
জাফলংয়ে জ্যোত্স্না সেনের সঙ্গে বাবর আলী
বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ প্রধান শিক্ষক ভারতের বাবর আলী। আগেও বাংলাদেশে এসেছিলেন, তবে দেখে মন ভরেনি। ৩১ মে এসে ঘুরে গেলেন পাঁচ দিন। নাদিম মজিদকে জানিয়েছেন তাঁর বাংলাদেশ অভিজ্ঞতা।
বাবর আলীর জন্ম ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ। তারও ভাষা বাংলা। পাঠ্যবইয়ে জানতে পারেন বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতও লিখেছেন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সেই থেকে প্রতিবেশী দেশটি নিয়ে আগ্রহ। আর দেশটি তার এলাকা থেকে সামান্য দূরে। আগ্রহ আরো গভীর হয় ভাষা নিয়ে বাংলাদেশিদের আত্মত্যাগের কথা জেনে।
দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়ার সময় রেডিও কিনেছিলেন বাবর আলী। চ্যানেল ঘোরাতে ঘোরাতে পেয়ে যান বাংলাদেশ বেতারের খুলনা অঞ্চলের প্রোগ্রাম। বুঝতে পারেন নিজের কথার সঙ্গে এ উচ্চারণের কত মিল! তারপর অপেক্ষায় থাকেন বাংলাদেশে আসার। অপেক্ষার প্রহর শেষ হয় গত বছর ১৩ জুন। তবে তিন দিন থেকে চলে যেতে হয়েছিল। এতে তার কৌতূহল মেটেনি, মনও ভরেনি। অনেক কিছুই যে দেখা হলো না! তাই এ বছর আবার আসেন। বেড়িয়েছেন আহসান মঞ্জিল, লালবাগ কেল্লা, শহীদমিনার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, নজরুলের সমাধি, সিলেটের জাফলং, লালাখাল, মৌলভীবাজার। সঙ্গে ছিলেন বাবর আলীর আনন্দ শিক্ষানিকেতনের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি জ্যোত্স্না সেন এবং পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার বিধায়ক ফিরোজা বেগম।
মানুষের আতিথেয়তায় মুগ্ধ বাবর আলী, ‘যেখানে গিয়েছি, সবাই সাদরে গ্রহণ করেছে। ফেসবুক বন্ধু মৌলভীবাজারের আশরাফ আহমেদের বাড়িতে ছিলাম একরাত। ঢাকা ও সিলেটের রামকৃষ্ণ মিশনে ছিলাম। সবাই আপন করে নিয়েছিল। আমি তাদের পরিবারের কেউ না। অথচ আদর-আপ্যায়নের ত্রুটি করেনি।’
বাবর আলীর ভালো লেগেছে বাংলাদেশের গ্রাম-বাংলার প্রকৃতি। মনে হয়েছে জীবনানন্দ দাশের কবিতার মতো। বাসে এবং ট্রেনে করেই ঘুরেছেন। বলেন, ‘বাংলাদেশে পথের ধারে অনেক গাছ দেখেছি। এটি যেকোনো দেশের জন্য অনুকরণীয় হতে পারে।’
আবার একটি বিষয় তার খারাপও লেগেছে। ট্রেনে ঢাকা থেকে সিলেটে যাওয়ার পথে এক স্টেশনে হকার ‘ম্যাঙ্গো বার’, ‘ম্যাঙ্গো বার’ বলে চেঁচিয়ে চকোলেট বিক্রি করছিল। বাংলাভাষার জন্য রক্ত দেওয়া এ দেশে এভাবে ইংরেজির চল ভালো লাগেনি তার।
আনন্দ শিক্ষানিকেতন
বাবর আলীর গ্রাম ভারতে। গ্রামের আশপাশে কোনো বিদ্যালয় নেই। ৯ বছর বয়সে সেখানে স্কুল গড়ার উদ্যোগ নেন বাবর আলী। নিজের বাড়ির পেছনে স্কুল চালু করেন। নাম আনন্দ শিক্ষানিকেতন। নিজে দূর-গাঁয়ের এক স্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়তেন। নিজের স্কুলে প্রথম দিকে শিশুশ্রেণি থেকে দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়াতেন। দরিদ্র এলাকা হওয়ায় কোনো ফি রাখেননি। শুরুতে উদ্দেশ্য ছিল গ্রামের সব মানুষ যেন সাক্ষরতা অর্জন করতে পারে। স্কুলটিতে এখন দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানো হয়। ৩০০ ছাত্রছাত্রী এবং ১০ জন স্বেচ্ছাসেবী শিক্ষক রয়েছে। শিক্ষকের ছয়জনই এখানকার সাবেক ছাত্র। আশপাশে এখনো সরকারি বা বেসরকারি কোনো স্কুল হয়নি। ৪ কিলোমিটার দূর থেকে ছেলেমেয়েরা এখানে পড়তে আসে।
স্কুলই পরিচয় করাল জ্যোত্স্না সেনের সঙ্গে
জ্যোত্স্না সেন অন্নদামণি বালিকা বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক। পাশাপাশি রাজনীতিও করেন। জেলা পরিষদের নির্বাচিত সদস্য ছিলেন। ২০০৫ সালে একদিন জেলা প্রশাসকের সঙ্গে কথা বলছিলেন। তখন একটি বাচ্চা ছেলে নিজের এলাকার বিদ্যালয়কে বাঁচানোর জন্য কী করা যায়, আলাপ করতে এসেছিলেন। বাচ্চা ছেলে ২০০২ সাল থেকে স্কুল পরিচালনা করছে শুনে অবাক হয়েছিলেন তিনি। তারপর থেকে স্কুল পরিচালনায় সাহায্য করে আসছেন। এখন স্কুল কমিটির সভাপতি। তিনি জানান, ‘বাবর আলীর কাজ অনেক বড়। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়া এক ছাত্র স্কুল দেওয়ার সাহস করেছিল। নিজে দূরের স্কুলে পড়াশোনা করা, সেই সঙ্গে নিজের স্কুলের ছাত্রদের পড়িয়ে আসা—একটা বড় ব্যাপার। দুস্থ পরিবার, কাগজ কুড়ানো, প্লাস্টিক কুড়ানো বাচ্চাগুলো তার স্কুল থেকে পড়ে শিক্ষিত হচ্ছে।’
২০০৯ সালে ‘হাঙ্গার টু লার্ন’ নামে একটি সিরিজ প্রচার করে বিবিসি। তখন বাবর আলীর বয়স ১৬। সে সিরিজে তাঁকে ‘বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ প্রধান শিক্ষক’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। একই বছর ‘ইনডিয়ান অব দ্য ইয়ার’ হিসেবে স্বীকৃতি পান চ্যানেল এনডিটিভি থেকে। এ বছরের ফোর্বস ম্যাগাজিনের ‘এশিয়ার ৩০ তরুণ অনুপ্রেরণীয় উদ্যোক্তা’র মধ্যে রয়েছে তাঁর নাম। সিবিএসই টেনথ স্ট্যান্ডার্ড ইংলিশ টেক্সটবুক, কর্নাটক রাজ্যের সরকারি পিইউসি ইংলিশ টেক্সটবুক এবং লুক্সেমবার্গের কয়েকটি স্কুল পাঠ্যে অনুপ্রেরণাদায়ী ব্যক্তি হিসেবে রয়েছে তাঁর জীবনের গল্প। তবে নিজের পড়াশোনার পাট এখনো শেষ হয়নি। এখন কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর পড়ছেন বাবর আলী। সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ