তুহিন ডি. খোকন
ভূ-স্বর্গ কাশ্মীর। প্রকৃতির বিচিত্র রঙের অলঙ্করণে সজ্জিত। তুষারশুভ্র বরফ আর নীল পাহাড়ে ঘেরা এর গ্রামগুলো যেন তেল রঙে আঁকা। এক দিনে কি শেষ হয় এর সৌন্দর্য উপভোগ!
স্বর্গ লাভের ইচ্ছে তো সবারই, কিন্তু ইহকালে এমন কোনো পূণ্য করিনি যে স্বর্গপ্রাপ্তি নিশ্চিত হবে। তাই দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর মতো মর্ত্যের-স্বর্গ তথাপি ভূ-স্বর্গ দর্শনের দুর্বার ইচ্ছা বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হই ২০১৩-এর সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে।
বিদেশ তো বটেই, তার উপর ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা কাশ্মীর। যেখানে প্রতিদিনই কোনো না কোনো দুর্ঘটনা বা সশস্ত্র হামলা ঘটছেই। তবুও ভূ-স্বর্গ বলে কথা, আনাচে কানাচে যার লুকায়িত ঐশ্বর্যে ভরা।
কলকাতা থেকে দূরপাল্লার যেকোনো ভ্রমণকে আরামদায়ক ও ইকোনমি করতে ট্রেনই হলো সবচেয়ে সুবিধাজনক। অন্যান্য রুটে অনেক ট্রেন থাকলেও জম্মু অবদি শুধুমাত্র দু’টি ট্রেনই আছে।
এরমধ্যে সবচেয়ে ভালো আর অপেক্ষাকৃত কম সময় নেয় হিমগিরি এক্সপ্রেস। সপ্তাহে মাত্র তিনদিন চলা এই ট্রেনের টিকেটও অনেকটা সোনার হরিণ।
যাই হোক একটু আগেভাগে প্ল্যান করাতে প্রায় দেড়মাস আগে এসি টু-টায়ারে ছয়টির মধ্যে চারটি কনফার্ম টিকেট পেয়ে গেলাম, বাকি দু’টি রেক (রিজার্ভেশন এগেইনস্ট ক্যানসেলেসন) এ থাকলো।
আমাদের ইন্ডিয়ান ট্রাভেল এজেন্ট জানালো এই দু’টি টিকেট নিশ্চিন্তে কনফার্ম হয়ে যাবে ভ্রমণের চব্বিশ-ঘণ্টা আগেই। আমাদের শুধু অনলাইনে অথবা স্টেশনে গিয়ে চার্ট দেখে সিট ও বগি নম্বরটি জেনে নিতে হবে।
টিকেট কাটার মুহূর্ত থেকেই শুরু হয়ে গেল আমাদের স্বর্গ দর্শনের প্রতীক্ষা… প্রতীক্ষার প্রহর সত্যিই খুব যন্ত্রণাদায়ক।
নোমান, আমি এবং আমাদের পরিবার ইতোমধ্যে হিমাচল প্রদেশসহ ভারতের দর্শনীয় জায়গাগুলো ঘুরে শেষ করেছি। তাই কী ধরনের ট্রাভেল গিয়ার নিতে হয় সে-সম্পর্কে আমাদের বেশ ভালোই ধারণা আছে। ভ্রমণের তারিখ যতই ঘনিয়ে আসতে লাগলো, আমরা ততই এক্সাইটেড হতে লাগলাম।
প্রায় সপ্তাহখানেক ধরে গুছানো শেষে একদিন সত্যি সত্যি সোহাগ-পরিবহনের স্ক্যানিয়াতে রওনা দিই কলকাতার উদ্দেশে।
বেনাপোল সীমান্ত পার হয়ে ভারতের হরিদাসপুর থেকে কলকাতাগামী বাসে দেখা হলো একসময়ের চিত্রনায়ক সাকিল খান ও তার স্ত্রীর সঙ্গে, সহজাত মিশুক স্বভাবের নোমান শুরুতেই গল্প জুড়ে দিলো ওই দম্পতির সঙ্গে। কিছু পর আমরা বাকিরা যোগ দিই, ততক্ষণে আসর জমে উঠেছে।
বিকেল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ হঠাৎ প্রবল বৃষ্টি শুরু হলো। মারকিউস স্ট্রিটে বাস যখন পৌঁছালো তখন বৃষ্টি কিছুটা কমে আসলেও একেবারে থেমে যায়নি। সেই সন্ধ্যায় টিপটিপ বৃষ্টির মধ্যেই জলকাদা ভেঙে আমি আর নোমান হোটেল খুঁজতে বেরুই বউ-বাচ্চাদের বাস কাউন্টারে রেখে।
অনেক খুঁজেও বাজেটের মধ্যে কোনো হোটেল না পেয়ে শেষে হোটেল কন্টিনেন্টালে উঠে পড়ি প্রতিরাত ২০০০ রুপি চুক্তিতে।
শুরুতেই বাজেট বিপর্যয়ের বিষয়টা একেবারেই ভালো লাগলো না আমাদের। যাই হোক পরদিন সকালে নাস্তা সেরেই ছুটলাম ফেয়ারলি প্লেসে ফরেন কোটায় দিল্লি টু কলকাতা টিকেট কাটাতে। কেননা আমাদের যাওয়ার টিকেট কনফার্ম থাকলেও আসার টিকেট পাইনি পূজার ছুটির কারণে। ওই দিনের জন্যে মাত্র ছয়টি টিকেটই ছিল এসি -থ্রিটায়ারে ফরেন কোটাতে।
রিজার্ভেশন অফিসারকে অবাক করে দিয়ে ছ’টি টিকেটই কনফার্ম করলাম আমরা। তারপর আধুনিক জিপিএস সুবিধা ব্যবহার করে পুরানো কলকাতা নগরীর পথে পথে হেঁটে-হেঁটে আমি আর নোমান হোটেলে ফিরলাম দুপুরবেলায়।
ওইদিনই রাত ১১টা ৫৫ মিনিটে আমাদের ট্রেন। তাই ঠিক করলাম একদিনের জন্যে শুধু শুধু ৪০০০ রুপি খরচ না করে সেই সময়টা সিনেমা দেখে আর মার্কেটে মার্কেটে ঘুরে পার করে দেবো।
নিউমার্কেট সংলগ্ন এলিট সিনেমা হলের ছয়টি টিকেট কাটি ৬০০ রুপি দিয়ে। তিনটে থেকে ছটা অবদি সিনেমা দেখা শেষ করে কলকাতা নিউমার্কেটের অলিগলি ঘুরে সামান্য কিছু শপিং করে নিই। রাতে হোটেল রাঁধুনীতে সাড়ে ৯টা অবদি ডিনার সেরে দশটা নাগাদ টেক্সি ধরি হাওড়ার উদ্দেশে।
নোমানসহ অন্যরা রইল এসি ওয়েটিং রুমে আর আমি নির্দিষ্ট প্ল্যাটফর্মে লাগেজ-পত্তর নিয়ে একা একা বসে থাকি প্রায় দু’ঘণ্টা। ট্রেন আসার ঘোষণা শুনেই ফোন লাগাই নোমানকে। তারপর ট্রেনে ভূ-স্বর্গের উদ্দেশে, স্বর্গ-যাত্রা হলো শুরু…
হিমগিরি এক্সপ্রেস। নামটি যেমন সুন্দর ট্রেনটিও তেমনি। অপেক্ষাকৃত অন্যান্য সিটের চেয়ে এসি-টু টায়ারের শোয়ার এবং বসার সিটগুলোর পাশাপাশি অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাও বেশি। শুয়ে শুয়ে বই পড়ার জন্যে অ্যাডজাস্টটেবল রিডিং লাইট, ধোলাই করা টাওয়াল-বেডসিট সঙ্গে খাওয়াদাওয়ার মানও বেশ উন্নত।
কলকাতা থেকে জম্মুর দূরত্ব ২ হাজার ২০ কিলোমিটার। প্রায় ৪০ ঘণ্টা জার্নি শেষে আমরা যখন জম্মু রেল স্টেশনে পৌঁছলাম তখন বেলা ৩টা।
স্টেশন থেকে বেরিয়েই আক্কেল গুড়ুম আমাদের। মানুষ দাঁড়িয়ে-বসে-শুয়ে আছে কিন্তু কোনো গাড়ি যাচ্ছে না। প্রি-পেইড টেক্সি কাউন্টারে খবর নিয়ে জানতে পারলাম আজ বন্ধ। কোনো গাড়ি শ্রীনগরে যাবে না।
আশপাশে তাকাই, দেখি বৃদ্ধ, কোলের শিশু নিয়ে মানুষজন বড্ড অসহায় হয়ে মালপত্তর নিয়ে কেউ দাঁড়িয়ে কেউবা বসে আছে।
আমার দীর্ঘ ভ্রমণ অভিজ্ঞতা থেকে আমার বেশ জানা, পৃথিবীতে দু’নম্বর ব্যবস্থা সবখানেই থাকে। তাই একটুও দেরি না করে বিকল্প-সন্ধান খুঁজতে বেরিয়ে পড়ি আমি আর নোমান।
এ গলি ও গলি পেরিয়ে শেষে স্টেশনের পাশেই এক সরু গলিতে একটা ট্রাভেল এজেন্সির সঙ্গে কথা হয়। তারা মোটামুটি সহনীয় ভাড়াতেই আমাদের শ্রীনগর নিতে রাজি হয়ে যায়।
আপেলের ভরা মওসুম, তাই গাড়িতে ওঠার আগে খুব সস্তায় প্রতিজনের জন্যে দু’টি করে বিশাল আকৃতির আপেল কিনে বেলা সাড়ে ৩টায় রওনা দিই ২৯৮ কি. মি. দূরের কাশ্মিরের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী শ্রীনগরের উদ্দেশে। প্রায় ১৪ ঘণ্টা পাহাড়ি রাস্তায় জার্নি শেষে যখন শ্রীনগরে পৌঁছলাম তখন রাত দু’টো।
মেইক মাই ট্রিপ ডট কমে হোটেল রিজার্ভেশন আগেই করা ছিল। এই রাত দুপুরে হোটেল ওয়ালাকে ফোন করতেই সে জানালো যে লোক পাঠাচ্ছে আমাদেরকে ১৪ নম্বর ঘাটের সামনে থেকে নিয়ে যাওয়ার জন্যে।
শুরুতেই যা খটকা লাগলো একটু পরেই সত্যি প্রমাণিত হলো তা। ওয়েবসাইটে হোটেলের ছবিতে হোটেলটির অবস্থান ডাঙাতে দেখালেও সত্যিকারে এর অস্তিত্ব বিখ্যাত ডাল-লেকের ওপাড়ে। শুনশান শীতল মধ্যরাতে প্রায় আধ-ঘণ্টা অপেক্ষার পর ঘুটঘুটে অন্ধকার ডাল-লেক থেকে ভেসে এলো লম্বা জোব্বা পরিহিত বৃদ্ধ-তরীওয়ালার ডাক।
পরিস্থিতি অনেকটা ব্যাখ্যাতীত, মাঝ-রাত, পুরো শ্রীনগর শহর সুনসান, এর মধ্যে অন্ধকার লেক থেকে যেন নরকের দূত আমাদের নিতে এসেছে শয়তানের কেয়ারা নিয়ে।
যাই হোক বউ-বাচ্চা নিয়ে বিপদ-সংকুল কাশ্মীরের পথে পড়ে থাকার চেয়ে সেই ডাকে সাড়া দেওয়াই উত্তম মনে করি। লেকের ওপাড়ে গিয়ে প্রথমে দমে যাই হোটেরে রুম দেখে, দ্বিতীয়বার দমে যেতে হয় টয়লেটের অবস্থা দেখে।
রুমের মধ্যেই টয়লেটের ভ্যান্টিলেশন। এই মাঝ রাতে কিছু করার নাই দেখে কোনক্রমে রাতটি পার করাই মোক্ষম সিদ্ধান্ত বলে মনে হয়।
রাত প্রায় তিনটের দিকে ঘুমালেও চিরাচরিত অভ্যাসবশত ভোর ৫টায় ঘুম ভেঙে যায়। কিছুক্ষণ মটকা মেরে পড়ে থেকে ট্র্যোকস্যুট ও কেডস পরে বেরিয়ে পড়ি। কিন্তু মেইনল্যান্ডে যাওয়ার জন্যে এই ভোরে কোথাও কোনো পারাপারের ডিঙি তথা শিকারা দেখা যায় না।
পাশাপাশি সারিবদ্ধ হাউসবোটগুলোর হালচাল দেখে আবারও রুমে ফেরত আসি। ৮টার দিকে নোমানকে নিয়ে মেইনল্যান্ডে চলে আসি একটা শিকারা ধরে। বউ-বাচ্চাদের নাস্তার ব্যবস্থা হোটেলে করে এলেও, তখনও আমাদের দু’জনের কেউ নাস্তা করিনি। ছোট একটি রেস্টুরেন্টে ঢুকে ব্রেকফাস্ট সেরে বেরিয়ে পড়ি স্থলভাগে হোটেলের সন্ধানে।
অনেক খোঁজাখুঁজির পর মেইন রোড থেকে সামান্য ভেতরে ‘হোটেল মধুবন’ একেবারে মনেপ্রাণে পছন্দ হয়ে যায়। বিস্তীর্ণ ফুলের বাগান, সবুজ ঘাসের লন, সুদৃশ্য হোটেল দালান সবকিছু এতো ভালো লাগলো যে ভাষায় প্রকাশ করার নয়।
এবার নোমান কথা বললো হোটেল ম্যানেজার মেহেদী হাসানের সঙ্গে। প্রথমে ২৫০০ রুপি ভাড়া চাইলেও পরে আমরা প্রতিরাত ১২৫০ রুপিতে ম্যানেজ করলাম পাঁচ দিনের জন্যে। অ্যাডভান্সের টাকাটা দিয়েই ভোঁ-ছুট বউ-বাচ্চাদের আগের হোটেলের বাটপারদের থেকে রক্ষা করতে।
চেক-আউট সেরে ব্রেকফাস্টের বিল দিতে গিয়ে চক্ষু-ছানাবড়া আমাদের। সামান্য দু’টি পরোটা আর একটু ভাজির জন্যে ১৫০ রুপি মাথাপিছু বিল! ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা।
এক নৌকাতে সবাই উঠতে পারবো না, তাই আমি, আমার স্ত্রী-কন্যা ও নোমানের দুই মেয়েকে নিয়ে প্রথম ট্রিপে মেইনল্যান্ডে চলে আসি। পরের ট্রিপে নোমান ও তার স্ত্রী আসতে আসতে এরই মধ্যে ডাললেইক ও নেহেরু পার্কে শ’খানেক ছবি তোলা হয়ে গেল আমাদের।
নতুন হোটেলে চেক-ইন করি। আমার ও নোমানের মতো আমার স্ত্রী টুম্পা, মেয়ে কান্তম, নোমানের সহধর্মিনী ফারহানা ও মেয়ে ইসাবা ও আরিনারও খুব মনে ধরলো হোটেল মধুবন।
লাগেজ রেখে মোটামুটি রুম-গুছিয়ে সবাই মিলে শ্রীনগরের আশ-পাশ ঘুরতে বেরিয়ে পড়ি। কিছুক্ষণ হেঁটেই বুঝতে পারি, এভাবে লোকাল সাইটসিয়িং সম্ভব নয়। তাই কাছের ট্রেক্সি-স্ট্যান্ড থেকে ১৬০০ রুপি দিয়ে হাফ-ডে সাইট সিয়িং এর ব্যবস্থা করি, আমাদের ড্রাইভারের নাম রিয়াজ।
কাশ্মির ভ্যালিতে অবস্থিত শ্রীনগর শহরটির আয়তন ১৮১ বর্গ কিলোমিটার, স্থানীয় লোকসংখ্যা প্রায় দশ লাখের কাছাকাছি। সমগ্র কাশ্মির তিন স্তরের নিরাপত্তা বেস্টনিতে ঘেরা- প্রথম স্তরে পুরোপুরি যুদ্ধাবস্থা পোশাকে ভারতীয় সেনাবাহিনী, দ্বিতীয় স্তরে আধা-সামরিক বাহিনী বিএসএফ ও তৃতীয় স্তরে কাশ্মিরী পুলিশ।
প্রথমেই অনেকে ভড়কে যাবে মাত্রাতিরিক্ত এই নিরাপত্তা ব্যবস্থা দেখে। অবশ্য আমরা কাশ্মিরে পৌঁছার দুদিন আগেই আজাদ কাশ্মিরের বিচ্ছিন্নতাবাদী গেরিলারা একজন পূর্ণ কর্নেলসহ সেনাবাহিনীর ৮ সদস্যকে হত্যা করে।
ফলে নিরাপত্তা ব্যবস্থা এখন আরো কঠিন অবস্থায় বিরাজমান। অবশ্য এর বিপরীতে যা দেখি, তাতে চোখ জুড়িয়ে যায়। কাশ্মিরের বাসিন্দা তা পুরুষ হোক আর মহিলা, এত রূপবান পুরুষ ও রূপবতী নারী আগে কোথাও দেখিনি। প্রধানত: আবহাওয়াগত কারণে এদের স্বাস্থ্য, রঙ ও মেজাজ এতো ভালো। আমাদের পুরো দলই কাশ্মিরীদের রূপ-মুগ্ধ হয়ে পড়ি। প্রথমেই আমরা যাই মোগল গার্ডেনে।
পথে পথে পাইন সারির শোভাবেস্টিত পর্বতমালা, তারই মাঝে অসংখ্য নাম না জানা ফুলের স্বর্গ, চারদিকে এতো রঙ যে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। অনেক ছবি তোলা শেষে শহর প্রান্তে পরিমহলে যাই। অনেক উঁচুতে অবস্থানের কারণে নাগিন ও ডাল লেইকের প্রান্তঘেঁষা মোটামুটি অর্ধেক শ্রীনগর শহরকে দেখা যায় এখান থেকে। এখানেও প্রাচীন দুর্গের ফাঁকে ফাঁকে নানাবর্ণের অর্কিডের মেলা।
এরপর নিশাত গার্ডেন এ ভিড়লো আমাদের ভাড়া করা টয়োটা-ইনোভা। যতটুকু জানি এটিই এই এলাকার সবচেয়ে বিলাসবহুল গাড়ি।
তিনদিক থেকে পর্বতে ঘেরা এই উদ্যানের আয়তন বিস্তীর্ণ। দুতিনশ বছরের বুড়ো মেপল ট্রি ও কৃত্রিম পানির ফোয়ারা এই গার্ডেনের সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে কয়েকগুণ। হজরতবাল মসজিদ আমাদের পরবর্তী গন্তব্য।
এরই মাঝে লাঞ্চ সারলাম বেশ নামী দামী একটি রেস্টুরেন্টে (বাজেটের কথা মাথায় রেখে শুধুমাত্র একবারের জন্যে)।
এরপর রওনা হলাম হযরতবাল মসজিদের উদ্দেশে। যেতে যেতে গাড়িতেই খানিকটা ঝিমাবার চেষ্টা করি, কিন্তু রসিক ড্রাইভারের উচ্চ-ভলিয়্যুমের অডিও আমার দিবানিদ্রার বারোটা বাজিয়ে দেয়। কারণ জিজ্ঞেস করলে জানায় সেও ঘুম তাড়াবার চেষ্টা করছে।
হাজার হাজার জালালী কবুতর আকাশ অন্ধকার করে উড়ছে। তার আড়াল থেকে দর্শন মিলল সুগম্ভীর হজরতবাল দরগা। এখানে হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর পবিত্র চুল সংরক্ষিত আছে যা মুঘল সম্রাট শাহজাহানের আমলে সৈয়দ আবদুল্লাহ সুদূর মদিনা শহর থেকে নিয়ে আসে ভারতবর্ষে।
মাজার দর্শন শেষে আমরা ফিরে চলি আমাদের হোটেলের দিকে। মাথার ওপরে তখন ঝুঁকে আছে সন্ধ্যাবেলা, নাগিন লেকে কৃত্রিম ফোয়ারার আলো আর দূরে দু’একটি দোকানের বিজ্ঞাপনের আলো জলের উপরিভাগে সৃষ্টি করছে লাল-নীল আভা- সেসব সৌন্দর্য মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে নামাঙ্কিত অস্তরাগে।
টেক্সিস্ট্যান্ডে ফিরেই পুরো ৪ দিনের কাশ্মিরের দর্শনীয় স্থানগুলো দেখার জন্যে একটি টেক্সি ঠিক করে হোটেলে ফিরেই চটজলদি ডিনার সেরে ঘুমিয়ে পড়ি।
পরদিন সকালে যথারীতি ভোর সাড়ে ৫টায় ঘুম ভাঙলো। ভোরবেলার শ্রীনগর দেখার প্রবল ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিতেই হাড় কাঁপানো শীতের মধ্যে একা একা বেরিয়ে আসি হোটেল রুম থেকে জগিংয়ের পোশাকে, অন্যসবাই তখনও গভীর ঘুমে। এই ভোরেও হোটেলের মেইন গেইট খোলা।
রহস্যটা উম্মোচিত হলো একটু পর— যখন আমি ডাল লেকে পাশে দিয়ে দৌঁড়তে শুরু করি। শত শত কাশ্মীরি হাঁটছে, দৌঁড়াচ্ছে ডাল-লেকের পাশ ধরে। কিছুক্ষণ দৌঁড়ানোর পর ঠাণ্ডা মোটামুটি সহনীয় হয়ে এলো। ডাল লেকের ঘাটগুলো নাম্বারিং করা। এই ভোরে সেইসব ঘাট স্বাস্থ্য -উদ্ধাররত কাশ্মীরিদের দখলে। উল্লেখযোগ্য, নিরাপত্তা ব্যবস্থা বিন্দুমাত্রও শিথিল নয় অপুষ্ট এই ভোরেও।
স্বচ্ছতোয়া ডাল লেকের অভ্যন্তরে প্রচুর জলজ উদ্ভিদ, ছোট-ছোট রূপোলি মাছ খেলছে গুল্মলতা ঘিরে। তুলতুলে ছোট ছোট বালিহাঁসের কয়েকটি ছানা জলকেলিরত। জুম লেন্স সঙ্গে না থাকায় মোটামুটি কাছে গিয়ে ছবি তুলবার জন্যে যেই ক্যামেরা তাক করেছি, অমনি তাদের দীর্ঘ ডুব সাতাঁর শুরু হয়ে গেল, এইখানে ডুব দেয় তো দূরে গিয়ে ভেসে ওঠে। শেষে ব্যর্থ হয়ে হোটেল রুমে ফিরে সবাইকে জাগিয়ে দিই। সবাই ফ্রেশ হয়ে দলবেঁধে মোড়ের ছোট্ট নাস্তার দোকানটিতে ছোলাবাটুয়া ও গরম পুরি সহকারে ব্রেকফাস্ট সেরে নিই। রুমে ফিরে সবাই তৈরি হয়ে নিলাম গুলমার্গ যাওয়ার জন্যে। ততক্ষণে আমাদের ড্রাইভার রিয়াজ ভাই আমাদের জন্যে বরাদ্দ টয়োটা-ইনোভা নিয়ে হাজির। শুরু হলো গুলমার্গ যাত্রা।
যেহেতু কলকাতা থেকে কেনা প্রিপেইড সিম কাশ্মীরে অচল, তাই রিয়াজ ভাই যোগাযোগের সুবিধার্থে তার একটি সিমকার্ড ধার দিয়েছিলেন। রিয়াজ ভাইকে ডানে-বামে ড্রাইভিং ডিরেকশন দিতেই তিনি অবাক বিস্ময়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন আমি আগে কাশ্মীর এসেছি কিনা। আমি তাকে আমার অ্যান্ড্রয়েড ফোনে গুগলের ডিরেকশন দেখালাম। বললাম দিন অনেক পাল্টে গেছে, এখন জায়গা না চিনলেও জিপিএস চিনিয়ে দেবে। অতএব নো চিন্তা।
কাশ্মীরে ভ্রমণার্থীদের জন্যে উদ্রেকের বিষয় হলো, পথে পথে টোল পরিশোধের ঝামেলা, যা গাড়ির যাত্রীকেই বহন করতে হয়। কোথাও একশ, কোথাও পঞ্চাশ, কোথাও বিশ রুপি দিয়ে তবে মুক্তি। এরকম প্রায় তিনটি ব্যারিকেড পেরিয়ে আমাদের ইনোভা পৌঁছালো গুলমার্গ জিপ স্ট্যান্ডে। গাড়ি পার্কিয়েও ১০০ রুপি!
গাড়ি থেকে নামতেই একদল ঘোড়াওয়ালা ঘিরে ধরে, গুলমার্গ ঘুরিয়ে দেখাবে আর যেহেতু গেন্ডোলা (রোপওয়ে-কার) বন্ধ তাই তারাই বরফের কাছে নিয়ে যাবে। আসার আগেই এই ঘোড়াওয়ালাদের প্রতারণার ঘটনা পড়েছিলাম, তাই ওদের কথায় কান দিলাম না। দু’জন কাশ্মীরি পুলিশ এগিয়ে এলে তাদের জিজ্ঞেস করি, সত্যি সত্যি গেন্ডোলা বন্ধ কি-না। ওরাও জানায়, রিপেয়ারিংয়ের জন্যে ফেইজ ওয়ান ও ফেইজ টু অভিমুখী গেন্ডোলাই বন্ধ। ভগ্নচিত্তে আমরা হাঁটতে শুরু করি, আর পেছন পেছন ঘোড়াওয়ালারা।
পরিস্থিতিটা অনেকটা এই রকম, আমরা ঘোড়া নিবো না, আর ওরা আমাদের ঘোড়ায় চড়িয়েই ছাড়বে। আমরা চুপচাপ হাঁটছি আর ওরা পেছন থেকে নানারকম মন্তব্য করছে …কতটুকু পায়ে হেঁটে যেতে পারো দেখা যাবে, কিছুই দেখতে পারবে না ইত্যাদি।
কিছুক্ষণ পর একজন ঘোড়াওয়ালা এক পুলিশকে নিয়ে এলো আমাদের বোঝাতে যে, হেঁটে হেঁটে গুলমার্গ দেখা যায় না। পুলিশটিও আমাদের ইনিয়ে-বিনিয়ে বোঝাতে লাগলো গুলমার্গ-দর্শনে ঘোড়ার গুরুত্ব। অবশেষে আমি ও নোমান দরদাম করতে শুরু করি, শুরুতে একটি ঘোড়া ৮০০ রুপি বললেও ১০০ রুপি দিতে রাজি হই। অনেক বাগ-বিতণ্ডার পর প্রতি ঘোড়া ২০০ রুপিতে রফা হলো শুধুমাত্র নারী ও শিশুদের জন্যে। আমি ও নোমান পায়ে হেঁটেই রওনা হই ওদের পিছুপিছু।
প্রথমে যাই চিলড্রেন পার্কে। গলফ-কোর্টের মতোই সবুজ ঘাসের বিস্তীর্ণ মাঠ, চারপাশে পাইন ট্রির নন্দিত শোভা, মধ্যখানে কৃত্রিম পাথুরে লেক। মাঠের মাঝে মাঝে বসবার জন্যে কারুকার্যশোভিত মেটাল বেঞ্চ।
বন্ধের দিন হওয়াতে মোটামুটি অনেক কাশ্মীরি পিকনিক পার্টি করতে ভিড় করেছে পরিবার-পরিজনসহ। সবার সঙ্গেই দুপুরের খাবার-দাবার, গ্যাস-স্টোভ ও পুরো গ্যাস-সিলেন্ডার (জীবনে এই প্রথম এমন ব্যবস্থা দেখলাম), পরে অবশ্য এর যথাযথ কারণটা অনুধাবন করি। এখানে এখন গড় তাপমাত্রা ১৫ থেকে ১৭ ডিগ্রি (দিনের বেলায়), তাই ঘর থেকে বানিয়ে আনা খাবার ঠাণ্ডায় জমে যাওয়া খুব স্বাভাবিক। এ কারণেই গ্যাস-স্টোভ ও সিলিন্ডার একমাত্র গরম খাবারের নিশ্চয়তা দিতে পারে। আমাদের পক্ষে তো বাংলাদেশ থেকে গ্যাসের চুলা বা সিলিন্ডার নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়, তাই বিস্কিট ও ঠাণ্ডা পানি সহযোগে আমাদের মিনি লাঞ্চ সেরে নিই পার্কে বসে।
কিছুক্ষণ পর দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর জন্যে রওনা দিই গেন্ডোলা স্টেশনের দিকে। চড়তে না পারি অন্তত স্টেশন আর কারগুলো দেখে আসি। গুলমার্গে অবস্থিত আর্মি ক্যাম্প ঘুরে স্টেশনে পৌঁছাতে পৌঁছাতে পার্শ্ববর্তী দেশ পাকিস্তান-বর্ডার সংলগ্ন পর্বতচূড়ায় অকস্মাৎ কালো মেঘের ঘনঘটা দেখা গেলো। জলবতী মেঘ, করাৎ-করাৎ শব্দে বাজ পড়ছে থেকে থেকে। আমরা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠি। কারণ এই ঠাণ্ডার মধ্যে যদি বৃষ্টিতে ভিজে যাই, তাহলে আমাদের শিশুদের তো বটেই, আমরা বয়স্করাও নিউমোনিয়ার আক্রমণ ঠেকাতে পারবো না। যেহেতু আমাদের সঙ্গে বাড়তি কোনো পোশাক নেই, তাই ঘোড়াওয়ালাদের বললাম তাড়াতাড়ি কোনো ছাউনির নিচে নিয়ে যাওয়ার জন্যে। তারা আমাদের আশ্বস্ত করলো এই বলে যে বৃষ্টি ঠিক ওই পর্বতমালার ওপরই ঝরবে, খোলা এই উপত্যকায় পড়বার সম্ভাবনা খুব কম। ঘোড়াওয়ালাদের ভবিষ্যতবাণী সত্যি হলো। জোরালো এক পশলা বিক্ষিপ্ত বৃষ্টি ধোঁয়াশাময় পর্বতগুলোকে মিনিট পাঁচেক ভিজিয়ে দিয়ে উধাও হয়ে গেল। শুকনো অবস্থাতেই আমরা গেন্ডোলা স্টেশনে পৌঁছলাম।
স্টেশনে পৌঁছে দেখি বিশাল লম্বা লাইন। ওরে বাবা! সবাই কি আমাদের মতো দুধের-স্বাদ ঘোলে মেটাতে এসেছে নাকি। স্টেশনের সিকিউরিটি গার্ডদের জিজ্ঞেস করতেই আসল সত্য বেরিয়ে এলো। ফার্স্ট-ফেইজে গেন্ডোলা ঠিকই চলছে, শুধুমাত্র মেন্টেনেন্সের জন্যে সেকেন্ড-ফেইজ বন্ধ।
প্রথমেই ধরলাম ঘোড়াওয়ালাদের আমাদের মিথ্যা তথ্য দিয়ে প্রতারণা করার জন্যে। আমাদের অভিযোগ তাদের কানে গেল কী-না ঠিক বোঝা গেল না। কারণ তখন তারা উদাস ভঙ্গিতে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। কি আর করা, নোমানকে পাঠালাম তাড়াতাড়ি টিকেট কিনতে। প্রতিটি টিকিট ৪০০ রুপি। টিকিট কেটে প্রায় ঘণ্টা-দেড়েক লাইনে দাঁড়ানোর পর আমাদের পালা এলো গেন্ডোলা চড়ে ফাস্ট-ফেইজ তথা খিলানমার্গের পর্বত চূড়ায় পৌঁছানোর। একেবারে খাড়া পর্বতের ঢালে পাইন গাছের ফাঁকে ফাঁকে রোপওয়ের টাওয়ার। ধীরে ধীরে রোপওয়ে উঠছে আমাদের নিয়ে, আর আমরা জীবনে প্রথমবার গেন্ডোলা চড়ার উত্তেজনায় রীতিমত লাফাতে লাগলাম, একটিমাত্র তারের ওপর ভাসমান এই যন্ত্রের পেটের মধ্যে বসে। সঙ্গে সঙ্গে সাটাসাট ছবি, ওর ছবি এ তোলা হচ্ছে, ডিজিটাল ক্যামেরার আদতই তো আলাদা! বিশ মিনিটের মাথায় পৌঁছে গেলাম খিলানমার্গে। গেন্ডোলা স্টেশন থেকে বেরুতেই প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো। এই ভরদুপুরে এখানকার তাপমাত্রা এখন মাত্র পাঁচ থেকে ছয় ডিগ্রি সেলসিয়াস। রাতে না জানি কি অবস্থা দাঁড়ায়!
আমাদের লাইট লাঞ্চ অনেক আগেই হজম, খিদেয় সবার পেটে ছুঁচো ডন মারছে। তাই যেমন হোক, কারো জন্যে নুডুলস, কারো জন্যে ফ্রাইড রাইসের অর্ডার দিই এক ভাসমান হোটেলে। প্রচণ্ড ঠাণ্ডা তাই একেবারে চুলো থেকেই সরবরাহ হচ্ছে আমাদের আইটেম।
খাওয়াদাওয়া সেরে একটু বিশ্রাম নিয়ে খিলান মার্গের নৈসর্গিক দৃশ্য দেখা এবং সমান তালে চললো ছবি তোলা। এর মাঝেই পরিচয় হলআ কিছু কাশ্মীরি যুবকের সঙ্গে।
কাশ্মীরের আবহাওয়া সম্পর্কে একটি সম্যক ধারণা পাই এসব যুবকের কাছ থেকে। চির শীতের রাজ্যখ্যাত খোদ কাশ্মীরেই নাকি এমন জায়গা আছে যেখানের গড় তাপমাত্রা ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস!
খিলানমার্গ থেকে ফিরতে ফিরতে হঠাৎ নেমে আসা পাহাড়ি সন্ধ্যা আমাদের পেয়ে বসলো। অন্ধকারের সঙ্গে ঠাণ্ডাও চেপে আসছে সমান তালে।
রিয়াজ ভাইকে বললাম তাড়াতাড়ি গাড়ি নিয়ে আসতে। আপেলের ভরা মৌসুম এখন। গুলমার্গ থেকে ফেরার পথে পার্শ্ববর্তী বাগান থেকে প্রায় পঁচিশ-কেজি ওজনের একপেটি আপেল কিনে নিলাম মাত্র ২০০ রুপিতে।
রাত ৮টার দিকে শ্রীনগর শহরে পৌঁছে প্রথমেই রেস্টুরেন্ট-করিমসে কাশ্মীরি বিরিয়ানি নামে অখাদ্য খেলাম। কেউ যেন ভুলেও এই রেস্টুরেন্টে না ঢোকে!
ইতোমধ্যে গাড়ি ছেড়ে দিয়েছি। তাই পায়ে হেঁটেই হোটেলে ফিরি। ফিরে সবাই সোজা বিছানায়, পরদিনের গন্তব্য সোনমার্গ।
কাশ্মীর মানেই তো বরফ রাজ্য, এতো বছর শুধুমাত্র তুষার-আবৃত কাশ্মীরের বিভিন্ন ছবি দেখে এমন ধারণা জন্মে গিয়েছিল আমাদের সবার।
কিন্তু বরফ, তুষারপাত কই, আমাদের তো মাথা খারাপ অবস্থা। আজ আমরা সোনমার্গ যাবো। যতটুকু জেনেছি তাতে এই ভর-গ্রীষ্মে শুধুমাত্র সোনমার্গের গ্লেসিয়ারগুলোই বরফে আবৃত থাকে।
ড্রাইভার রিয়াজ ভাই নির্দিষ্ট সময়েই হোটেল থেকে তুলে নিলেন আমাদের। ডাল লেক, নাগিন লেক হয়ে গাড়ি ঘুরে সোজা ঢুকে গেলো বিস্তীর্ণ ধানক্ষেত সমৃদ্ধ কাশ্মীরের গ্রামীণ এলাকায়।
সোনালি পটভূমিকায় ধূসর পাথরের গা ও সবুজ অ্যাসবেসটসে ছাওয়া ঘর, পাইনে ঘেরা গ্রামগুলোকে দেখতে অনেকটা তৈলচিত্রের মতো।
শ্রীনগর থেকে সোনমার্গের দূরত্ব প্রায় ৮০ কিলোমিটার, কিন্তু বিপদসঙ্কুল পাহাড়ি রাস্তা হওয়াতে এই দূরত্ব পেরুতেই প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা লেগে যায়।
গাড়ি সোনমার্গ পার্কিং পয়েন্টে পৌঁছে ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটলো। অর্থাৎ যথারীতি ঘোড়াওয়ালাদের অত্যাচার, এরসঙ্গে যুক্ত হলো আরেক সমস্যা! সোনমার্গ লোকাল ভিউ দেখতে হলে সোনমার্গের বাইরে থেকে আসা কোনো গাড়িকে যেতে দেওয়া হয় না। ভাড়া করতে হবে লক্কর-ঝক্কর মার্কা টাটাসুমো।
গ্লেসিয়ারের দূরত্ব কতটুকু জানতাম না, তাই এবারও ধরা খেলাম। আসা যাওয়া মাত্র ৬ কিলোমিটার পথের জন্যে দু’হাজার রুপি গুণতে হলো। অচিন দেশ, কী আর করা!
সোনমার্গ ভ্যালিতে পৌঁছে আবারও ঘোড়াওয়ালা! এ যেন ঘোড়াওয়ালাদেরই রাজ্য। মেজাজটা এমনিতেও খিঁচড়ে ছিল, তাই দু’একজনকে হালকা ধমক লাগাতেই পথ ছেড়ে দিলো বটে, কিন্তু পেছন থেকে ঠিকই টিটকারি দিতে থাকলো এই বলে যে- হেঁটে গেলে জীবনেও বরফের দেখা পাবে না।
কিছুক্ষণ পর তাদের ভবিষ্যত বাণীকে বিফল প্রমাণিত করে দেখা মিলল প্রত্যাশিত তুষার-ছাওয়া পর্বত চূড়ার, তবে অনেক উঁচুতে এবং সীমিতই রইল তা।
গলিত বরফের হিমশীতল জল নেমে এসে সোনমার্গ ভ্যালিতে সৃষ্টি করেছে পাথুরে ছড়ার, কলকল ধ্বনিতে বইছে সে বিশুদ্ধ জলের ধারা। সবাই জুতো খুলে নেমে গেলাম তাতে, তবে কয়েক মুহূর্তের জন্যে। কেননা জল এতোটাই ঠাণ্ডা যে দশ-পনের সেকেন্ডের বেশি থাকা সম্ভব না। খাওয়ার পানি বোতলে ভরে সঙ্গে থাকা বিস্কুট ও জেলি সহযোগে সবাই হাল্কা নাস্তাও সেরে নিই। এখানেও অক্সিজেনের ঘাটতি আছে বটে।
সুদূর এই ঝরনাজলের ওপর নির্মিত দৃষ্টি-নন্দন কাঠের সেতুতে বসে পাওয়া যায় স্বর্গীয় অনুভূতি। পাশাপাশি চলছে ছবি তোলার কাজ, এমন সময় এলো জিরো পয়েন্ট যাওয়ার প্রস্তাব।
ড্রাইভাররা যা বললো তাতে, এখন রওনা হলে শেষ বিকাল নাগাদ ফেরা সম্ভব। কেমন যেন অবিশ্বাস্য লাগলো, কারগিল এতো কাছে! হাতের অ্যান্ড্রয়েডের মাধ্যমে গুগলে সার্চ দিলাম, সর্বনাশ!
সোনমার্গ থেকে বরফাবৃত জিরো পয়েন্টের ট্রাভেল ডিসটেন্স ১ হাজার ৬৭৪ কিলোমিটার। ভয়ঙ্কর দুর্গম এই পথে যাওয়াতেই শুধুমাত্র ২১ ঘণ্টা লাগবে। আর কারগিল গেলে জিরো পয়েন্টে দুরত্ব ১ হাজার ৮১৩ কিলোমিটার।
অন্তরের অন্তস্থল থেকে গুগলকে আবারো ধন্যবাদ জানাই সুবিশাল এই প্রতারণা থেকে পরিত্রাণ পেয়ে। পরিত্রাণায় সাধুনাং…
পাহাড়ের কোল ঘেঁষেই ঝরনা জলবাহী পাথুরে নদী সিন্দ, তার পাশেই নয়নাভিরাম সোনমার্গ রিসোর্ট। এখানে ঘাসের লনও গলফ-কোর্টের মতো সবুজাভ, আশপাশে নানারঙের দুষ্প্রাপ্য অর্কিডের বাগান এক কথায় অনন্য।
রিসোর্ট সংলগ্ন রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ সারি কাশ্মিরি মসলাসমৃদ্ধ ঝালমুরগি ও ফ্রাইড রাইস দিয়ে। খেয়ে অনিন্দ্য-সুন্দর সোনমার্গ-ভ্যালির লনের বিছানো বেঞ্চে বসে রোদ-পোহাই আর ছবি তুলি ইচ্ছে মতো।
জায়গাটা আমাদের এতোই ভালো লাগলো যে একরাত ওখানে থাকার ইচ্ছে প্রকাশ করে সবাই। তাতে হোটেলে গিয়ে রুমের জন্যে দরদামও করে ফেলি।
কিন্তু আমাদের সীমিত বাজেটে একই দিনে দুটো হোটেল রেস্টুরেন্টের ভাড়া বহন করা বেশ দুরূহ। তাই শেষে আবার কোনোদিন আসবো- মনকে এমন বুঝিয়ে সোনমার্গে থাকার পরিকল্পনা এবারের মতো বাদই দিই।
আমরা চলছি শ্রীনগরের দিকে, আমাদের পাশাপাশি চলছে বরফগলা উত্তাল সিন্দ নদীও। মাঝপথে দেখা মিললো নদীর ওপারে ম্যাপল গাছে ছাওয়া আরেকটি উদ্যানের, এটিও একটি চিলড্রেন পার্ক।
মাথাপিছু ১০ টাকা খরচা করে তাতে ঢুকে পড়ি সবাই সবাই। মাথাব্যথা করছিল সবার, তাই অনেকটা চড়া দাম দিয়েই পাইন-ম্যাপলে ঘেরা গাঢ় এই সবুজে বসে চা খেয়ে নিই। আমাদের শিশুরা পার্কে আগত অন্যান্য শিশুদের সঙ্গে খেলতে শুরু করে।
এখানে ঘণ্টাখানেক কাটানোর পর রওনা হই শ্রীনগরের উদ্দেশে। শহরে যখন ঢুকি, তখন আকাশ প্রদীপ পুরোপুরি নিভে গেছে।
যুসমার্গে আমাদের অভিযানটা তেমন সুখের হলো না। যতটুকু বুঝতে পারলাম, তুষারপাতের সময়টায় এ অঞ্চল আরো বেশি আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে।
চিরাচরিত কাশ্মীরের গাঢ় সবুজ রূপ, বিস্তীর্ণ ঘাসের লন ও পাইনের সমারোহ। একে তো অফ সিজন, তার ওপর সহিংসতার কারণে যুসমার্গ এখন বলতে গেলে পর্যটক শূন্য।
ফলে এখানকার ঘোড়াওয়ালাদের অবস্থাও ত্রাহি ত্রাহি। এখনকার দ্রষ্টব্য স্থান দুধগঙ্গা দেখার জন্যে ঘোড়ায় চড়ার হাজারো হাঁক-ডাক উপেক্ষা করে হেঁটেই রওনা দিই।
একটু তফাতে সবার পেছনে আমি। এক বুড়ো ঘোড়াওয়ালা তার ঘোড়াটি নেওয়ার জন্যে তার ঘোড়া নিয়ে অনুনয় করতে থাকে, গত কয়েকদিন সে একজন পর্যটকও পায়নি। ভাড়া হিসেবে আমার যা খুশি তা দিলেই চলবে। এখানের ঘোড়াওয়ালাদের মধ্যে উনিই সবচেয়ে বৃদ্ধ। মনটা নরম হয়ে গেল, চেপে বসলাম তার ঘোড়াতে।
এদিকে আমার দেখাদেখি আমার স্ত্রীকেও উঠিয়ে নিলো বুড়োর নাতি তার ঘোড়াতে। যেহেতু আমাদের যা খুশি তাই ভাড়া দিতে হবে তাই কিছুদূর গিয়ে নোমানদেরও তুলে দিলাম অন্য চারটি ঘোড়ায়।
সাতটি ঘোড়া টগবগিয়ে চললো কথিত দুধগঙ্গার উদ্দেশে…।
মাইলটাক যাওয়ার পরই শুরু হলো আসল বিপদ! পাহাড়ের খাড়া গিরিখাত ধরে নামতে শুরু করলো আমাদের ঘোড়াগুলো, আলগা পাথুরে পথ খানাখন্দে ভরপুর।