আযাদ আলাউদ্দীন
মেঘনা তেঁতুলিয়ার সিক্ত লোনা জলে গড়ে ওঠা দ্বীপ জেলা ভোলার প্রাচীনতম নিদর্শনগুলোর অন্যতম স্থাপত্য শিল্প হলো ‘হায়দার মহল’।
ভোলা-চরফ্যাশন সড়কের তীর ঘেঁষে বোরহানউদ্দিন উপজেলার মানিকার হাটের পাশেই হায়দার মহলের অবস্থান। ভোলা দ্বীপের গোড়াপত্তনের সময় থেকেই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ এখানে এসে বসতি গড়ে তোলে। তারই ধারাবাহিকতায় কুমিল্লার জনৈক ইজ্জত উল্লাহ আকন ভোলার স্থানীয় খায়রুল্লাহ বিশ্বাসের মেয়েকে বিয়ে করে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। তার একমাত্র ছেলে রিয়াজ উদ্দিন আকন তৎকালীন জমিদার তারা প্রসন্ন ভট্টাচার্যের জমিদারি দেখাশোনার দায়িত্ব পান। একসময় তিনি প্রচুর জমি ও অর্থ সম্পদের মালিক হয়ে যান। এ অঞ্চলের বৃদ্ধাদের মুখে গুঞ্জন শুনা যায়, তিনি নাকি মাটির নিচে কলসি ভর্তি কিছু কাঁচা টাকা পান। সে যাই হোক, অল্প দিনের মধ্যেই তিনি ‘জমিদার’ হিসেবে খ্যাতি পান। তার ছেলেই হায়দার আলী। যার নামে ‘হায়দার মহল’।
১১৫৫ বঙ্গাব্দে হায়দার মহলের মূল ভবন নির্মাণ শেষ হয়। এই হায়দার মহলের মূল ভবন ছাড়াও পেছনের দিকে একতলা আরো চারটি ভবন রয়েছে। এ ভবনগুলো তৈরিতে বালু ও সিমেন্টের পরিবর্তে ব্যয়বহুল চুনা ও সুরকি ব্যবহৃত হয়েছে। প্রতিটি দেয়াল দেড় হাত পুরু। বিল্ডিং নির্মাণের সময় ভিম হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে উন্নতমানের শাল কাঠ- যা তিন-চার শ’ বছর পর এখনো অক্ষত। মূল ভবনের তৃতীয়তলা নির্মাণ করা হয় বাংলা ১৩৫১ সনে। হায়দার আলী মিয়া বাড়ির আয়তন সর্বমোট ১১৪ একর ২২ শতাংশ। সেকালে পর্তুগিজ জলদস্যুদের আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য এই বাড়ির চার দিকে দেয়াল নির্মাণ করে বেষ্টনী তৈরি করা হয়েছিল।
এই বেষ্টনীর দৈর্ঘ্য ছিল প্রায় এক মাইল। হায়দার মহলের মূল গেটে দারোয়ান হিসেবে কর্মরত ছিল এক নেপালি গুর্খা সৈন্য। সে সময় অসংখ্য চাকর-বাকর এই জমিদার বাড়িতে কাজ করত। দূর-দূরান্ত থেকে মুসাফিররা এসে এ বাড়ির কাচারিতে আশ্রয় নিতো। মুসাফিরদের জন্য খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা ছিল।
এই বাড়িতে একটি বিশাল আকৃতির দীঘিসহ পুকুর সংখ্যা প্রায় ২৫টি। সে সময় এ বাড়ির জমিদাররা শখ হিসেবে হরিণ, ময়ূর, বাঘসহ বিভিন্ন আকর্ষণীয় প্রাণী পুষত। কালের সাক্ষী হিসেবে আজো ওই হায়দার মহলে বিশাল আকৃতির হরিণের শিং, ময়ূরের পালক, বাঘের চমড়াসহ নানা রকম ঐতিহ্য ওই বাড়িতে সংরক্ষিত আছে। এছাড়াও কিছু কিছু ঐতিহ্য জাতীয় জাদুঘরে শোভা পেয়েছে।
সাংবাদিক শিমুল চৌধুরীসহ এ প্রতিবেদক ‘হায়দার মহল’ পরিদর্শনকালে ওই বাড়ির কৃতী সন্তান রাশেদ হায়দার, সংবাদিকদের বিভিন্ন স্থাপত্য নিদর্শনগুলো ঘুরে ঘুরে দেখান। হায়দার মহলের তৃতীয়তলা পরিদর্শনকালে দেখা যায়, কয়েক শ’ বছরের প্রাচীন এ ভবনের প্রতিটি দেয়াল আজো অক্ষত। শুধু কয়েক স্থানে শ্যাওলা জমে আগাছার সৃষ্টি হয়েছে।
হায়দার মহলের সম্মুখস্থ দক্ষিণ পাশে রয়েছে ফুলের বাগান, দরজায় রয়েছে দৃষ্টিনন্দন মসজিদ, সুপ্রাচীন প্রাথমিক বিদ্যালয়, সাইক্লোন সেন্টার, ঈদগাহ মাঠসহ বাড়ির ভেতরে অসংখ্য গাছ-গাছালি। এক সময় এ বাড়ির জমিদারদের সম্মানে স্থানীয় লোকজন এ বাড়ির দরজা দিয়ে জুতা পায়ে কিংবা ছাতা মাথায় যাওয়ার সাহস করত না।
বাংলা বছরের নির্দিষ্ট দিনে এ বাড়ির জমিদারদের খাজনা দেয়ার জন্য নির্দিষ্ট তারিখে প্রজা সাধারণ এসে জমায়েত হতো ‘পুন্যাহ’ অনুষ্ঠানে। তখন প্রজাদের জন্য ধুম ধারাক্কা খাওয়ার আয়োজন হতো। বাড়ির দরজায় যাত্রা, নাটক, জারিগান, কবিগান আর পালাগানের আসর বসত। ডাক ও খনার বচন খইয়ের মতো ফুটত প্রজাকুলের মুখে মুখে।
লেখক : সাংবাদিক, একটি জাতীয় দৈনিকের বরিশাল ব্যুরো প্রধান।