ঈদ মানেই আনন্দ। ঈদ মানেই খুশি। আর এই ঈদানন্দ এখন সবার। আমাদের দেশে ঈদ মানেই ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সব শ্রেণির মানুষের মিলনমেলা। যেখানে কেবল দেশের মানুষই নয়, রয়েছে দেশের বাইরের মানুষও। পৃথিবী এখন অনেক ছোট। মানুষের কৃষ্টি-সংস্কৃতি, ধ্যান-ধারণা এখন বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত। খুব সহজেই পৌঁছে যাচ্ছে দেশ থেকে দেশান্তরে। কেউবা পড়াশোনা করছেন আবার কেউবা চাকরি, আবার কেউবা করছেন ব্যবসা। অনেকেই আবার নিজেদের স্থায়ী বাঙালি করে নিয়েছেন। বাংলাদেশকে করেছেন নিজের আপন ঘর। এমন কিছু ভিনদেশি মানুষের ঈদ ভাবনা নিয়ে এই আয়োজন। বিভিন্ন দেশ থেকে আগত বিদেশিদের সঙ্গে কথা বলে তাদের ভাবনা তুলে ধরেছেন— সাদিয়া ইসলাম বৃষ্টি
বাংলাদেশ আমার কাছে নিজের বাড়ির মতো : জেনিফার ফারেল, আমেরিকা
আমেরিকায় খুব একটা কাছ থেকে ঈদ বা রমজান মাসকে অনুভব করিনি কখনো। কিছু মুসলিম বন্ধু ছিল আমার স্কুল আর ভার্সিটিতে। তবে অতটা কাছের ছিলাম না তাদের। তাই ঈদ ব্যাপারটা বুঝিনি ভালো করে। তবে বাংলাদেশে আসার পর থেকে অবশ্য সেই অনুভূতি পাল্টেছে। ২০১২ সালে বাংলাদেশকে প্রথম দেখি আমি। তবে সেটা কিছুদিনের জন্য। ২০১৩ সালের অক্টোবরে আমি ফুলব্রাইট স্কলারশিপ পাই। বাংলাদেশে। আর তারপর… অনেকটা দিন হয়ে গেল এখানকার মানুষের সঙ্গে। প্রায় ২ বছর! বাংলাদেশের মানুষ প্রথম থেকেই আপন করে নিয়েছিল আমাকে। আমার বন্ধুরা তাদের পরিবারের অংশ করে নিয়েছিল। তাদের প্রত্যেকটা উৎসবেই আমার উপস্থিতি চাইত তারা। ইউএসএর নিজের পরিবারকে খুব মিস করতাম। কিন্তু সেটার অভাব অনেকটাই কেটে গিয়েছিল আমার এখানকার বন্ধু আর সহকর্মীদের পেয়ে। তাদের সঙ্গে এ দেশের প্রতিটি উৎসবকে নিজের করে অনুভব করেছি আমি। উপভোগ করেছি। মোট দুইবার ঈদ করেছি আমি এ দেশে। প্রতিবারই খুব চমত্কার অনুভূতি হয়েছে। বন্ধুদের সঙ্গে সাহরি করেছি, ইফতার করেছি। রোজা না রাখলেও অপেক্ষা করে থেকেছি ঈদের জন্য। ঈদের দাওয়াতে শাড়ি পরে বেড়াতে গিয়েছি সবার বাসায়। নাচ, গান, হাসি, আনন্দে খুব ভালো কেটেছে সময়টা। সবচাইতে ভালো লেগেছে ঈদের আগের দিন। সেদিন রাতে আমরা অনেক বন্ধু মিলে পুরান ঢাকায় ঘুরে বেড়িয়েছি। আমার অনেক বন্ধু তাদের গ্রামের বাড়িতে দাওয়াত দিয়েছিল আমাকে। তাদের ডাকেও সাড়া দিয়েছি। ফলে বাংলাদেশ এখন আমার কাছে একদম নিজের বাড়ির মতো হয়ে গেছে।
হাত ভরেমেহেদি লাগিয়েছিলাম : ওকসানা কুঝিলনা, ইউক্রেন
২০১৫ সালের পুরো একটা মাস বাংলাদেশে কাটিয়েছিলাম আমি। আর তখনই বাংলাদেশের ঈদকে প্রথম দেখি খুব কাছ থেকে। সে সময় বাংলাদেশের মানুষ আর এখানকার উৎসবের মাধ্যমে যতটা আনন্দিত আর আপ্যায়িত হয়েছি, আমি সেটা ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। বিশেষ করে ঈদের সময়টায় খুলনায় ছিলাম আমি। সেখানে চারপাশে একটা অন্যরকম ঈদ ঈদ আমেজ ছড়িয়েছিল। আমি পুরো ব্যাপারটা নিয়ে প্রচণ্ড উৎসাহিত ছিলাম। ঈদের আগের দিন হাত ভরে মেহেদি লাগিয়েছিলাম আমি। এমনকি পরদিন রান্না-বান্নায়ও হাত লাগিয়েছিলাম। আমার জীবনের সবচাইতে সেরা ভাতের স্বাদ আমি পাই বাংলাদেশের সেই ঈদে। শুধু ভাতই নয়, আরও অনেক বাংলাদেশি খাবারের স্বাদ নিয়েছিলাম আমি। কিছুদিন আগেও এক বন্ধুকে আমি বলছিলাম, গরুর মাংস, খিচুড়ি, কালা গোশত, পোলাউ আর ফালুদার মতো খাবারগুলো খাওয়ার আগে জীবনে আসলে আমি কী খেয়েছিলাম? বাংলাদেশি খাবারকে একরকম ভালোবাসি আমি বলতে গেলে। বিশেষ করে মায়ের হাতের ফিরনি আর ফখরুদ্দিনের বিরিয়ানি তো অসাধারণ ছিল। ঢাকা-খুলনাসহ বাংলাদেশের কিছু গ্রাম ঘুরে দেখেছি আমি। সেখানে দারিদ্র্য ছিল। অসম্ভব সুন্দর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নষ্ট করার মতো ব্যাপার ছিল। তবে আমি মনে করি, আগামী প্রজন্ম নিশ্চয়ই ভালো কিছু করবে। কারণ এখানে যার সঙ্গেই আমার দেখা হয়েছে, তারা খুব সহজে আপন করে নিয়েছে আমাকে। ভালোবেসেছে, কথা বলেছে, সাহায্য করেছে। এ ছাড়াও ঈদের সময় এখানকার মানুষ একে অন্যকে সাহায্য করার ব্যাপারটাও খুব ভালো লেগেছে আমার। ঈদে বাংলাদেশের সবাই খুব পরিপাটিভাবে নিজেকে তৈরি করে। তাদের সবাইকেই সুন্দর দেখায়। বিশেষ করে মেয়েদের একটু বেশিই ভালো লাগে দেখতে।
বাংলাদেশের ঈদটা আসলেই অন্যরকম আর জমকালো হয় : সাফিয়া নূর (কলকাতা)
কলকাতার ঈদ তুলনামূলকভাবে একদমই কম উৎসবের। বাংলাদেশে কাটানো ঈদগুলোর ভেতরে ২০০১ সালের ঈদ সবচাইতে ভালো লেগেছে। কলকাতার ঈদ অনেকটাই লবণ ছাড়া তরকারির মতো। ওখানে থাকতে ঈদটা যে, কোনো উৎসব সেটাই বুঝতে পারিনি কোনো দিন। ঈদ যে আসলেই স্পেশাল সেটা বাংলাদেশে এলেই ভালোভাবে বোঝা যায়। বিশেষ করে বাংলাদেশের এত মজার বাঙালি খাবার আমি আগে কোথাও খাইনি। তবে বাংলাদেশের সেমাইটা খুব বেশি ভালো লাগেনি আমার। বাড়িতে হাতে বানানো সেমাইটাই সবচাইতে ভালো লাগে আমার। দাদিরা কল দিয়ে সেমাই তৈরি করে আর সেটা রোদে শুকিয়ে সেমাই রান্না করা হয়। খুব ইয়ামি হয় সেটা।
কলকাতা আর বাংলাদেশের ঈদের ভেতরে আরেকটু পার্থক্যও রয়েছে। কলকাতায় হয়তো এ দিনটায় অনেক অনেক খাবার খাওয়াবে না কোনো বাড়িতে। তবে যেটুকু করে সেটা খুব আন্তরিকতার সঙ্গে করে। বাংলাদেশে বিষয়টা অনেকটাই রীতির ভেতরে পড়ে যায়। আন্তরিকতার ঘাটতি দেখা যায় কোথাও কোথাও। তবু সব মিলিয়ে ঈদের মজাটা বাংলাদেশেই বেশি অনুভব করেছি আমি।
আমার একটা পাঞ্জাবি আছে : নরম্যান আজেলমেইয়ার, ইউক্রেন
কর্মসূত্রে বাংলাদেশে আসা হয়েছিল। দুমাসের মতো ছিলাম। এর ভেতরই খুব ভালো লেগে গিয়েছিল বাংলাদেশকে। খুব বেশি সময় ছিলাম না যদিও, ২০১২ সালের ঈদটা বাংলাদেশেই কাটানো হয়েছিল আমার। ভাষা শিক্ষক হিসেবে গিয়েছিলাম বাংলাদেশে। তাই সেখানকার শিক্ষার্থীদের সঙ্গে চমত্কার একটা দিন কেটেছিল। একদম নতুন আর চমত্কার একটা অভিজ্ঞতা হয়েছিল আমার। বিশেষ করে উৎসবটির সামাজিক দিক আমাকে মুগ্ধ করেছিল। একে অন্যকে খাবার খাওয়ানো— পুরো ব্যাপারটাই খুব চমত্কার মনে হয়েছিল। আমি আমার এক বাংলাদেশি বন্ধুর বাড়িতে গিয়েছিলাম সেদিন। অসম্ভব ভালো কিছু খাবারের স্বাদ নিয়েছিলাম। বিশেষ করে মিষ্টি কিছু খাবার খেতে দেওয়া হয়েছিল আমাকে। সেমাই আর ফিরনি নামের খাবারগুলো অসাধারণ মনে হয়েছিল। কেবল মিষ্টি খাবারই নয়, রুই মাছ, ইলিশ মাছসহ আরও কিছু খাবারও চেখে দেখেছিলাম। সবকিছু খুব সাজানো-গোছানো আর পরিপাটি ছিল। আমার একটা পাঞ্জাবি আছে। সেটাও পরেছিলাম আমি ঈদের দিনে।
আমেরিকার চাইতে বেশি উৎসব আনন্দ : ডেবরা এফ্রোইমসন, আমেরিকা
অনেকদিন হলো এ দেশে এসেছি আমি। নিজের দেশ যতটা না আমার আপন, ঠিক ততটাই আপন বাংলাদেশ, বাংলাদেশের সংস্কৃতি আর আর এখানকার মানুষগুলো। আর এ দেশের উৎসব? সেটার কথা তো না বললেই নয়। আমেরিকার চাইতে অনেক বেশি অন্যরকম আর প্রাণোচ্ছল এক উৎসবমুখর পরিবেশ রয়েছে বাংলাদেশে। এদেশে উৎসবের কোনো নির্দিষ্ট কারণ লাগে না। সবসময়ই অন্যদের আপ্যায়িত করার জন্য যেন তৈরিই থাকে বাংলাদেশের অতিথিপরায়ণ মানুষগুলো। বিশেষ করে বিদেশিদের প্রতি তাদের অনেক বেশি আগ্রহ থাকে। ওরা এত বেশি আতিথেয়তাপূর্ণ যে মাঝে মাঝেই আমি কৌতুক করে বলি— বাংলাদেশের আতিথেয়তা মার্শাল আর্টের মতো! বাংলাদেশের সব ধরনের উৎসবকে পছন্দ করি আমি। খুব ভালো লাগে আমার বাংলাদেশের ঈদকে। ঈদের দিন সবাই নতুন জামা পরে বাইরে বড়াতে যায়। সাজানো রিকশায় ঘুরতে বের হয়। ঈদে মানুষের সঙ্গে দেখা করা আর নানারকম খাবার খাওয়া খুব উপভোগ করি আমি। ঈদের দিনে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরতে পছন্দ করি আমি। ঈদের দিনে সেমাই জিনিসটা না খেলেই নয়।
ঈদে ঈদি পাই : বাসিত, পাকিস্তান
গত বছর ঈদে ঢাকায় এসেছিলাম আমি। অনেক আগে থেকেই বাংলাদেশে আসার ইচ্ছে ছিল। গতবার জার্মানিতে যাওয়ার পর সেখানে আমার খুব ভালো এক বাংলাদেশি বন্ধুর সঙ্গে পরিচয় হয়। তার আমন্ত্রণেই যাওয়া হয় বাংলাদেশের ঈদে। ঈদের দিন সকালে প্রথমে সেমাই আর নুডলস খেয়ে মসজিদে যাই। এরপর আমার সহপাঠীর পরিচিতজনের ভেতরে কয়েকটি বাসায় যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল আমাদের। এরপর দুপুর বেলায় আন্টির হাতের চমত্কার সব রান্না খেয়ে আবার বাইরে বেরিয়েছিলাম আমি আর আমার বন্ধু। আরও অনেক বাংলাদেশি বন্ধুর সঙ্গে পরিচিত করিয়ে দেওয়া হয়েছিল আমাকে। তাদের সবাই আমার সঙ্গে যথেষ্ট আন্তরিক ব্যবহার করেছে। সবাই খুব সাহায্যও করেছে আমাকে। তবে এর আগে বাংলাদেশকে নিয়ে একটা অদ্ভুত আকর্ষণ আর ভীতি মনের ভেতরে কাজ করলেও দেশটাকে ঠিক আমার নিজের দেশের মতোই আপন মনে হয়েছে। আর হ্যাঁ, ভালো কথা, ঈদে আমি মোট ৫০০ টাকা ঈদিও পেয়েছিলাম। সৌজন্যে: বাংলাদেশ প্রতিদিন