মারুফ রহমান
কালের স্রোতধারায় মানুষের চিত্ত বিনোদনের ক্ষেত্রে যুক্ত হয়েছে বিচিত্রময় সব উত্সব। আর কালের বিবর্তনে কোনো উত্সবই এখন আর জাতি কেন্দ্রিক নয়। যেকোনো ধরনের উত্সবই এখন সার্বজনীন। তাই বলে কাদা নিয়ে উত্সব? অদ্ভুত শোনালেও ঘটনাটি সত্য। আমেরিকা মহাদেশের ব্রাজিলে রয়েছে ছোট-বড় সবার জন্য এ রকমই ভিন্নমাত্রার এক উত্সব। ‘ব্লকো দ্য লামা’ বা ‘কাদা উত্সব’ শিরোনামের উত্সবটি সত্যিই খুব বিচিত্রময়। শুধু ব্রাজিল নয়, চীনের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ইউনান প্রদেশের আদিবাসী গোষ্ঠিগুলোরও জনপ্রিয় উত্সব এটি। এ রকম উত্সবে অংশগ্রহণকারী প্রতিযোগিরা সবাই সবাইকে কাদা মাখিয়ে দেয়। আর এই উত্সবটি দিনে দিনে সারাবিশ্বের পর্যটকদের কাছে সবচেয়ে ভিন্নধর্মী উত্সবে পরিণত হয়েছে। তাই প্রতিবছর সারাবিশ্বের পর্যটকরা এখন কাদা উত্সবের সন্ধানে পাড়ি দেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে।
কাদাজলে মাখামাখি করে কেবল অবুঝ শিশুরাই মজা পায় তা নয়, কখনও কখনও বড়রাও ছোটদের মতো অবুঝ হয়ে ওঠে। নির্মল আনন্দ বা কোনো অন্ধ বিশ্বাস থেকে যুক্তিহীন কাজে ব্যয় করে অর্থ ও সময়। ব্রাজিলিয়ানদের এমনই এক অদ্ভুত উত্সবের নাম ব্লকো দ্য লামা। এর মানে হচ্ছে কাদা উত্সব। সাধারণ কথায় বললে কাদায় মাখামাখি করে যে উত্সব অনুষ্ঠিত হয় সেটিই কাদার উত্সব। ব্রাজিল, চীন কিংবা কোরিয়া যেখানে যে রীতিই থাকুক না কেন সর্বাগ্রে এ উত্সবটি কাদা মাখামাখির। মাটি-কাদায় প্রকৃতির কোলে ফিরে যাওয়ারও একটা প্রচ্ছন্ন উদ্দেশ্য রয়েছে এ উত্সবে। একই সঙ্গে রয়েছে কঠিন যান্ত্রিক জীবন থেকে একটু ছুটি নিয়ে আনন্দ উপলক্ষে জীবনটাকে রঙিন করা। বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে পালিত হয় এ উত্সব।
তবে উত্সব প্রিয় ব্রাজিলিয়ানদের মধ্যে এ উত্সব নিয়ে সবচেয়ে বেশি উন্মাদনা দেখা যায়। ১৯৮৬ সালে ব্রাজিলের রাজধানী রিও ডি জেনিরোতে এ উত্সবের সূচনা। এরপর এর জনপ্রিয়তা যেমন আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে তেমনি ক্রমশ তা হয়ে ওঠে দেশটির ঐতিহ্যপূর্ণ একটি উত্সব। এ উত্সবে উপস্থিত সবাই শরীরে ইচ্ছেমতো কাদা মেখে, কাদায় গড়াগড়ি করে, কাদা একে অন্যের দিকে ছুড়ে দিয়ে আনন্দ-উল্লাস করে। হাজার হাজার তরুণ-তরুণী, বৃদ্ধ, শিশুসহ সবাই বছরের এই সময়টাতে এসে মজার এই কাদা উত্সবে যোগ দেয়।
১৯৮৬ সালে ব্রাজিলের রাজধানী রিও ডি জেনিরো থেকে ১৫৫ মাইল উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত প্যারেটি শহরের কয়েক বন্ধু মিলে কাদার মধ্যে কাঁকড়া খুঁজতে গিয়ে নিজেদের শৈশবে ফিরে যান। আবিস্কার করেন অন্যরকম আনন্দের কিছু মুহূর্ত। তারা অবাক হয়ে লক্ষ্য করেন, কাদামাটিতে মাখামাখি হওয়ায় খুব একটা বিরক্ত লাগছে না। বরং কেমন যেন আনন্দ আর উত্তেজনা লাগছে। সেখান থেকেই কাদা উত্সবের প্রাথমিক ধারণা আসে। প্রথম দিকে খুবই অল্প পরিসরে আয়োজন করা হয় এ উত্সবের। নাক উঁচু অনেকেই তখন বিদ্রুপের হাসি হাসে। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় হারিয়ে গেছে নিন্দুকের দল। কিন্তু সেই কাদা মাখামাখি বিষয়টি পরিণত হয়েছে হাজারও মানুষের সার্বজনীন উত্সবে। এখন দেশ-বিদেশ থেকে পর্যটকরা একত্রিত হন এই কাদা উত্সবে যোগ দিতে। সাধারণভাবে চিন্তা করলে ব্যাপারটিকে নেহাত্ পাগলামো মনে হবে। কিন্তু এখানকার প্রতিযোগিদের ভাষ্য অনুসারে কাদা মাখার বিষয়টি খুবই আনন্দের। আর সেই আনন্দ যখন অনেক লোক একসঙ্গে করে তখন সেটা উত্সবে রূপ নিতেই পারে। আর এ কারণেই ব্রাজিলিয়ান ব্লকো দ্য লামা বা কাদা উত্সবের এতো বেশি কদর। আর তাই প্রতিবছর কাদা উত্সবে প্যারেটিজুড়ে আনন্দ আর উত্সবের বন্যা বয়ে যায়। উত্সব যখন শুরু হয় তখন সবাই একসঙ্গে কর্দমাক্ত ভূমিতে ঝাঁপিয়ে পড়েন। কাদাজলে মাখামাখি অবস্থা। শুধু কী তাই, সেখানে বেশ কিছুক্ষণ গড়াগড়ি খান তারা। এরপর একে অন্যের দিকে কাদা ছুড়ে মারেন। আর কাদায় মাখামাখি হয়ে সবার সত্যিকারের চেহারাটা ঢেকে যায়।
কিন্তু আনন্দটা এখানেই। তবু চলতে থাকে কাদা ছোড়াছুড়ি। সবাই যেন অবুঝ শিশু হয়ে ওঠেন এ দিনটিতে।
এ উত্সব অবশ্য কেবল কাদা মাখামাখির উত্সবই নয়, এখানে আরও অনেক ব্যাপার রয়েছে। উত্সবে মাততে প্যারেটিতে আসা অনেকে গায়ে মাখা কাদা দিয়ে শরীরে তৈরি করেন নানারকম অদ্ভুত শিল্পকর্ম। এগুলো তৈরির মাধ্যমে একে অন্যের নজর কাড়েন। অনেকে আবার কাদা দিয়ে পোশাক তৈরি থেকে শুরু করে বিভিন্ন বিমূর্ত ভাস্কর্যও তৈরি করেন। সব মিলিয়ে কাদা মাখার আনন্দের সঙ্গে শিল্পের ছোঁয়াই এ উত্সবকে দিয়েছে একটি জাঁকজমকপূর্ণ চেহারা।
প্যারেটির এই কাদা উত্সব এখন আর নির্দিষ্ট জায়গার মানুষের আনন্দ উপলক্ষেই আবদ্ধ নেই, বর্তমানে এটি পরিণত হয়েছে ব্রাজিলের একটি রাষ্ট্রীয় পর্যটন বিনোদনে। প্যারেটির কাদা উত্সব যতোদিন যাচ্ছে, ততোই আকৃষ্ট করছে বিশ্ব পর্যটকদের। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ এখন অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় থাকেন ব্রাজিলে এসে গায়ে কাদা মাখানোর জন্য। আর তাই ব্রাজিলের পর্যটন ব্যবসার খুব বড় অংশ এখন এ উত্সবকে ঘিরেই। আর এ উত্সবের জন্য কর্তৃপক্ষও সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা ও অফার নিয়ে তৈরি থাকে দেশি-বিদেশি ট্যুরিস্টদের জন্য।
তবে এ উত্সবের শুরু নিয়ে একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট রয়েছে। এখানে নাকি বহুকাল আগে রোগ-বালাই থেকে মুক্তি পেতে রেড ইন্ডিয়ানরা প্যারেটির কাদা গায়ে মাখতো। তাদের ধারণা ছিল, এটি রীতিমতো মহৌষধের মতো। সুস্থ-সবল থাকার জন্য থকথকে কাদা মেখে সমুস্থ শরীর ঢেকে ফেলতো তারা। সেই কাদা শরীরে নিয়ে রোদে বসে থাকতো সারাদিন। স্বভাবতই কিছুক্ষণের মধ্যে শুকিয়ে যেত শরীরের সব কাদা। আর শুকিয়ে যাওয়ার পর শরীর থেকে কাদা তুলে ফেলা হতো। এ প্রক্রিয়াটি অনেকটা কবিরাজী চিকিত্সার মতো ছিল। রেড ইন্ডিয়ানদের বিশ্বাস ছিল, কাদা মাখার ফলে রোগ-বালাই তাদের শরীরে বাসা বাঁধবে না। এমনকি দীর্ঘজীবন পাওয়ারও একটা সুপ্ত আকাঙ্ক্ষা মিশে ছিল এই কাদা মাখার ব্যাপারটিতে। শরীরে কাদা মাখার সময় উত্সব চলতো প্যারেটিতে। ১৯৮৬ সালের আধুনিক কাদা উত্সব সেই পুরোনো ধারণা থেকেই চালু হয়েছে বলে মনে করেন অনেক ঐতিহাসিক।
ব্রাজিলের মতো দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিউলেও একই রকম অবাক করা উত্সব অনুষ্ঠিত হয়। সিউল থেকে বাসে ঘণ্টা আড়াইয়ের পথ বোরেয়ং। আর অদ্ভুত উত্সবের কেন্দ্র এটিই। বোরেয়ংয়ের এ উত্সবের নাম ‘ওয়ার্ল্ডস ডার্টিয়েস্ট ফেস্টিভ্যাল’। এটিও এক ধরনের কাদা উত্সব। বোরেয়ংয়ের কাদা উত্সবের বিশেষত্ব হলো, কাদা নিয়ে চলে হৈহুল্লোড়। ব্রাজিলের মতো কোরিয়ার উত্সবটিও কম জাঁকজমক নয়। প্রতিবছর জুলাই মাসে সিউলের কাছাকাছি এই সৈকত শহরে বসে কাদা উত্সবের আসর। অনেকের ধারণা, বোরেয়ংয়ের কাদায় নাকি আছে আশ্চর্য ঔষধি গুণ। তার টানেই বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে ১০ লাখেরও বেশি মানুষ কাদা উত্সবে যোগ দিতে এখানে আসেন।
একদিকে সমুদ্র আর অন্যদিকে পাহাড় ঘেরা এই শহরে ঢুকলেই বোঝা যায়, সেখানে কাদা উত্সবের উন্মাদনা কত বেশি। কাদা উত্সবের সময় ঘনিয়ে এলেই লাখ লোকের হাট বসে যায় ওখানে। জনতার কাদায় মাখামাখিতে অংশ নিয়ে চলে মাড স্লাইডিং, মাড রেসলিং, মাড ম্যারাথন থেকে শুরু করে ওমগাসাইজের বাথটবে সাঁতার। বিদেশ থেকে অনেকে সেখানে এসে হাজির হন। কাদা উত্সবের ভিড়ে হাজির হয় ছোটরাও। তাদের উপস্থিতি বুঝিয়ে দেয়, এই আনন্দের উত্সব সবারই। চীন, যুক্তরাজ্যের সমারসেটসহ বিশ্বের আরও কয়েকটি দেশে এ ধরনের উত্সব অনুষ্ঠিত হয়। সৌজন্যে : ইত্তেফাক