বুয়েটে পড়তেন জুবায়ের হোসেন। উচ্চতর শিক্ষার জন্য এখন আছেন কানাডার অন্টারিওতে। আগস্ট মাসে ফল সেমিস্টারের গোড়ায় গিয়েছিলেন ভুট্টাক্ষেতে হাঁস খুঁজতে।
বিভিন্ন দেশ থেকে আসা বন্ধুদের ছোট একটি দল আছে আমাদের। এই দলের মজা হলো, প্রতি সপ্তাহে কেউ কিছু একটা করার প্রস্তাব করে। আর সেই ডাকে সাড়া দিয়ে আট-দশজন সহজেই জুটে যায়। পুরো গ্রীষ্মে এদের নিয়ে শহর চষে বেড়িয়েছি। মিউজিয়াম নাইটে জাদুঘর দেখা, বাস্কেটবল আর বোলিং খেলা কিংবা ছুটির দিনে লেক অন্টারিওতে ডুব দেওয়া-সব কাজে দলটির প্রবল উৎসাহ। ঠিক হলো, সামনের উইকএন্ডে আমরা উলফ আইল্যান্ডে কর্ন মেজে যাব।
কানাডার অন্টারিও প্রদেশের কিংস্টন শহরে আমার ছাত্রজীবন শুরু হয়েছে আগের গ্রীষ্মে। কুইন্স ইউনিভার্সিটিতে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে পড়তে গিয়েছি। ক্যাম্পাসের পাশে প্রিন্সেস স্ট্রিটের এক বাসায় আমার অস্থায়ী নিবাস। ছোট এই শহরকে ছাত্রছাত্রীরাই মাতিয়ে রেখেছে। কানাডার অন্যান্য জায়গার মতো এখানেও জনবসতি ঘন নয়। তাই ওদের বাদ দিলে কিংস্টন ভুতুড়ে নগরীতে পরিণত হতে বাকি থাকবে না। শহর মূলত বাজারকেন্দ্রিক। আমাদের ক্যাম্পাসটাও সেখানে।
দেড় শতাধিক বছরের পুরনো ক্যাম্পাসের ধার ঘেঁষে পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ হ্রদ লেক অন্টারিও। লেক অন্টারিওর বুকে ১২৪ বর্গকিলোমিটারের খুদে দ্বীপ উলফ আইল্যান্ড। পড়েছে যুক্তরাষ্ট্র আর কানাডার মাঝামাঝি। দ্বীপ থেকে ফেরিতে করে দুটি দেশেই যাওয়া যায়। কিংস্টন থেকে উলফ আইল্যান্ডে প্রতিদিন চলে ফ্রি ফেরি। সময় লাগে মাত্র ২০ মিনিট। সে সুবাদে কুইন্সে পড়তে আসা অনেকেরই প্রথম ঘোরাঘুরি করা হয় এই উলফ আইল্যান্ডে। দ্বীপটি যাকে বলে ‘ছবির মতো সুন্দর’। জনসংখ্যা ১৪০০। বেশির ভাগের পেশা কৃষিকাজ। সাইকেল চালিয়েই ঘুরে ফেলা যায় দ্বীপের এমাথা-ওমাথা। চলতে গিয়ে চোখে পড়ে মাইলকে মাইলজুড়ে ফার্ম আর মাঝেমধ্যে ঘোড়ার আস্তাবল। সবুজের সমারোহে মনটাই ভালো হয়ে যায়। আর আছে শখানেক উইন্ডমিল। তালগাছের মতো এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকা উইন্ডমিলগুলো দূর থেকে চোখে পড়ে।
শনিবার দুপুর ২টায় ছাড়বে ফেরি। ১টা বাজে। বাসস্টপে দাঁড়িয়ে আছি। দূর থেকে আসতে দেখলাম মিসরীয় বন্ধু মোহাম্মদকে। কাছে এসেই বলল-‘সুন্দর আবহাওয়া! চলো হাঁটি।’ ডাউনটাউনের রাস্তা ধরে হাঁটছি। চমৎকার দুপুরের আনন্দ মাখতে শহরতলি জমজমাট। আধা ঘণ্টার কম সময়ে পৌঁছে গেলাম জেটিতে। গিয়ে দেখি, বাকি সবাই আগে থেকেই হাজির। ফেরি ভিড়েছে জেটিতে। ওপারের মানুষ আর গাড়িগুলো নেমে যেতেই আমরা উঠে গেলাম। মেক্সিকান কার্লোসের শখ ছবি তোলা। ক্যামেরা হাতে নানা ভঙ্গিতে সে পটাপট ছবি তুলে যাচ্ছে। ফেরি চলতে শুরু করলে আমরা রেলিংয়ের পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। ঠাণ্ডা পানির ঝাপটা এসে লাগল চোখেমুখে। দ্বীপের অবয়ব স্পষ্ট হচ্ছে ধীরে ধীরে। ঘড়ি ধরে ২০ মিনিট। উলফ আইল্যান্ডে নোঙর করল ফেরি।
ঘাটে নেমে দেখলাম, ডান দিকের কোণে দাঁড়িয়ে থাকা হলুদ রঙের স্কুলবাসটায় সার বেঁধে উঠছে লোকজন। আমরাও লাইনে দাঁড়ালাম। বাস আমাদের নিয়ে যাবে দ্বীপের একমাত্র গ্রাম মেরিসভিলে। সেখানে দুটি প্রাইভেট কার আমাদের অপেক্ষায় আছে। একটি চালাচ্ছেন কর্ন মেজের মালিক, আরেকটি তাঁর স্ত্রী। গাড়িতে বসে জানলাম, কর্ন মেজ ওদের পরিবারই চালায়। নকশা থেকে শুরু করে ভুট্টাগাছ লাগানো আর রক্ষণাবেক্ষণ-সব নিজেরা করেন। প্রতিবছর নকশা বদল করা হয়। এ বছরের নকশায় দুটি গোলকধাঁধা। বড়টি সমাধান করতে কমপক্ষে ৪৫ মিনিট লাগবে। তারপর চাইলে পাশের ছোটটিতে যাওয়া যায়। দুটি গোলকধাঁধার মধ্যে আছে বিশ্রাম নেওয়া আর পানি পানের জন্য বসার ছাউনি। আমরা ভেতরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিলাম।
মেক্সিকো, ব্রাজিল, মিসর, জাপান, চীন, কানাডা আর বাংলাদেশ-সাত দেশের আটজন। দুটি দলে ভাগ হতে হবে। ক্যামেরাওয়ালা কার্লোসকে সবাই দলে টানতে চায়। শেষমেশ টস হলো। আমি, মোহাম্মদ, ব্রাজিলিয়ান বিয়াত্রিহ আর মেক্সিকান নাটালিয়া পড়লাম এক দলে। প্রতিটি দলে একটি ওয়াকিটকি। হইহই করতে করতে গোলকধাঁধায় প্রবেশ করলাম। আমরা চললাম এক দিকে। বাকি চারজন অন্য দিকে। সার বেঁধে ঘন করে লাগানো ভুট্টাগাছ। সামনে ছাড়া আর কোনো পথঘাট খোলা নেই। সরু পথ। পাশাপাশি দুজন চলা যায় না। পালা করে একেকজন সামনে থাকব ঠিক করলাম। সে যেদিকে যাবে, বাকিরা তাকে অনুসরণ করব। হাঁসের মূর্তি খুঁজছি আমরা। ওগুলো একেকটা মাইলফলকের মতো। ঠিক পথে চলছি কি না জানান দেবে। ওয়াকিটকি হাতবদল হচ্ছে। বুঝতে চেষ্টা করছি অন্য দলটা কোথায় আছে। এ গলি-ও গলি পেরিয়ে প্রথম হাঁসটা খুঁজে পেলাম। যাক, ঠিক পথেই যাচ্ছি! তিন বা চার রাস্তার মাথায় এসে বিপদ হয়। কোথাও সমান্তরালে ভাগ হয়ে গেছে দুটি রাস্তা। একটি রাস্তা ধরে অনেকখানি এগিয়ে যাওয়ার পর টের পাই, ওটা কানাগলি। আবার পেছাতে পেছাতে শুরুতে ফিরে আসি। অন্য পথ ধরি। ওই তো আরেকটা হাঁস দেখা যায়! নবোদ্যমে পরবর্তী হাঁসের খোঁজে পা চালাই। শেষ হাঁসটা খুঁজে পেতে ঘুরে মরলাম বারকয়েক। বুঝলাম, একই রাস্তায় বারবার ফিরে যাচ্ছি। তাই মাটিতে দাগ কেটে চিহ্ন দিয়ে রাখলাম। শেষ পর্যন্ত হাঁসের দেখা মিলল। ওটাকে পেছনে ফেলে কয়েক কদম যেতেই বিশ্রামের ছাউনিটা চোখে পড়ল। অন্য দলটি তখনো এসে পৌঁছেনি। তার মানে আমরাই জয়ী। বড় গোলকধাঁধাটা সমাধান করে ফেলেছি।
অন্য দলটি বের হলো আরো প্রায় ২০ মিনিট পর। আমরা ওয়াকিটকিতে দিক বোঝানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম। ছাউনির রেলিংয়ের ওপর উঠে আতিপাতি করে খুঁজছিলাম ওদের এই ভুট্টাবনের মধ্যে। সব শেষে যখন চারটা মাথা একসঙ্গে এগিয়ে আসতে দেখলাম, তখন আমাদের উল্লাস দেখে কে! একসঙ্গে কয়েকটি ছবি তোলা হলো। কিন্তু ছোট গোলকধাঁধার মধ্যে যেতে কারো আগ্রহ দেখা গেল না। তার বদলে আমরা বাইরে এসে ভলিবল খেললাম। কেউ সবুজ ঘাসের বিছানায় দিল শান্তির ঘুম। দারুণ কাটল ছুটির দিনটা!
ছবি : কার্লোস। সৌজন্যে : কালের কণ্ঠ