Skip to content

ভ্রমণপিপাসুদের নতুন গন্তব্য মিয়ানমার

Myanmar-Tourism2

মোস্তাফিজুর রহমান
দক্ষিণ এশিয়ার সামরিক শাসন থেকে সদ্য মুক্ত হওয়া দেশ মিয়ানমার। মোট আয়তন ছয় লাখ ৭৬ হাজার ৫৫২ বর্গকিলোমিটার। উত্তর-দক্ষিণ এর দৈর্ঘ্য প্রায় দুই হাজার ৮৫ কিলোমিটার। সর্বপশ্চিমে এর সর্বোচ্চ বিস্তার প্রায় ৯৩০ কিলোমিটার। উপকূলীয় এলাকাটি নিম্ন মিয়ানমার ও অভ্যন্তরীণ অংশটি ঊর্ধ্ব মিয়ানমার নামে পরিচিত। অশ্বখুরাকৃতি পর্বতব্যবস্থা ও ইরাবতী নদীর উপত্যকা দেশটির ভূ-সংস্থানের প্রধান বৈশিষ্ট্য। উত্তরের পর্বতগুলোর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ হকাকাবো রাজির উচ্চতা ৫ হাজার ৮৮১ মিটার। এটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সর্বোচ্চ শৃঙ্গ। আরো দু’টি পর্বতব্যবস্থা উত্তর থেকে দক্ষিণ বিস্তৃত। আরাকান ইয়োমা পর্বতমালাটি মিয়ানমার ও ভারতীয় উপমহাদেশের মধ্যে একটি প্রাচীরের সৃষ্টি করেছে। এর পর্বতগুলোর উচ্চতা প্রধানত ৯১৫ মিটার থেকে এক হাজার ৫২৫ মিটার পর্যন্ত। অন্য দিকে শান মালভূমি থেকে বিলাউকতাউং পর্বতশ্রেণীটি প্রসারিত হয়ে দক্ষিণ-পূর্ব নিম্ন মিয়ানমার ও দক্ষিণ-পশ্চিম থাইল্যান্ডের সীমান্ত বরাবর চলে গেছে। শান মালভূমিটি চীন থেকে প্রসারিত হয়েছে। এর গড় উচ্চতা প্রায় এক হাজার ২১৫ মিটার। মিয়ানমারের অভ্যন্তরভাগে কেন্দ্রীয় নিম্নভূমিগুলো মূলত সরু ও দীর্ঘ। এগুলো ইরাবতী-সিত্তাং নদীর ব-দ্বীপ এলাকায় প্রায় ৩২০ কিলোমিটার প্রশস্ত। এ ব-দ্বীপীয় সমভূমিগুলো অত্যন্ত উর্বর ও দেশের সবচেয়ে অর্থনৈতিক গুরুত্ববিশিষ্ট অঞ্চল। এর মোট আয়তন প্রায় ৪৭ হাজার বর্গকিলোমিটার। মিয়ানমারের উত্তর-পশ্চিমের আরাকান উপকূল ও দক্ষিণ-পশ্চিমের তেনাসসেরিম উপকূল উভয়েই শিলাময় এবং এগুলোর কাছে অনেক দ্বীপ অবস্থিত। মিয়ানমারে বেশ কিছু উৎকৃষ্ট প্রাকৃতিক পোতাশ্রয় আছে।

মিয়ানমারের প্রাচীন নাম বার্মা। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রাকৃতিক স্বর্গীয় দেশ। প্রাচীন ঐতিহ্য আর সংস্কৃতিতে লালিত মিয়ানমার সত্যিই অদ্ভুত। দেশটির প্রকৃতির রূপ আর অত্যাশ্চর্য সব প্যাগোডা ভিনদেশি পর্যটকদের প্রধান আকর্ষণ। উন্নত নাগরিক সভ্যতার মাঝেও এখানে মিলবে সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের এক বিরাট অনুভূতি।

প্রশস্ত হ্র্রদ, সবুজ পার্ক, নীল পানির সাগর, শ্যামল ক্রান্তীয় বন, সুবিশাল পাহাড় আর অত্যাশ্চর্য সব ঐতিহাসিক প্যাগোডা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মিয়ানমারের প্রতিটি পরতে পরতে। এখানকার শিল্পীদের ঐতিহ্যবাহী নাচ আর ‘রয়্যাল কারাউইক প্যালেসের’ রাতের খাবার বেশ উপভোগ্য।

Myanmar-Tourism3

রাজনৈতিক ও জাতিগত নানা-টানাপোড়েনে এতদিন পর্যটকরা মিয়ানমার বিমুখ ছিলেন। তবে দিন পাল্টেছে। এখন পর্যটকদের আগ্রহের জায়গায় পরিণত হয়েছে মিয়ানমার।

সম্প্রতি দেশটির সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোও পর্যটকদের বিষয়ে ইতিবাচক নানা সিদ্ধান্ত নিচ্ছে।

খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে মিয়ানমারের সড়ক ও অবকাঠামোগত যে উন্নয়ন হয়েছে তা সত্যি অবাক করার মতো। ইয়াঙ্গুন ও আশেপাশে গড়ে উঠছে বেশ কয়েকটি পাঁচতারকা হোটেল।

মিয়ানমার ভ্রমণে এশিয়া ও ইউরোপের পর্যটকদের ভিড় দিন দিন বাড়ছে। ২০১৩ সাল থেকে প্রতি বছর গড়ে ১০ লাখ হারে পর্যটক বাড়ছে দেশটিতে। এর একটি বড় অংশ যাচ্ছে বাংলাদেশ থেকে। পর্যটক বৃদ্ধির এই হার অব্যাহত থাকলে শিগগিরই দেশটি এশিয়ার অন্যতম পর্যটনের দেশ হিসেবে পরিচিতি পাবে বলে ধারনা বিশেষজ্ঞদের।

মিয়ানমার সরকার পর্যটন শিল্পের প্রসারে ২০১২ সালে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের সহায়তায় পর্যটনের জন্য আট বছরের মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এরই অংশ হিসেবে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর তৈরি, অত্যাধুনিক হোটেল নির্মাণ ও সড়ক সংস্কারসহ নেয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ।

Myanmar-Tourism4

গোল্ডেন প্যলেস

এই মহাপরিকল্পনার অংশ হিসেবে ৪৮৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি ব্যয়ে ৩৮টি প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে মিয়ানমার। এরই মধ্যে ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ই-ভিসা পদ্ধতি চালু করা হয়েছে। বিশ্বের ৬৭টি দেশের পর্যটক এই সেবা গ্রহণ করতে পারবে।

এছাড়া পর্যটন শিল্প প্রসারের জন্য ভিসা ফি কমাতে মিয়ানমার এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোর সাথে আলোচনা করছে। ইয়াঙ্গুন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের যাত্রী ধারণ সক্ষমতা দুই দশমিক সাত মিলিয়ন থেকে ছয় মিলিয়ন পর্যন্ত বাড়ানো হচ্ছে। এছাড়া ২০১৭ সালের মধ্যে হানথ্রোরওয়েডি, বাগো রিজিওন-এ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে মিয়ানমার।

আগে প্রতি বছর দুই থেকে আড়াই লাখ পর্যটক ইয়াঙ্গুন আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর দিয়ে মিয়ানমারে প্রবেশ করতো। সব মিলে বছরে ছয় থেকে আট লাখ পর্যটক যেতো দেশটিতে।

২০১১ সাল থেকে মিয়ানমার ভ্রমণে বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা ক্রমাগতভাবে বাড়তে শুরু করে। ২০১৩ সালে মিয়ানমারে ২০ লাখ পর্যটক ভ্রমণ করেছেন। ২০১৪ সালে এই সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় ৩০ লাখে। আর ২০১৫ সালে এই সংখ্যা ছাড়িয়ে যায় ৫০ লাখ।

Myanmar-Tourism

শ্বেন্দাগন প্যাগোডা

বর্তমানে ইয়াঙ্গুন, নেপিডো, সোয়াডাগুন পেগোডা, বাগান, ইনলে লেক, কিয়াকটো, মান্দালয় ও নেগপালি বিচ আন্তর্জাতিক পর্যটকদের কাছে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণীয়। এর পাশাপাশি আরো পর্যটন স্পট যেমন পুটো, মায়েক আর্চিপেলাগো, নাগাল্যান্ড, নাট মা টং ও লইকার মত পর্যটন এলাকাগুলোও জনপ্রিয় হচ্ছে। ফলে সারাবছরই ভ্রমণ পিপাসুরা মিয়ানমারে ঘুরতে যেতে পারবে।

পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে হোটেলগুলো তাদের রুমের ভাড়া কমানোসহ নানা উদ্যোগ নিয়েছে। একইসাথে বিমান সংস্থাগুলো উড়োজাহাজের বহর ও আন্তর্জাতিক রুট বাড়াচ্ছে। ইতোমধ্যে ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর, ঢাকাসহ বেশ কিছু রুটে ফ্লাইট বাড়ানোর অনুমতি পেয়েছে দেশটি।

এবার জেনে নিই মিয়ানমারের দর্শনীয় কিছু স্থান সম্পর্কে
গোল্ডেন প্যলেস
মান্দালয় শহরে অবস্থিত ঐতিহাসিক বৌদ্ধবিহার গোল্ডেন প্যলেস। এটি প্যালেসের মূল অংশ ছিলো কিন্তু তৎকালীন রাজার মৃত্যুর পর তার ছেলে এই অংশটি রাজবাড়ি হতে আলাদা করে দেন। কারণ মনে করা হতো ওখানে মৃত রাজার আত্মা ঘুরে বেড়ায়। পরবর্তীতে এটিকে বৌদ্ধ বিহারে পরিণত করা হয়। একসময় এটি স্বর্ণ দিয়ে ঘেরা ছিল।

Myanmar-Tourism6

ইরাবতী নদী

ম্রাউক উ
এটি মিয়নমারের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক শহর। এর পুরু ঘেরা দেয়ালের জন্য একে দুর্গ মনে করা হতো। এ দেয়ালটি প্রকৃতপক্ষে নির্মাণ করা হয় এখানে থাকা মন্দিরটিকে ভয়াল ঝড়ো হাওয়া থেকে রক্ষা করার জন্য।

তুয়াং কালাত
এটি মিয়ানমার অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান। এই বিহারটি নির্মিত হয় আগ্নেয়গিরির ঠিক মুখে। এই বিহারটিতে যেতে হলে দর্শনার্থীদের ৭৭৭ টি সিঁড়ি পেরুতে হবে। এমন পাহাড় চূড়া থেকে চারপাশের প্রকৃতিকে দেখার অনুভুতি এককথায় অতুলনীয়।

শ্বেন্দাগন প্যাগোডা
একে বৃহত্তম ড্রাগন প্যাগোডাও বলা হয়ে থাকে। বৌদ্ধ ধর্মবলম্বীদের জন্য অত্যন্ত পবিত্র একটি স্থান কেননা এখানে রাখা হয়েছে গৌতম বুদ্ধের একগাছি চুল ও বৌদ্ধ ধর্মের বহু অমূল্য পাণ্ডুলিপি।

Myanmar-Tourism5

ইরাবতী ব্রিজ

ইরাবতী নদী
পুরো মিয়ানমারেই ইরাবতীর স্পর্শ। মিয়ানমারের পাথেইন, লাইং ও ইয়াঙ্গুগুন এই ইরাবতীরই শাখা। প্রধান ১৫টি শহর অবস্থিত ইরাবতীর তীরে। এমনকি একসময়ের রাজধানী মান্দালয় ও ইয়াঙ্গুনও নদীসূত্রেই প্রতিষ্ঠিত। সেই প্রাচীনকাল থেকে ইরাবতীকে কেন্দ্র করেই ব্রহ্মদেশের যাতায়াত ব্যবস্থা ছিল। যেতে পারেন নদী দেখতে। এখানে বাড়তি পাওয়া যাবে রাস্তার দু’পাশের গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জীবন-যাপন, পাহাড়ের চুড়ায় মন্দির। সেই সাথেঙ্গ জেলেদের ধরে আনা প্রচুর মাছ।

বেগান
ঐতিহাসিক বৌদ্ধমন্দির, প্যাগোডা আর প্রাকৃতিক সবুজে ঘেরা বেগান পর্যটন বিশ্বের অন্যতম আকর্ষণ। এটি মিয়ানমারের অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটন স্পট। এখানে প্রায় ১৩ হাজারের বেশি বৌদ্ধমন্দির রয়েছে। এটি নবম থেকে ১৩ শতাব্দীর রাজাদের সা¤্রাজ্য হিসেবে পরিচিত। এটি সোনালি শহর হিসেবে বিশ্বজুড়ে সমাদৃত।

নগেপালি
সাদা বালি আর বঙ্গোপসাগরের নীল জলরাশির নগেপালিকে সাজিয়েছে অপরূপ সৌন্দর্যে। অধিকাংশ পর্যটক এখানে মাছ ধরার জন্য আসেন।

ইয়াঙ্গুন শহর

ইয়াঙ্গুন শহর

মিয়ানমারের নারীরা আমাদের দেশের মতো নয়। তারা অনেক বেশি পরিশ্রম করে। বেশিরভাগ ছোটব্যবসা প্রতিষ্ঠানই চালায় নারীরা, সাথেঙ্গ বাচ্চাদের দেখাশোনাসহ সংসারের অন্য কাজগুলোও করে হাসিমুখে।

কখন যাবেন
মিয়ানমার বেড়ানোর সবচেয়ে ভালো ও উপযুক্ত সময় শীতকাল। অর্থাৎ অক্টোবর থেকে জানুয়ারি দর্শনার্থীদের জন্য উপযুক্ত সময়। পর্যটকরা স্বচ্ছন্দে তাদের পছন্দের স্থানগুলোতে ঘোরাফেরা করতে পারবেন। তবে অন্য ঋতুতেও মিয়ানমার ভ্রমণ করা যায়।

কীভাবে যাবেন
মিয়ানমার ভ্রমণের সবচেয়ে সহজলভ্য উপায় হলো বিমানে ভ্রমণ। ঢাকা থেকে বাংলাদেশ বিমান ও নোভোএয়ার সপ্তাহে তিনটি করে ফ্লাইট পরিচালনা করছে। যাওয়া-আসার ভাড়া বাংলাদেশ বিমানে ট্যাক্সসহ সর্বনি¤œ ২৩ হাজার ৭২৩ টাকা আর নোভোএয়ারে ট্যাক্সসহ ২২ হাজার ৪৩০ টাকা।

Invitation-Card

ভিসা প্রসেসিং
ভ্রমণকারীদের মিয়ানমার সরকার বিভিন্ন মেয়াদের ভিসা প্রদান করে থাকে। সাধারণত অনলাইনে আবেদনের তিন কার্যদিবসের মধ্যে ভিসা প্রসেসিং শেষ হয়ে যায়। ভিসার জন্য www.myanmar-visa.org ওয়েবসাইট থেকে সব তথ্য জেনে আবেদন করতে পারেন।

প্রয়োজনীয় কাগজপত্র
মিয়ানমারের ভিসা প্রসেসিংয়ের জন্য দরকার ছয় মাসের মেয়াদসহ বৈধ পাসপোর্ট। দুই কপি ৪/৬ সেন্টিমিটারের রঙিন ছবি, ব্যাকগ্রাউন্ডের রং সাদা হতে হবে। ভ্রমণ ভিসার অনুমোদনপত্র। ভিসা স্ট্যাম্পের নগদ ডলার। বিমানের টিকিট ও হোটেল বুকিংয়ের কপি। ছয় মাসের ব্যাংক স্টেটমেন্ট। ব্যবসায়ী হলে ট্রেড লাইসেন্সের নোটারি কপি ও ভিজিটিং কার্ড, লিমিটেড কোম্পানি হলে মেমোরেন্ডাম। চাকরিজীবী হলে এনওসি, অফিস আইডি ও ভিজিটিং কার্ড।

থাকা-খাওয়া
মিয়ানমার খুব বেশি দিন হয়নি পর্যটন বিশ্বের নজর কেড়েছে। কিন্তু এ স্বল্প সময়ের মধ্যে ব্যাপক আলোচিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দেশটি। বিদেশী পর্যটকদের জন্য রাজধানী ইয়াঙ্গুনসহ প্রতিটি শহরেই রয়েছে বিলাসী হোটেল ও রিসোর্টের সুবিধা। রয়েছে দেশী-বিদেশী খাবারের ব্যবস্থা। এখানকার নামি হোটেলের মধ্যে ফিফটি স্ট্রিট, গ্রীন এলিফ্যান্ট, লা প্লান্তুর, রয়্যাল কারাউইক প্যালেস অন্যতম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *