তারেক অণু
আগ্নেয়গিরিতে চড়ার চিন্তা করেছি অনেকবার। বিশ্বের উচ্চতম মৃত আগ্নেয়গিরি কিলিমাঞ্জারোয় চড়ার পরিকল্পনা প্রতি সামারেই করি, কিন্তু নানা কারণে পিছিয়ে যায়। ফুজিয়ামা চড়ার সব বন্দোবস্ত পাকা থাকার পরও টোকিও যাওয়া হচ্ছে না, আর দাঁড়ানোও হচ্ছে না ফুজিয়ামার তুষার আবৃত শৃঙ্গে। আমাদের সৌরজগতের সর্বোচ্চ পর্বতটিাও কিন্তু একটি আগ্নেয়গিরিই। সেটি মঙ্গল গ্রহে। নাম অলিম্পস মন্স মাউন্ট। এভারেস্টের তিন গুণ উঁচু।
যা-ই হোক, শরতের এক সকালে পৌঁছালাম নেপলস। শহর বেড়ানোর সময় মনে হলো দিগন্তজুড়ে দাঁড়িয়ে থাকা ভয়াল ভয়ংকর সুন্দর সুপ্ত আগ্নেয়গিরি মানে ভিসুভিয়াসে আরোহণের চেষ্টা করলে কেমন হয়? কেমন লাগবে সেই জ্বালামুখের কিনারে দাঁড়িয়ে কন্দরের টগবগে লাভা দেখতে? দুই হাজার বছর আগে খেপে উঠে আগ্নেয়গিরিটি ঢেকে দিয়েছিল পম্পেইসহ আরো পাঁচটি শহর। পম্পেই তখন ছিল এক সমৃদ্ধ নগরী। পরেও কয়েকবার অগ্নি উদগিরণ করেছে ভিসুভিয়াস কিন্তু মানুষ সতর্ক থেকেছে। আবার গড়ে উঠেছে পম্পেই।
যাব মনস্থ করে কদিন জোর হাঁটাচলা করলাম। ফিটনেস বাড়িয়ে নিলাম আর কি! সকালে সেদ্ধ ডিমের সঙ্গে শসা খেয়ে একটা ঘরের ভেতর গন্ধকের গন্ধে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করলাম।
৯ অক্টোবর সকালেই নেপলস থেকে ট্রেনে যাত্রা শুরু হলো প্রাচীন শহর এরকোলানোর উদ্দেশে, সেখানে রেলস্টেশন থেকেই ভিসুভিয়াসের দোরগোড়ায় যাওয়ার বাহন পাওয়ার কথা। স্টেশনে কয়েকটা বন্ধু জুটে গেল। মাইক্রোবাস ধরনের বাহনে চেপে রওনা দিলাম ভিসুভিয়াস ন্যাশনাল পার্কে। শহর ছাড়ার পর থেকেই সাদা মেঘের ভেলাদের নোঙর ফেলার বন্দর ভিসুভিয়াসের চূড়া দেখা গেল। বছরের এই সময়টা নাকি মেঘময়ই থাকে, তবে আজ অবস্থা কিছুটা ভালো। সূর্যের উপস্থিতি বোঝা যাচ্ছে থেকে থেকেই, এখন আশা যেন শিখরে পৌঁছানোর পরে মেঘের ভেলাদের অনুভব না করতে হয়!
১২৮১ মিটার (৪,২০৩ ফুট) উচ্চতার আগ্নেয়গিরি ঘিরেই গড়ে উঠেছে ১৩৫ বর্গকিলোমিটারের ভিসুভিয়াস ন্যাশনাল পার্ক। দূর থেকে চূড়ার কাছের লালচে ঢাল নজরে এলো। তবে তার খানিক নিচ থেকেই শুরু হয়েছে ঘন সবুজের জঙ্গল। সেই বন চিড়ে ঘুরে ঘুরে ওপরের দিকে চলে গেছে পিচঢালা রাস্তা, লালচে মাটি। কেমন যেন সুরকি মেশানো মনে হলো। কয়েক জায়গায় কালো পাথরের বিশাল বিশাল স্তূপ, হাজার বছর আগের লেলিহান লাভা এখান পর্যন্ত এসে জীবনীশক্তি হারিয়েছে।
এক জায়গায় গাড়ি থামিয়ে গাইড দেখালেন সবুজ বন দলে চলে যাওয়া পাথর নদীকে, ভিসুভিয়াসের শেষ লাভা উদগিরণ ঘটেছিল ১৯৪৪ সালে। তখন নাকি এ পর্যন্ত এসেই তার সব তর্জন-গর্জন ফুরিয়ে গিয়েছিল, ধিকিধিকি আগুন জ্বলা তপ্ত লাভা পরিণত হয়েছিল কঠিন শিলায়। এখনো সব সময় ব্যাপক নজরদারি করা হয় ভিসুভিয়াসের ওপর। বলা তো যায় না-পাগলি যদি আবার খেপে?
পথের বাঁকে পাহাড় আর বনের ফাঁকে দূরের নেপলস শহর দেখা গেল, সঙ্গে সুনীল ভূমধ্যসাগর, এমনিই কি আর নেপলসের রূপ নিয়ে বলা হয়, নেপলস দেখার আগে মারা যেয়ো না! গাড়ি আমাদের নিয়ে গেল লালচে ঢালের গায়ে কিছুটা ছড়ানো মতো জায়গায়। গাইড তাঁর যানসহ এখানে অপেক্ষা করবেন দেড় ঘণ্টা, এর মধ্যেই আমাদের জ্বালামুখ ছুঁয়ে ফিরে আসতে হবে। পাশেই টিকিটঘর, সাত না আট ইউরোর জানি টিকিট। এর পর পরই মূল ফটক পেরিয়ে লাল মাটির রাস্তা চলে গেছে ঢাল বেয়ে ওপরের দিকে, প্রথমেই দেখি লাঠি ভাড়া করার সুব্যবস্থা আছে! কেনাও যেতে পারে!
অবশ্য লাঠিয়ালরা তাঁদের দিকে ভ্রুক্ষেপ না করাকে মোটেও সুনজরে দেখল না, ভাবখানা এমন-যাও না এমন গটগটিয়ে, দেখব কতক্ষণ পারো এক দমে! কিন্তু ওদের কী করে বোঝাই যে মামুর বুটা! এই ১২০০ মিটারের পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উঠতে যদি লাঠি ব্যবহার করি, তাহলে বেটা কিসের।
বেশ ছড়ানো পথ, রেলিং দেওয়া আছে, এঁকেবেঁকে উঠে গেছে শিখর পর্যন্ত। ঢালের দিকে নজর গেলেই লাল মাটি, লাল পাথর, লাল কাকরের রাজত্ব, কিন্তু সব কিছু ছাড়িয়েই চোখে আরাম বুলিয়ে যাচ্ছে কঠিন পাথর ভেদ করে ফোটা ফুলের গুচ্ছ বা গাছের দল। আসলেই খানিকটা সময় পেলে প্রকৃতি কী চমৎকারভাবেই না প্রায় সব আঘাত সামলে নেয়।
দূরের নেপলস যেন লুকোচুরি খেলতে লাগল সাদা মেঘের ফাঁকে ফাঁকে। এদিকে আমাদের ছোঁয়ার প্রতিযোগিতা লাগিয়েছে যেন কালো কালো মেঘের দলেরা, কিন্তু সুখের কথা-এখন পর্যন্ত তাদের বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না, দিলেই কেলেঙ্কারির! জোর কদমে চলে চূড়ার কাছাকাছি পৌঁছে অবশেষে মনে হলো ধোঁয়ার দেখা পেলাম, কিন্তু হা-হতোস্মি! এত মেঘ! ফিনফিনে ঢাকাই মসলিনের মতো মেঘেরা পাকখেয়ে ঘুরছে যেন আগ্নেয়গিরির চারপাশে। অবশ্য পরের কয়েক দিনেও ভিসুভিয়াসের দেখা কোনো সময়ই সম্পূর্ণ মেঘমুক্ত অবস্থায় মেলেনি। হতে পারে শরতে এমনটাই হয়, যে কারণে এত ওপরে উঠেও ঝকঝকে নীল ভূমধ্যসাগরের দর্শন মিলল না মেঘদূতদের কারণেই।
কিন্তু ভিসুভিয়াসের কুখ্যাত জ্বালামুখ তখন আমাদের সামনে, কেবল একটি রেলিংয়ের ব্যবধান! এর পরেই ঢাল নেমে গেছে নানা ধরনের শিলাস্তর নিয়ে কেন্দ্র পর্যন্ত। অবাক হয়ে লক্ষ করলাম জ্বালামুখের কন্দরেও সবুজের ছোঁয়া, বিশেষ করে একেবারে কেন্দ্রবিন্দুতেই বেশ কিছু গাছ চির উন্নত মমশির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সগর্বে! অবশ্য অনেক মৃত আগ্নেয়গিরিরই জ্বালামুখে জল জমে সেটি নয়নাভিরাম হ্রদে পরিণত হয়, যাদের বলা হয় আগ্নেয় হ্রদ। কিন্তু এমন পর্যায়ে যেতে বোধকরি ভিসুভিয়াসের দেরি আছে।
দ্রুত ফটোসেশন চলল। ছবি তোলার সময়ই প্রথমবারের মতো নিচের এক প্রান্তে ধোঁয়া চোখে পড়ল! সত্যিকারের আগ্নেয়গিরির ধোঁয়া! সেখানে ভূমির তাপমাত্রা ১০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের বেশি! মাটি মনে হয় ফুটছে টগবগ করে, কতটা উত্তপ্ত হলে শিলা থেকে ধোঁয়া বেরোতে পারে! উৎক্ষিপ্ত লাভা নয়, আগুনের ফুলকি নয়, সোনারঙা নিভু নিভু পাথর নয়, সেই অল্প ধোঁয়ার উৎসেই যে কি রোমাঞ্চের সৃষ্টি করল মনে, তা পুরোপুরিই অলেখ্য। শুধু মনে হলো, এবার যদি বাবা ভিসুভিয়াস একবার ফুঁসে ওঠে আপন মর্জিমতো, ব্যস! অমরত্ব ঠেকায় কোন দেবতা!
গত দুই হাজার বছরে মোটমাট ৭৯ বার অগ্ন্যুৎপাত ঘটেছে ভিসুভিয়াসে। কিন্তু কোনোটাই ৭৯ খ্রিস্টাব্দের মতো বিশাল ছিল না এবং বাকি কোনোটাই ওটার মতো মানবসমাজের ক্ষতিসাধনও করেনি। ইউরোপের নানা দেশে তো বটেই, এমনকি এখানের ধোঁয়া ১২০০ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে ইউরোপ-এশিয়ার মিলনস্থলের ইস্তাম্বুলের আকাশ পর্যন্ত দখল করে নিয়েছে মাঝেমধ্যে!
তবে ভূতাত্ত্বিকদের গবেষণায় জানা গেছে, আল্পস পর্বতমালার জন্ম যে কারণে হয়েছে, ভূপৃষ্ঠে ভিসুভিয়াসের উদ্ভবও সেই একই কারণে-আফ্রিকা মহাদেশীয় প্লেটের সঙ্গে ইউরেশীয় মহাদেশের প্লেটের সংঘর্ষ। তাপ-চাপের কারণে উদ্ভূত চিত্র-বিচিত্র শিলার দেখা মিলল জ্বালামুখের চারপাশে। যে এলাকায় সবচেয়ে বেশি ধোঁয়ার দেখা মিলল, মনে হলো সুযোগ পেলেই চট করে বারবিকিউ সেরে ফেলতে পারব ১ মিনিটে। সেখানেই দেখি খুদে পাখির দল নির্ভয়ে নীড় পেতেছে, যদিও বংশ-কুল-জাত ঠাহর করার আগেই তারা পুচ্ছ ঝাঁকিয়ে হারিয়ে গেল গহ্বরের নিচের দিকে।
আর পাওয়া যাচ্ছিল গন্ধকের কটু গন্ধ, একেবারে রসায়নল্যাবে পাওয়া পচা ডিমের গন্ধের জমজ ভাই। কেমন অদ্ভুত ধরনের এক বিশাল গহ্বর, মনে হলো এর নিজস্ব কোনো সত্তা আছে। ক্রুর, ভয়ংকর, নিষ্ঠুর সেই অন্ধ জ্বালামুখ বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর দানবের মতোই যেন অপেক্ষা করছে অবশ্যম্ভাবী কোনো পরিণতির!
জ্বালামুখের এক কিনারে নানা স্মারকচিহ্ন কেনার দোকান, সেখানে রৌদ্রকরোজ্জ্বল আগ্নেয়গিরিটির ভিউকার্ড যেমন ছিল, তেমনি ছিল নানা ধরনের, নানা বর্ণের পাথর! প্রবল তাপে ও চাপে কী করে এক মৌল অন্য মৌলতে রূপান্তরিত হয় তার যেন একটা প্রদর্শনী হয়ে গেল ছোট টেবিলেই!
এর পর পরই নিচে নামার রাস্তা। কিন্তু জানা গেল সেটি নেমে গেছে পর্বতের অন্য প্রান্তে, আমাদের যানের কাছে নয়। সেখানে যেতে হলে যে রাস্তা দিয়ে এসেছি সেখান দিয়েই ফিরতে হবে। একটু ঝুঁকি নিয়ে অবশ্য জ্বালামুখটির ভেতর দিয়ে গেলে শর্টকাট হতেও পারে, কিন্তু রেলিং টপকালেই হয়তো হা রে রে রে রে রে করে তেড়ে আসবে ইতালীয় প্রহরীর দল। এমনিতেই একবার একটু ভেতরে ঢুকে ধোঁয়ার ছবি তুলতে গিয়ে বিপদে পড়তে যাচ্ছিলাম, তাই মানে মানে চললাম নিচের পথে। মনের ভেতরে কলতান-বেঁচে আছি, বেঁচে আছি! সূত্র : কারের কণ্ঠ