যখনই কোনো বিমান বিধ্বস্ত হয়, সাধারণ মানুষ ও গণমাধ্যমগুলোতে একটি শব্দ বার বার উঠে আসে। সেটি হলো ব্ল্যাক বক্স। বিমানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এ ডিভাইস নিয়ে লিখেছেন আনোয়ার হৃদয়
যন্ত্রটির নাম ব্ল্যাক বক্স হলেও এটি আসলে কমলা রঙের। যেকোনো যাত্রীবাহী বিমান বা করপোরেট জেটে একটি ককপিট ভয়েস রেকর্ডার এবং একটি ফ্লাইট ডাটা রেকর্ডার থাকা জরুরি। এ দুটি আলাদা রেকর্ডারকেই একত্রে ব্ল্যাক বক্স বলা হয়। এটি বিমানকে উড়তে বা উড়ন্ত অবস্থায় অন্য কোনো কাজ পরিচালনা করতে সহায়তা করে না; বরং বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার পূর্ব মুহূর্তে ঠিক কী ঘটেছিল তা জানতে এবং দুর্ঘটনার পর বিমানের অবস্থান নির্ণয়ে সহায়তা করে।
উদাহরণ
গত ২৮ ডিসেম্বর এয়ার এশিয়ার বিমান কিউজেড ৮৫০১ বিধ্বস্ত হওয়ার পর ১২ জানুয়ারি ব্ল্যাক বক্স বা ফ্লাইট ডাটা রেকর্ডারটির সন্ধান পাওয়া যায়। ডাটা বিশ্লেষণ করে তদন্তকারী দল জানতে পারে, বিমানটি আসলে পানির ওপর পড়ার পর বিস্ফোরিত হয়। পতনজনিত চাপের কারণে এই বিস্ফোরণ ঘটে। পরবর্তী সময়ে ককপিট অংশটি পাওয়া গেলে বিমান দুর্ঘটনার প্রকৃত কারণ উদ্ঘাটিত হয়। ডাটা রেকর্ডার থেকে ককপিট ভয়েস আলাদা করার সুযোগ আছে। বিশ্লেষণ করা যায় ফ্লাইট ডাটা রেকর্ডার থেকে প্রাপ্ত তথ্যও। রেকর্ডারের সঙ্গে একটি করে অবস্থান নির্ণয়ের যন্ত্র থাকে, যা ইউএলএস নামে পরিচিত। যন্ত্রটি মাত্রাতিরিক্ত চাপ, তাপ ও ওজন সহ্য করতে সক্ষম। সমুদ্রের ১৪ হাজার ফুট গভীরতায় থেকেও এটি বার্তা প্রেরণ করতে পারে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো ব্ল্যাক বক্স কমপক্ষে ২৫ ঘণ্টার ফ্লাইট ডাটা সংরক্ষণ করতে সক্ষম।
আবিষ্কার
১৯৫৭ সালে অস্ট্রেলিয়ান বিজ্ঞানী ড. ডেভিড ওয়ারেন ব্ল্যাক বক্স আবিষ্কার করেন। ১৯৫০ সালের দিকে যখন তিনি মেলবোর্নের বিমান চালনা গবেষণা কেন্দ্রে কাজ করছিলেন, তখন কমেট নামক একটি জেট পাওয়ার বিমানের দুর্ঘটনা ঘটে। ড. ওয়ারেন রহস্যজনক এ দুর্ঘটনা অনুসন্ধানের দায়িত্ব পান। তিনি ভাবেন, যদি বিমানটিতে একটি রেকর্ডার বসানো যেত তবে সেটি কী কারণে দুর্ঘটনার কবলে পড়েছিল তা সহজে বের করা যেত। এ ধারণা থেকেই সাত বছর গবেষণার পর আবিষ্কার করেন ব্ল্যাক বক্স। মূলত ১৯৫৭ সালে আবিষ্কৃত হলেও ব্ল্যাক বক্স কাজ শুরু করে ১৯৬০ সাল থেকে।
ককপিট ভয়েস রেকর্ডার
ককপিট ভয়েস রেকর্ডারের প্রধান কাজ হলো বিমানের মধ্যকার বিভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের শব্দ রেকর্ড করা। মূলত বিমানের ক্রু এবং ইঞ্জিনের শব্দ রেকর্ড করা ছাড়াও ইঞ্জিনের ঘূর্ণন ক্ষমতা, গতিবেগ, দিক পরিবর্তন, বাতাসের চাপ ইত্যাদি সংরক্ষণ করে। দুর্ঘটনার পর ককপিট ভয়েস রেকর্ডারের সাহায্যে তদন্তকারী দল গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করে।
ফ্লাইট ডাটা রেকর্ডার
ফ্লাইট ডাটা রেকর্ডার ককপিট ভয়েস রেকর্ডারের মতোই গুরুত্বপূর্ণ অংশ। গ্রাউন্ড কন্ট্রোল রুমের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করাই এর প্রধান কাজ। এ ছাড়া সময়, ভূমি থেকে বিমানের উচ্চতা, বিমানের গতিবেগ, ডানার ভারসাম্য, ভেতরকার তাপমাত্রা, অভিমুখী দিক, কমান্ডিং সাইন প্রভৃতি রেকর্ড করাও এর অন্যতম কাজ।
ভবিষ্যৎ ব্ল্যাক বক্স
দিনে দিনে ব্ল্যাক বক্সওে যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন প্রযুক্তি। সম্প্রতি ব্ল্যাক বক্সে থ্রিডি ভিশনার প্যাড যুক্ত করা হয়েছে। লো প্রেস্টি স্পিড মার্চেন্টস নামক কম্পানি ঘোষণা দিয়েছে, বিমানের প্রতিটি অংশ নিখুঁতভাবে পর্যবেক্ষণ ও রেকর্ড করতে সক্ষম-এমন ব্ল্যাক বক্স তারা তৈরি করবে এবং ২০১৮ সালের মধ্যে বাজারে ছাড়বে। এ ছাড়া অন্য একটি কম্পনি ব্ল্যাক বক্সে এমপি৩ সফটওয়্যার ব্যবহার করার পরিকল্পনা করছে, যেন বিমানের প্রতিটি কার্যক্রমের রেকর্ড একইসঙ্গে গ্রাউন্ড কন্ট্রোলে সংরক্ষিত হয়। ফলে ভবিষ্যতে বিমান দুর্ঘটনায় বিমানের সঠিক অবস্থান এবং সঠিক অনুসন্ধানের পথ আরো সুগম হবে।
সূত্র : কালেরকণ্ঠ