Skip to content

‘ভিনগ্রহের দ্বীপ’ সকোত্রা

অনেক অনেক আগে এটি আফ্রিকা মহাদেশের মূল ভূখণ্ডেরই অংশ সকোত্রা। প্রায় ৬০-৭০ লাখ বছর আগে দ্বীপটি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। মহাসাগরের বুকে একা এই দ্বীপ এখনো যেন সেই সময়কেই ধারণ করে আছে। আর তাই এর গাছগাছালি আর প্রাণীও পৃথিবীর অন্য সব জায়গার চেয়ে আলাদা। ঠিক যেন পৃথিবীর বুকে ভিনগ্রহের দ্বীপ। লিখেছেন নাবীল অনুসূর্য

দ্বীপটির অবস্থান ভারত মহাসাগরে। সোমালিয়া থেকে দূরত্ব ২৫০ কিলোমিটার, আর ইয়েমেন থেকে প্রায় ৩৫০। তবে দ্বীপটি আছে ইয়েমেনের অধিকারেই। একসময় এই সকোত্রা ছিল নাবিকদের মৃত্যুকূপ। দুরন্ত সাগরের ঢেউ আর ঝড়-জলের ভয় তো ছিলই। আরো বড় ভয় ছিল সকোত্রার অধিবাসীদের নিয়ে। সবার ধারণা ছিল, এই সকোত্রার জাদু-জানা মানুষজন সাগরের ঝড়-জল নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। জাহাজ ডুবিয়ে দেওয়া তো মামুলি ব্যাপার। এখন অবশ্য সকোত্রার মানুষদের সম্পর্কে তেমন ভাবনা আর নেই। বরং ইয়েমেনের গোত্রগুলো যেখানে প্রায়ই গণ্ডগোল বাঁধায়, ছেলেরা কোমরে ছুরি-আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ঘোরে, সে তুলনায় সকোত্রার লোকেরা অনেকটাই শান্ত, সুবোধ। সকোত্রার অধিবাসী ৪০ হাজার মানুষ প্রায় ৬০০টি গ্রামে থাকে। অধিকাংশ গ্রামই একটি মাত্র বড় পরিবার নিয়েই গঠিত। অথচ তাদের মধ্যেও কোনো গোল বাধে না। বিবাদ হলে, মুরব্বিদের নেতৃত্বে পাড়া-পড়শিদের নিয়ে তার সমাধান করা হয়।

বোতলগাছ

বোতলগাছ

সকোত্রার নিরীহ স্বভাবের মানুষগুলোর কারণে এখানকার প্রকৃতিও থাকতে পেরেছে প্রাচীনকালের মতোই। একমাত্র পাকা রাস্তাটি বানানো হয়েছে এই কয়েক বছর আগে। তাও ইয়েমেন সরকার এটি তৈরি করেছে মূলত পর্যটকদের জন্য। গত কয়েক দশকে এখানকার প্রকৃতি নিয়ে বেশ গবেষণা হয়েছে। দ্বীপে এমন অনেক গাছপালা-পশুপাখি পাওয়া গেছে, যা পৃৃথিবীর আর কোথাও দেখা যায় না। সব মিলিয়ে এই আবহাওয়া যেন ঠিক পৃথিবীর নয়। এসব গবেষণার ফলে দ্বীপটি যেমন ইউনেসকোর ওয়ার্ল্ড ন্যাচারাল হেরিটেজ সাইটের স্বীকৃতি পেয়েছে, তেমনি পর্যটকের আনাগোনাও শুরু হয়েছে। সম্প্রতি তা বেড়ে গেছে অনেক। এর ফলে দ্বীপটির প্রাচীনগন্ধী জল-হাওয়া বেশ বিপদেই পড়েছে।

সকোত্রার আবহাওয়া বেশ রুক্ষ, শুষ্ক আর গরম। গড় তাপমাত্রা ২৫ ডিগ্রি। বৃষ্টি বলতে গেলে হয়ই না। বালুময় সৈকত, পাথুরে সমভূমি, আর উঁচু উঁচু পাহাড়-এসব নিয়েই দ্বীপটি। এখানকার গাছপালা-পশুপাখি, সবই অন্য রকমের। দ্বীপের ৮২৫ প্রজাতির গাছপালা-পশুপাখির মধ্যে ৩০৭টির আবাস কেবল এই দ্বীপেই। এর কোনো কোনো প্রজাতি আবার টিকে আছে প্রায় দুই কোটি বছর ধরে।

সকোত্রার সবচেয়ে বিখ্যাত গাছটির নাম ড্রাগনস ব্লাড। গাছটি এমনকি ইয়েমেনের ২০ টাকার কয়েনেও খোদিত আছে। দেখতে ঠিক যেন উল্টে যাওয়া ছাতা। শাখা-প্রশাখা সব আকাশের দিকে বাড়ানো। এই গাছ থেকে বের হওয়া ঘন লাল আঠার কারণেই এর এই অদ্ভুত নামকরণ। শুধু ড্রাগন ব্লাডই নয়, এই দ্বীপের অধিকাংশ গাছের শাখা-প্রশাখাই এমন। দ্বীপটির দুটি ফুলগাছও খুব বিখ্যাত-ডেজার্ট রোজ ও মিশাহির। ডেজার্ট রোজের স্থানীয় নাম ফুচশিয়া। এই গাছটি আরব ও আফ্রিকার অন্য আরো কিছু দেশের মরু-অঞ্চলেও পাওয়া যায়। তবে এখানে গাছটি যত বড়, এমন আর কোথাও হয় না। গড়ন বোতলের মতো বলে বোতলগাছ বা ‘বটল ট্রি’ নামেও পরিচিত এটি। সকোত্রাতে একধরনের শসাগাছও হয়। এই গাছও ভীষণ অদ্ভুতুড়ে। ফুলে থাকা কাণ্ডটি মানুষের চেয়েও উঁচু।

সকোত্রার বালুময় সরু সৈকতটুকু বাদ দিলে প্রায় পুরোটাই পাথুরে। কাজেই গাছগুলোর অভিযোজনে দুটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ ছিল-পাথরের বুকে প্রোথিত হওয়া ও পানি ধরে রাখা। গাছগুলোর সবই তাই কম-বেশি বড়। আর ডেজার্ট রোজ, শসাগাছ-সব কটিরই কাণ্ডের ভেতর পানি জমিয়ে রাখার ব্যবস্থা আছে। আবার শুকনো দ্বীপটিতে বৃষ্টিও তেমন হয় না। তাই গাছগুলোর পানির মূল উৎস কুয়াশা আর বাতাসের আর্দ্রতা। পাহাড়ে যে গাছগুলো হয়, সেগুলো পানির চাহিদা মেটায় মূলত কুয়াশা থেকে। আর সমভূমির গাছগুলো বাতাসের আর্দ্রতা থেকে। তাই শাখা-প্রশাখাগুলো ঊর্ধ্বমুখী। তাতে বাতাস, কুয়াশা থেকে পানি সংগ্রহ করতে সুবিধা হয়।

তবে দ্বীপটির এই বৈচিত্র্যময় গাছগুলো বিপন্ন হয়ে উঠেছে। দ্বীপটির প্রায় সব গাছই বয়স্ক । মানে দ্বীপটিতে নতুন করে সেভাবে গাছ গজাচ্ছে না। পর্যটকদের আগমনে দ্বীপটির জীবনযাত্রায় প্রভাব তো পড়ছেই। তার সঙ্গে যেমন হয়েছে বৈশ্বিক আবহাওয়ার পরিবর্তন।

ড্রাগন ব্লাড

ড্রাগন ব্লাড

সকোত্রায় কেবল বিরল গাছপালাই পাওয়া যায়, তাই না। আছে বিরল প্রজাতির সব পশুপাখিও। দেখা মেলে এমন এমন কিছু প্রাণীরও, যারা কেবল সকোত্রাতেই বাস করে। দ্বীপটিতে প্রায় ১৪০ প্রজাতির পাখি আছে। এদের অন্তত ১০টি প্রজাতি কেবল সকোত্রাতেই বাস করে। যার মধ্যে আছে সকোত্রা স্টার্লিং, সকোত্রা চড়ুই, সানবার্ড, বান্টিং, সোনালি ডানার গ্রসবেক ইত্যাদি। তবে পাখিগুলো ইদানীং বেশ ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। বহির্বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ায়, বাইরের আরো অনেক কিছুর সঙ্গে দ্বীপটিতে বেশ কিছু বিড়ালেরও আমদানি হয়েছিল। এদের একটা অংশ বন্য বিড়ালে পরিণত হয়েছে। আর এগুলোর খাদ্যচাহিদা মেটাতেই বিপন্ন হয়ে পড়ছে পাখিগুলো।

আশ্চর্যজনকভাবে দ্বীপটিতে কোনো উভচর প্রাণী নেই। স্তন্যপায়ীও প্রায় নেই বললেই চলে। মানুষ বাদ দিলে, দ্বীপটির একমাত্র স্তন্যপায়ী বাঁদুড়। তবে প্রচুর সরীসৃপ আছে। সরীসৃপগুলোর ৯০ শতাংশকেই এই দ্বীপের বাইরে কোথাও পাবেন না। এদের মধ্যে আছে বিভিন্ন ধরনের স্কিঙ্ক (যেসব টিকটিকি-গোত্রীয় প্রাণীর কোনো একটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ছোট বা নেই), বিশেষ প্রজাতির গিরগিটি ইত্যাদি।

অবস্থানগত কারণেই, সকোত্রা প্রাচীনকালে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। দ্বীপটিকে ঘিরে নাবিকদের মধ্যে প্রচুর কিংবদন্তি প্রচলিত থাকলেও দিকনির্দেশনা পেতে দ্বীপটির গুরুত্বও ছিল অনেক। সে প্রয়োজন ফুরোলেও, এক দ্বীপে এমন জীববৈচিত্র্য পৃথিবীতে খুব বেশি দেখা যায় না। এই জীববৈচিত্র্যের কারণে প্রাচীনকালেও অনেকের নজর কেড়েছিল সকোত্রা। বিশেষ করে ড্রাগনস ব্ল্যাডগাছ গুরুত্বপূর্ণ ছিল সেই প্রাচীন মিসরীয়, গ্রিক আর রোমান সভ্যতাতেও। এমনকি দ্বীপটি মনোযোগ কেড়েছিল শেবার রানি ও আলেকজান্ডারের মতো সম্রাটদের, মার্কো পোলোর মতো পর্যটকের। আর বিজ্ঞানের এই যুগেও যে দ্বীপটি গবেষক-পর্যটকদের মনোযোগ কাড়বে, তাতে আর আশ্চর্যের কি! সূত্র : কালের কণ্ঠ

Advertisement

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *