে ৩০ হাজার ৪১৮ জন আবেদন করেন। এর মধ্যে সাধারণ ক্যাটাগরিতে ১৫ হাজার ২৯০ জনকে, ৭ হাজার ৬২৯ জনকে পারিবারিক ক্যাটাগরিতে এবং ২ হাজার ৬২৮ জনকে শিক্ষার্থী ক্যাটাগরিতে ভিসা দেওয়া হয়। অর্থাৎ ওই বছর মোট আবেদনকারীর ৮৩ শতাংশই ভিসা পেয়েছিলেন। ২০১৪ সালে প্রায় ৩২ হাজার আবেদনকারীর মধ্যে প্রায় ২১ হাজার ভিসা পান। চলতি বছরে এ পর্যন্ত প্রায় ১৯ হাজার আবেদনকারীর মধ্যে ৯ হাজারের কিছু বেশি আবেদনকারী ভিসা পেয়েছেন বলে লডনের সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়।

এ ব্যাপারে সঠিক তথ্য জানতে চেয়ে সমকালের পক্ষ থেকে গত ১৭ আগস্ট ঢাকায় যুক্তরাজ্য হাইকমিশনের প্রেস অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের প্রধান কর্মকর্তা ফৌজিয়া ইউনুস সুলেমানের কাছে ই-মেইল পাঠানো হয়। পরে তার সঙ্গে সরাসরি টেলিফোন আলাপ করে বিষয়টি জানালে তিনি ই-মেইল বার্তা পাওয়ার কথা স্বীকার করেন এবং সংশ্লিষ্ট শাখার মাধ্যমে দ্রুত তথ্য দেওয়া হবে বলে জানান। পরবর্তী সময়ে আরও একাধিকার সংশ্লিষ্ট শাখার কর্মকর্তাদের সঙ্গেও টেলিফোনে আলাপ হয়। তবে গতকাল ২৬ আগস্ট পর্যন্ত সেই ই-মেইলের কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।

যুক্তরাজ্যের মন্ত্রী ও ঢাকায় ব্রিটিশ হাইকমিশনারের বক্তব্য

তিন দিনের ঢাকা সফরের শেষ দিনে গত ২৫ আগস্ট যুক্তরাজ্যের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী ডেসমন্ড সোয়াইনের কাছে সংবাদ সম্মেলনে এ বিষয়ে সমকালের পক্ষ থেকে প্রশ্ন করা হলে তিনি জানান, প্রথমেই পরিষ্কার হওয়া দরকার যে শুধু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এককভাবে ভিসাকেন্দ্র সরিয়ে নেওয়ার ঘটনা ঘটেনি। যুক্তরাজ্য সরকার কেন্দ্রীয়ভাবে ব্যয় সংকোচনের নীতি নিয়েছে। এ কারণেই আরও কয়েকটি দেশ থেকে ভিসাকেন্দ্র সরিয়ে একটি কেন্দ্রে নিয়ে আসা হয়েছে। তিনি বলেন, ভিসাকেন্দ্র সরানো হলেও সাধারণ আবেদনের ক্ষেত্রে ১৫ দিন এবং বিশেষ ক্ষেত্রে (প্রিমিয়াম) ৭ দিনের মধ্যে ভিসা প্রদানে যুক্তরাজ্য সরকারের নীতির কোনো পরিবর্তন হয়নি। যেহেতু কিছু কিছু ক্ষেত্রে অভিযোগ উঠছে সে কারণে আরও মসৃণভাবে এবং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ভিসার আবেদনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য ভিসা কেন্দ্রগুলোতে জনবল বাড়ানো হবে। সংবাদ সম্মেলনে ঢাকায় যুক্তরাজ্য হাইকমিশনার রবার্ট গিবসন উপস্থিত ছিলেন। সংবাদ সম্মেলন শেষে এ বিষয়ে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রে সময়মতোই ভিসা আবেদনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত আসছে। এখন পর্যন্ত জটিলতা কিংবা দীর্ঘসূত্রতার জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ পাওয়া যায়নি। সূত্র : সমকাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *