লিয়াকত হোসেন খোকন
ভৈরবের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে মেঘনা নদী। এখানেই লঞ্চঘাট থেকে লঞ্চ ছেড়ে যায় আশুগঞ্জ, রাজাপুর, চাতালপাড়, বাঙালপাড়া, গোয়ালনগর, ইসলামপুর, শিবপুর, আবদুল্লাপুর হয়ে হবিগঞ্জের আজমিরিগঞ্জে। লঞ্চঘাটে এসে ভাবলাম, লঞ্চে গিয়ে লাভ নেই। এবারের ভ্রমণে আমার সঙ্গে আরও দু’জন সঙ্গী ছিলো। তরুণ বয়সের একটি ছেলে পাশে এসে দাঁড়ালো। কি চিনতে পারছেন তো, আমি যে সেই জাভেদ। ওই যে ঢাকায় থাকাকালীন সময়ে পরিচয় হয়েছিলো। এখন তো দূরে অনেক দূরে নৌকা নিয়ে চলে যাই। এই মেঘনায় বেড়ালে একবার ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার দিকে নিয়ে যাবো, আবার নিয়ে আসবো কিশোরগঞ্জ জেলার দিকে। নদীর পূর্বপাড়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া আর হবিগঞ্জ জেলা। আর পশ্চিমে কিশোরগঞ্জ জেলা…। চলুন মেঘনায় বেড়াবেন।
জাভেদকে চিনতে অসুবিধা হলো না। ‘চলুন, ওই সামনেই ঘাটে বাঁধা আছে নৌকো। আপনাদের পছন্দের জায়গাগুলো ঘুরিয়ে দেখাবো। যেখানে খুশি সেখানে নামবেন…।’ জাভেদের নৌকো দেখে পছন্দ হয়ে গেলো। জাভেদের সহকর্মী শৈলেন আমার হাতটা স্পর্শ করে বললো, উঠুন…। দেখি নৌকোর উপরে বাঁশ ও গোলপাতা দিয়ে ছাওয়া-বরষা এলেও কোনো সমস্যা হবে না। সফরসঙ্গী ইউসুফ বললো, এই নৌকোয় চড়লে নদীর একূল ওকূল দেখা হবে। আর জাভেদ বললো, আজমিরিগঞ্জ পর্যন্ত নিয়ে যাবো। বললাম, আসা-যাওয়ায় তা কত ভাড়া নেবে? ও বললো, আরে উঠুনতো ভাড়া নিয়ে ঠেকবে না-খুশি হয়ে যা দেবেন তাতেই চলবে। আপনিতো আমার কাছের মানুষ।
মনে মনে ভাবলাম, জাভেদকে সেই কবে দেখেছি ঢাকার কিশোরগঞ্জ মেডিকেল সেন্টারে সেখান থেকেই ঘনিষ্ঠতা—যাক ভালোই হলো।
জাভেদ বললো, চাল, ডাল, তরিতরকারি, মাছ কেনার টাকা দিন…। এই শৈলেন এদিকে আয়, যা টাকা নিয়ে সদাইপাতি কিনে নিয়ে আয়। জানেন, ওই শৈলেন ছেলেটা ভালোই রান্না করে।
ইউসুফের জিজ্ঞাসা, নৌকোয় বাথরুমের ব্যবস্থা আছে তো? জাভেদ বললো, সব ব্যবস্থা আছে, নো চিন্তা ডু ফুর্তি। তখন ইউসুফের মুখে হাসি ফুটে উঠলো।
সকাল সাড়ে ১০টার দিকে নৌকো ছেড়ে দিলো। পেছনে দেখছি ভৈরব ব্রিজ। ইঞ্জিনচালিত নৌকো চলছে, জাভেদ বললো, রাজুর খবর জানেন! ছেলেটা ওর মনের মানুষটির সঙ্গে এখন আর দেখা সাক্ষাত্ করে না। কি আর বলবো, রাজুটা যেনো কেমন হয়ে গেলো। দুপুর ২টার দিকে নৌকো এলো অষ্টগ্রামের বাঙালপাড়ার কাছে। দেখি, ওই দূরে ভাসছে গাছগাছালি। শুধুই দেখা যাচ্ছে জলে শাপলা ফুল ফুটে আছে—হিজল গাছও চোখে পড়লো। অথৈ পানি আর পানি-মনে হয় মেঘনা যেনো মিশেছে হাওরের সঙ্গে। জাভেদ বললো, বাঙালপাড়ায় আছে ছোট একটি গাঁও নাম হায়দারাবাদ কলিমপুর। এখানে বটগাছ ছাড়া চোখে পড়লো কাশবন। আহা বাতাসে যেনো ঢেউ খেলে যায় এই কাশবন। একটু এগিয়ে মন্দিরের কাছে আসতেই দেখা হয়ে গেলো এক যুবকের সঙ্গে। মনে হলো, চিনি আমি তারে খুব করে চিনি…। ‘নমস্কার’ জানিয়ে মুখটা একটু বাঁকা করে সে বললো, দাদা কেমন আছেন? বললাম, তা ভালো আছি। রামদা আপনি কেমন আছেন? বললো, শালীর বিয়ে তাই আসতেই যে হলো। তাছাড়া ঢাকার রূপনগরের কিশোরগঞ্জ মেডিকেল সেন্টারের চাকরি নেয়ার আগে শর্ত ছিল, আমি যে বিবাহিত তাই তিন মাস পর পর ছুটি দিতে হবে। দাদা, জানেন আমার স্যার আশরাফ ডাক্তার সাহেব খুব ভালো মানুষ। তার যে কোনো তুলনাই হয় না।
রাম তার বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য বেশ মিনতি জানালো। সে অনুরোধ রক্ষা করা সম্ভব হলো না ইউসুফের জন্য। বললো, স্যার জলদি চলুন…নৌকোয় বসে বসে মেঘনা নদীকেই যে দেখবো। নৌকোয় ফিরে এসে দুপুরের খাওয়াটা সেরে নিলাম। এবার তিনজনে পাশাপাশি শুয়ে আছি। হঠাত্ আকাশে বিদ্যুত্ চমকাতে চমকাতে বৃষ্টি নেমে এলো। মিনিট পনেরো পর বৃষ্টি থেমে যেতেই দেখি নৌকো মেঘনার পূর্বপাড়ে তীর ঘেঁষে চলছে। চোখে পড়লো বটগাছ, হিজলগাছ, কাশবন…। ইউসুফ বললো, ‘কবিতার কয়েক লাইন শুনুন—‘অই নদী মনোহরা গোলাপের গন্ধে ভরা, ঘুঘুগুলি চরে তার সুশ্যামল তটে। বায়ু বহে ঝুর ঝুর, শ্যামা গায় সুমধুর ত্রিদিবের হুরপরি খেলা করে মাঠে…।’ বলুনতো এ কবিতাটা কার লেখা? কারও মনে আসছিল না কবি ও কবিতার নাম। ইউসুফ বললো, এক সপ্তাহ সময় দিলাম, বলতে পারলে ৫০০ টাকা দিবো।
নদীতে শাপলা ফুলের ছড়াছড়ি আর তো টগর—এসবের মধ্যে দিয়ে নৌকো অনেকটা ধীর গতিতে তীরে ভিড়ায়ে জাভেদ বললো, এই হলো গোয়ালনগর এখানে নামুন। একটু এগিয়ে গেলেই দেখবেন লালুয়ারটুক গাঁও। ওখানে প্রায় বাড়িতেই রয়েছে ফুলের বাগান। লালুয়ার টুকে এসে মনে হলো, এ যে শ্যামল গাঁও-রূপের যে এর নেই তুলনা। বকুল তলে বসে আছে ষোলো বছর বয়সী একটি মেয়ে। শুধু কী বসে, দেখি আপন মনে গেঁথে যাচ্ছে মালা। তখন মনে পড়লো, ‘যে মাধবীতলে দাঁড়ায়ে বলেছিলে ভালোবাসি আজও লতায় ফুল ফোটে…’ গানের এ কথাগুলো। ‘এই মেয়ে তোমার নাম কী?’ একটু হেসে নামটি আমার সুমী। তবে বলতে পারেন ‘বনফুল’। কেননা, গাঁয়ে থাকি তাই নারী প্রগতির আবহাওয়ার কোনো সংবাদই যে রাখি না।
ফিরে এলাম মেঘনার কূলে। জাভেদ বললো, কেমন লাগলো লালুয়ারটুক গাঁও খানি। একটু হেসে ইউসুফ বড্ড সুন্দর গাঁও। নদীর তীর ঘেষে চলছে নৌকো। কাশবন দেখে মনে হলো, বাহ! কতই না মনোরম মেঘনার কূল। আর নদীতে রয়েছে টগর আর শাপলা। সন্ধ্যা নেমে এসেছে তবুও কিশোর বয়সের ছেলেরা দুষ্টামিতে মেতে আছে। কেউ ডিঙ্গি নৌকো বাইছে, আবার কেউবা মেঘনার কূলে ছুটোছুটি করছে। ডিঙ্গিতে বসে শাপলা ফুল হাতে নিয়ে এক কিশোর গান ধরলো, ‘ও কইন্যা শুনি যাও মোর পানে ফিরিয়া চাও…।’ বললাম, এই দুষ্ট ছেলে, তোমার কইন্যা কোথায়? কথাটা শুনে কিশোর ছেলেটি বড্ড লজ্জা পেলো। নৌকো চলছে। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হতে লাগলো। জাভেদ বললো, রাত ১০টা বেজে যাবে আজমেরিগঞ্জ পৌঁছতে। আকাশে চাঁদ তাই দেখতে পাচ্ছি দূরে বটগাছ হিজলগাছ ছোটো ছোটো নৌকায় দাঁড়িয়ে জেলেরা জাল ফেলে মাছ ধরায় ব্যস্ত। জাভেদ জানালো, এই মেঘনায় মেলে পুঁটি, শিয়ালপুঁটি, বাইম, চাপিলা, গোমা, বাছা, চিংড়ি, কালবাউশ আরও কত কি মাছ। রাত ১০টায় এসে পৌঁছালাম আজমেরিগঞ্জে। ইউসুফ বললো, বাহ! এখন তো আমরা হবিগঞ্জ জেলায়। পায়ে হেঁটে এলাম বাজারে, দেখি মিষ্টির দোকান। কালোজাম দেখে লোভ সামলাতে পারলাম না। খেয়ে নিলাম আমরা তিনজনে দুটো করে। জাভেদ ও শৈলেন খেলো রসগোল্লা। জাভেদ বললো, এই শৈলেন হলো রামের ভাতিজা। নৌকায় ফিরে এলাম। রাতে খেলাম কই মাছ দিয়ে। জাভেদ বললো, রাত এগারোটা বেজে গেছে, এখন ঘুমান। ভোর ৪টায় নৌকো ছেড়ে দেবো। তবে সকাল ১১টায় গিয়ে ভৈরবে ফিরে যেতে পারবো। ঘুমিয়ে পড়তে সময় লাগলো না। ঘুম থেকে উঠতে প্রায় ১০টা বেজে গেলো। দেখি ওই যে ভৈরব ব্রিজ। ইউসুফ বললো, স্যার মেঘনায় আরেকটা দিন বেড়ালে কী ভালো হতো না? ওর কথাটা শুনে সজীব বললো, আবার না হয় আসবো এই মেঘনায়…।
মেঘনায় বেড়াতে আমাদের খরচ পড়েছিল জনপ্রতি ৩ হাজার টাকা করে। নৌকো চালক জাভেদকে দিতে হলো, ২ হাজার টাকা। বাদবাকি খরচ ছিল ঢাকা থেকে ভৈরবে আসা-যাওয়া, খাওয়া-দাওয়াসহ অন্যান্য খরচ। তবে কেউ যদি ভৈরব থেকে লঞ্চে আজমিরিগঞ্জ যেতে চান সে সুযোগও রয়েছে। ভৈরব থেকে লঞ্চ ছাড়ে রাত ৩টায়, সকাল ১০টায়, বিকাল ৩টায়। লঞ্চে আজমিরিগঞ্জ পৌঁছতে প্রায় ৭ ঘণ্টা সময় লাগে। জনপ্রতি ভাড়া ১২০ টাকা। লঞ্চের নাম -বিপাশা, আবদুল্লাপুর।