Skip to content

ভুল প্রমাণিত বিজ্ঞানের কয়েকটি মিথ

নাদিয়া নাহরিন রহমান

আমরা মস্তিষ্কের ১০ ভাগের এক ভাগ ব্যবহার করি মাত্র

আমরা মস্তিষ্কের অনেক রহস্যই এখনও উদঘাটন করতে পারিনি। তবে এটাও সত্য যে আমরা আমাদের মস্তিষ্কের প্রায় সবটাই ব্যবহার করে থাকি।

এটা অবশ্য ঠিক যে, মাথা স্ক্যান করে প্রমাণ করা সম্ভব নয় মস্তিষ্কের ১০ শতাংশ ব্যবহার সম্পর্কিত গুজবটি মিথ্যা। তবু সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানেই বোঝা যায় ধারণাটি অবান্তর। গবেষণায় দেখা গেছে, মানব মস্তিষ্কের ওজন ২ পাউন্ডের বেশি না হলেও এর জ্বালানি চাহিদা অবিশ্বাস্য। মানব শরীরে যে অক্সিজেন ও গ্লুকোজ প্রবেশ করে তার ২০ ভাগই মস্তিষ্কের জ্বালানি হিসেবে খরচ হয়ে যায়।

তাছাড়া ব্রেন টিউমারে আক্রান্ত কোনো ব্যক্তিকে কখনোই ডাক্তারদের পক্ষ থেকে বলতে শোনা যায়নি যে, ‘সুখবর! আপনার মস্তিষ্কের অব্যবহূত অঞ্চলেই আপনার টিউমারটি ধরা পড়েছে!’

মস্তিষ্কের বেশিরভাগই যদি অব্যবহূত থাকতো তাহলে মাথায় গুলি খেয়েও কারও মস্তিষ্ক খুব একটা ক্ষতিগ্রস্ত হতো না। অথচ মাথায় গুলি খাওয়ার পর খুব কমসংখ্যক লোকেরই বেঁচে থাকার নজির আছে। কেউ বেঁচে থাকলেও মারাত্মক সব পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়েই তাকে বেঁচে থাকতে হয়েছে বা হচ্ছে।

তবে এমনটি ভাবাও ঠিক হবে না যে, আপনি সারাক্ষণই আপনার মস্তিষ্কের সবটা ব্যবহার করছেন। বরং আপনার সারাদিনের কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়েই আপনার মস্তিষ্কের পুরোটা ব্যবহূত হয়ে থাকে।

তবে অনেককে দেখে মনে হতে পারে যে, তারা তাদের মস্তিষ্কের সম্ভাবনার পুরোপুরি সদ্ব্যবহার করছে না বা করতে পারছে না। কিন্তু তার মানে এই নয় যে প্রতিদিনই তারা তাদের পুরো মস্তিষ্ক ব্যবহার করছে না। বরং সাধারণত তার উল্টোটাই ঘটে থাকে। আমরা প্রতিদিনই আমাদের পুরো মস্তিষ্কটাই অন্তত একবারের জন্য হলেও ব্যবহার করে থাকি।

Mith

চাঁদের একটা অন্ধকার দিক আছে

পৃথিবী থেকে আমরা চাঁদের মাত্র ৫৯ শতাংশ দেখতে পাই। তাও সব সময় নয়। ভরা পূর্ণিমায়ই তা সম্ভব। বাকি ৪১ শতাংশ আমাদের দৃষ্টির অগোচরেই রয়ে যায়। আমরা হয়তো ভেবে থাকতে পারি ওই অংশটুকু বুঝি সব সময়ই হিমশীতল অন্ধকারে নিমজ্জিত থাকে এবং সেখানে সূর্যের আলোও বুঝি পড়ে না। কিন্তু না, এই ধারণা ঠিক নয়।

আসলে এই ভুল বোঝাবুঝিটা তৈরি হয় মূলত চাঁদের ঘূর্ণন সংক্রান্ত বিষয়ে আমাদের কোনো পরিষ্কার ধারণা না থাকার কারণে। চাঁদ আসলে এর নিজ অক্ষে খুবই ধীর গতিতে ঘুরছে। পৃথিবীর চারপাশে ঘুরে আসতে চাঁদের যতটুকু সময় লাগে নিজ অক্ষে একদফা ঘূর্ণন শেষ করতেও ঠিক ততোটুকু সময়ই লাগে চাঁদের।

ফলে চাঁদের একটা অংশ কখনোই পৃথিবী থেকে দেখা যায় না। এতে ওই অংশে সূর্যের আলো পড়লো কি পড়লো না তাতে কিছুই যায় আসে না। তা সব সময়ই আমাদের দৃষ্টির আড়ালেই থেকে যায়।

চন্দ্রগ্রহণের সময়টুকু ছাড়া সূর্যের আলো সব সময়ই এর অর্ধেক অংশকে আলোকিত করে থাকে। যেমন করে পৃথিবীর অর্ধেক অংশও সব সময়ই সূর্যের আলোয় আলোকিত থাকে। পৃথিবীর দিকে মুখ করে থাকা চাঁদের অর্ধাংশ যখন সূর্যের আলোয় পুরোপুরি আলোকিত হয় তখনই আমরা একে পূর্ণিমা বলে আখ্যায়িত করি। আর যখন চাঁদের বেশিরভাগ অংশ বা পুরো চাঁদটাই অদৃশ্য থাকে তখন আসলে সূর্যের বেশিরভাগ বা সবটুক আলো চাঁদের ওই উল্টো দিকটাতে পড়ে। যা আমাদের পৃথিবী থেকে দেখা সম্ভব হয় না।

আসল কথা হলো, চাঁদের যে অংশ কখনোই পৃথিবী থেকে দেখা সম্ভব হয় না সে অংশটুকু পৃথিবী থেকে দেখা যাওয়া অংশ থেকে কোনোমতেই কম বা বেশি অন্ধকার নয়।

চিনি বাচ্চাদের অস্বাভাবিক সক্রিয় ও তত্পর করে তোলে

বেশি বেশি কেক, আইসক্রিম ও মিষ্টি পানীয় পান করলে বাচ্চাদের মাঝে অস্বাভাবিক তত্পরতা দেখা দেয় বলে বহুল প্রচলিত একটা ধারণা আছে। ইংরেজিতে একে বলা হয় ‘সুগার বাজ’। কিন্তু এখন পর্যন্ত এ ব্যাপারে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে মিষ্টি জাতীয় খাবার বেশি খেলে রক্তে ইনসুলিনের মাত্রায় কিছুটা হেরফের ও মানসিক বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে।

আসলে জন্মদিন ও হ্যালোউইন উত্সব ঘিরে বাচ্চাদের হইচই দেখে এই ধারণা গড়ে উঠেছে। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা হলো, জন্মদিন বা হ্যালোউইন উত্সবে বাচ্চারা অন্য বাচ্চাদের সংস্পর্শে এসে স্বাভাবিকভাবেই একটু বেশি উত্তেজিত হয়ে পড়ে। তবে ক্যাফেইন জাতীয় খাদ্য উপাদানের ওপরও এর কিছুটা দোষ চাপানো যেতে পারে। বাচ্চারা হ্যালোউইন উত্সবে নিজেদের মাঝে যে চকোলেট বিনিময় করে তাতে থাকে প্রচুর পরিমাণ ক্যাফেইন থাকে। ক্যাফেইন মানুষের নিদ্রাভাব ও ক্লান্তি দূর করে মস্তিষ্ককে বেশিক্ষণ ধরে সক্রিয় থাকতে সহায়তা করে।

তার মানে এই নয় যে বাচ্চাদেরকে লাগামহীনভাবে মিষ্টি জাতীয় খাদ্য ও পানীয় খেতে দেওয়া যাবে। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, বর্তমানে মার্কিনিদের বছরে মাথাপিছু ১৫৬ পাউন্ড করে চিনি লাগে। অথচ ২০০ বছর আগে মার্কিনিদের বছরে মাথাপিছু চিনি লাগতো মাত্র ৩ থেকে ৫ পাউন্ড। অতিরিক্ত মিষ্টি জাতীয় খাদ্য ও পানীয় গ্রহণের ফলে ওজন বেড়ে যাওয়া, রক্তে ইনসুলিনের মাত্রার গড়বড়, উচ্চ রক্তচাপ এবং এমনকি ক্যান্সারের ঝুঁকি বেড়ে যায়।

উঁচু ভবন থেকে ছুড়ে ফেলা কয়েন মাথায় পড়লে মৃত্যু

কিন্তু সত্য হলো আপনি যদি আমেরিকার অ্যাম্পায়ার স্টেট বিল্ডিংয়ের ছাদে উঠে নিচের ফুটপাত দিয়ে হেঁটে যাওয়া বা দাঁড়িয়ে থাকা কারও মাথায় এক পেনির একটি কয়েন নিক্ষেপ করেন তাতে তার মৃত্যু হবে না।

কারণ এক পেনির একটি কয়েনের ওজন এক গ্রামের বেশি নয়। আর সমতল গোলাকার হওয়ার কারণে তা বায়ুশক্তির চাপও খুব বেশি একটা ধারণ করতে সক্ষম না। কারণ নিচে পড়ার পুরোটা সময়জুড়েই সেটা ডানা ঝাপটানোর মতো করে গড়িয়ে পড়বে। এছাড়া এর ক্ষুদ্র আকার ও নিচু প্রান্তীয় গতি (১০৫ কি.মি./ঘণ্টায়) নিচে দাঁড়িয়ে থাকা বা হেঁটে যাওয়া কারও মাথার ওপর পড়লেও খুব বেশি একটা ক্ষতিসাধন করতে পারবে না। এতে মাথায় শুধু একটি আঘাত করার অনুভূতি হবে।

মরার পরও বড় হতে থাকে মানুষের চুল আর নখ

মৃত্যুর পরও কারও নখ এবং চুল বড় হওয়ার জন্য খাদ্যগ্রহণ, হজম প্রক্রিয়া সচল থাকা এবং দেহকোষ উত্পাদন প্রক্রিয়া জারি থাকতে হবে। কিন্তু মৃত্যুর পর এসব একদমই সম্ভব নয়। সুতরাং দেহের পক্ষে নখ ও চুলের জন্য প্রয়োজনীয় প্রোটিন কেরাটিনও আর উত্পাদন সম্ভব নয়।

মৃত্যুর পর আর্দ্রতার অভাবে চুল ও নখ কুঁচকে যায় না। যা দেখে অনেকে মনে করতে পারেন যে মৃত্যুর পরও বুঝি চুল ও নখ বেড়ে চলেছে। এতে কাউকে ক্লিন সেভড অবস্থায় কবর দেওয়ার কয়েকদিন পর তার মুখে খোঁচা-খোঁচা দাঁড়ি গোফ গজিয়েছে বলেও মনে হতে পারে। আসলে কবর দেওয়ার আগে আন্তেষ্টিক্রিয়া সম্পন্নকারী হাউজগুলো পুনঃরায় স্মারক সেবা দেওয়ার আগেই যেন মৃতদেহটি শুকিয়ে না যায় সেজন্য মৃতদেহ ধোয়ার পর তাতে যথেষ্ট পরিমাণ আর্দ্রতা রক্ষাকারী রাসায়নিক প্রয়োগ করে। যার ফলে চুল ও নখ তাজা থাকে।

চুইংগাম হজম করতে ৭ বছর লাগে

চুইংগাম হজম করতে ৭ বছর সময় লাগে না। এমনকি আপনাকে আসলে তা হজম করতেও হবে না। কারণ চুইংগামে সামান্য মিষ্টি জাতীয় খাদ্য উপাদান এবং সুগন্ধি মসলা ছাড়া আর বেশি কিছুই থাকে না, যা মানবদেহ ভাঙতে ও ব্যবহার করতে পারে। চুইংগামের বেশিরভাগই ইলাস্টোমারস নামের রাবার জাতীয় পলিমার থেকে তৈরি হয়ে থাকে। আর গামটাকে নরম ও আর্দ্র রাখার জন্য গ্লিসারিন ও ভেষজ তেল থেকে তৈরি কিছু উপাদান যোগ করা হয়। ফলে মানবদেহ চুইংগাম থেকে যতটুক গ্রহণ সম্ভব ততোটুকুই গ্রহণ করে। বাকিটা বর্জ্য হিসেবে মলের সঙ্গে বের করে দেয়।

তার মানে এই নয় যে চুইংগাম গিলে ফেললে কোনো সমস্যা নেই। বেশি পরিমাণ চুইংগাম গিলে ফেললে কোষ্ঠকাঠিন্য দেখা দিতে পারে এবং পাকস্থলিতে অবরোধের সৃষ্টি হতে পারে। ফলে তা সরানোর জন্য অপারেশন করারও প্রয়োজন হতে পারে।

এছাড়া কয়েন, ছোট খেলনা এবং সূর্যমুখী ফুলের বীজের তীক্ষ্ন চামড়ার সঙ্গে মিশে গিয়েও চুইংগাম পাকস্থলিতে মারাত্মক ব্লক সৃষ্টি ও ক্ষত তৈরি করতে পারে। সুতরাং গিলে ফেলা চুইংগাম আপনার পেটে সাত বছর ধরে অবস্থান করার সম্ভাবনা না থাকলেও চিবিয়ে রসটুকু খেয়ে নেওয়ার পর বাকি গামটুকু ফেলে দেওয়াই ভালো। আর বাচ্চারা যতদিন পর্যন্ত এর গিলে ফেলার বিপদ সম্পর্কে সচেতন হওয়ার মতো বড় না হচ্ছে ততোদিন তাদের চুইংগাম খেতে না দেওয়াই উত্তম। সূত্র : ইত্তেফাক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *